জেলেনস্কির ‘অপমানে’ ফুঁসছে ইউরোপ, কোন দিকে বাঁক নিচ্ছে বিশ্ব রাজনীতি

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ০৩ মার্চ ২০২৫, ০৪:২১ পিএম

ছবি: সংগৃহীত
ওয়াশিংটনের ওভাল অফিসে বসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে তীব্র বাদানুবাদ। ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির এমন আচরণে রাগে ফুঁসছে যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে, শান্তির খোঁজে বসা নিষ্ফলা ওই বৈঠকের জেরে সম্পূর্ণ উল্টো দিকে বাঁক নিয়েছে বিশ্ব রাজনীতি। দ্রুত বদলাতে শুরু করেছে ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের সমীকরণ।
চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি ট্রাম্প-জেলেনস্কি বাদানুবাদের ছবি প্রত্যক্ষ করে গোটা বিশ্ব। আলোচিত এই মিটিংটির কিছুক্ষণের মধ্যে হোয়াইট হাউস ছেড়ে বেরিয়ে যান ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট। ঘটনাটি জানাজানি হতেই তার পাশে দাঁড়িয়ে তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিরাপত্তা এবং পররাষ্ট্রবিষয়ক প্রধান কাজা কালাস।
ট্রাম্প-জেলেনস্কি নিষ্ফলা ওই বৈঠকের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোলাস লেখেন, ‘আজ এটা প্রমাণিত যে ‘মুক্ত বিশ্ব’ তৈরি করার জন্য নতুন নেতার প্রয়োজন। এই চ্যালেঞ্জ আমাদের অর্থাৎ ইউরোপীয়দেরই গ্রহণ করতে হবে। কারণ, ইউক্রেন হল ইউরোপ। আমরা সব সময়ে কিয়েভকে সমর্থন করে যাব যাতে আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে তারা লড়াই চালিয়ে যেতে পারে।’
এক্স হ্যান্ডলে (সাবেক টুইটার) করা পোস্টে কালাস অবশ্য সুনির্দিষ্ট করে ট্রাম্প বা যুক্তরাষ্ট্রের নাম করেননি। ‘মুক্ত বিশ্বের’ নেতা কীভাবে ঠিক হবে, তা-ও স্পষ্ট নয়। তবে এ ব্যাপারে ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানিসহ পশ্চিম ইউরোপের অধিকাংশ দেশের সমর্থন পেয়েছেন তিনি।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের শীর্ষ কর্মকর্তার এমন মন্তব্যে অবশ্য আশঙ্কা দেখছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা। তাদের কথায়, ট্রাম্প-জেলেনস্কির বৈঠকের পর জি-৭ ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে স্পষ্ট বিভাজন দেখা যাচ্ছে। এরপর যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটো ত্যাগ করলে ইউরোপের নিরাপত্তা যে প্রশ্নের মুখে পড়বে, তা বলাই বাহুল্য।
১৯৪৫ সালে জাপানের আত্মসমর্পণের মধ্যে দিয়ে শেষ হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এর চার বছরের মধ্যেই মূলত পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোকে সঙ্গে নিয়ে ‘নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন বা ন্যাটো) গড়ে তোলে যুক্তরাষ্ট্র। বর্তমানে এর সদস্য সংখ্যা ৩২। ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর পারস্পরিক সামরিক সহযোগিতা প্রদানে অঙ্গীকারবদ্ধ।
বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে প্রায় সাড়ে চার দশক ধরে আমেরিকা ও তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়ার মধ্যে চলে ‘স্নায়ু যুদ্ধ’। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ভেঙে গেলে পুরোপুরি থেমে যায় ওই ঠান্ডা লড়াই। বিশ্লেষকদের দাবি, এরপর থেকেই ইউরোপের দেশগুলো প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে প্রবলভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
কিন্তু, এ বছরের জানুয়ারিতে দ্বিতীয়বারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নিয়ে এই নীতিতে পরিবর্তন এনেছেন ট্রাম্প। ইউরোপের নিরাপত্তার জন্য প্রতি বছর কাঁড়ি কাঁড়ি ডলার খরচ করতে রাজি না তিনি। এর জন্য প্রয়োজনে ন্যাটো ত্যাগের হুমকিও দিয়েছেন এই বর্ষীয়ান রিপাবলিকান নেতা।
ট্রাম্প যে ইউরোপের নিরাপত্তা নিয়ে মোটেই ভাবেন না, জেলেনস্কির সঙ্গে বৈঠকের পর তা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে। ফলে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর থেকে নির্ভরশীলতা কমাতে কোমর বেঁধে লেগে পড়েছে ব্রিটেন, ফ্রান্স বা জার্মানির মতো শক্তিশালী দেশগুলো। আর তাই এই কাজে নেতৃত্ব দিতে নতুন নেতার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই মুখ খুলেছেন জার্মানির পরবর্তী সম্ভাব্য চ্যান্সেলর তথা মধ্য-ডানপন্থী ‘ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়ান পার্টি’র নেতা ফ্রিডরিখ মেয়ার্ৎজ। তার কথায়, ‘ইউরোপকে শক্তিশালী করার ব্যাপারে আমাদের জোর দিতে হবে। এর মাধ্যমে আমরা ধীরে ধীরে নিরাপত্তার প্রশ্নে আমেরিকার থেকে স্বাধীনতা অর্জন করতে পারব।’
এ বছরের জুনে বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসের সদর দপ্তরে শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেবে ন্যাটোভুক্ত সমস্ত দেশ। সেখানে এ ব্যাপারে বড় সিদ্ধান্ত হতে পারে বলে মনে করছেন সম্ভাব্য জার্মান চ্যান্সেলর মেয়ার্ৎজ।
তিনি বলছেন, জুনের সম্মেলনেই ন্যাটোর রূপ পরিবর্তনের ব্যাপারটি পরিষ্কার হয়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে স্বাধীন ইউরোপীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আমাদের গড়ে তুলতে হবে।
কিন্তু, এত কিছুর পরেও পশ্চিম ইউরোপের সমস্ত দেশ যে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এককাট্টা, তা নয়। উদাহরণ হিসাবে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমান্যুয়েল ম্যাক্রোঁ ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের কথা বলা যেতে পারে। এখনই প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদে প্রবল আপত্তি রয়েছে তাদের। আর সে কথা খোলাখুলি ভাবে জানিয়েও দিয়েছেন তারা।
অন্যদিকে সমস্যা সমাধানে একটি অভিনব পদক্ষেপের প্রস্তাব দিয়েছেন ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি। ইউরোপ, ইউক্রেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি জরুরি বৈঠকের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। একটি বিবৃতিতে মেলোনি বলেন, ‘চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য ইউরোপীয় দেশগুলোকে আলোচনার রাস্তা নিতে হবে। ইউক্রেনকে রক্ষা করতে হলে দেরি না করে অবিলম্বে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ‘বন্ধু’দের কথা বলা উচিত।’
ইতালির প্রধানমন্ত্রীর এই প্রস্তাব ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ট্রাম্প মেনে নেবেন কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। অন্যদিকে হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর আরবান আবার বৈঠক ভেস্তে যাওয়ার জন্য জেলেনস্কিকেই দুষেছেন।
গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘ট্রাম্প সাহসের সঙ্গে শান্তির পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। তাই আপাতত অনড় না থেকে কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতেই পারত।’
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ইউক্রেনে ‘বিশেষ সেনা অভিযান’ চালাচ্ছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তিন বছর পেরিয়ে যুদ্ধ থামার নামগন্ধ না নেওয়ায় সম্প্রতি এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেন ট্রাম্প। জেলেনস্কিকে ওয়াশিংটনে ডেকে পাঠান তিনি। সেখানে শান্তি সমঝোতার বিষয়ে আলোচনার সময়েই মেজাজ হারান দুই রাষ্ট্রনেতা।
ইউক্রেন যুদ্ধের প্রথম দিন থেকেই কিয়েভকে আর্থিক এবং সামরিক দিক থেকে সাহায্য করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। জেলেনস্কির সঙ্গে বৈঠকে সে সব পুরোপুরিভাবে বন্ধ করার হুঁশিয়ারি দেন ট্রাম্প। কিন্তু তাতেও আগাগোড়া অনড় ছিলেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট। এমনকি বৈঠক শেষে নিজের আচরণের জন্য ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্নেও সাফ ‘না’ বলে দেন তিনি।
ওভাল অফিসে প্রায় ৪০ মিনিট ধরে চলা বৈঠকের অধিকাংশ সময়েই দুই রাষ্ট্রনেতার মধ্যে চলে বাদানুবাদ। আলোচনা চলাকালীন গণমাধ্যমের সামনেই পূর্ব ইউরোপের যুদ্ধের জন্য জেলেনস্কিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করান ট্রাম্প। বলেন, ‘লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে জুয়ায় বসেছেন তিনি। আর তাই সমঝোতার পথে হাঁটতে চাইছেন না।’
উল্লেখ্য, এই প্রথম কোনো রাষ্ট্রনেতার সামনে ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ’ শব্দবন্ধ ব্যবহার করলেন ট্রাম্প। তার কথায়, ‘শান্তির জন্য রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনকে চুক্তি করতেই হবে। এর জন্য কিছু ক্ষেত্রে আপসের প্রয়োজন রয়েছে। তবে সেটা খুব বেশি নয়। কিন্তু চুক্তিবদ্ধ না হলে কিয়েভের সঙ্গে থাকবে না আমেরিকা।’ মার্কিন প্রেসিডেন্টের এমন হুঁশিয়ারিকে অত্যন্ত তাৎপর্য বলে মনে করা হচ্ছে।
ওভাল অফিসে বৈঠক চলাকালীন জেলেনস্কিকে বাস্তববাদী হতে বলেন ট্রাম্প। জবাবে ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘আপনি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মিথ্যারই পুনরাবৃত্তি করছেন। রাশিয়াকে সুযোগ করে দিচ্ছেন। মস্কো আমাদের জায়গা চুরি করছে, সাধারণ নাগরিকদের হত্যা করছে, শিশুদের অপহরণ পর্যন্ত করছে। এতো কিছুর পরে কীভাবে বাস্তববাদী হতে বলেছন?’
অন্যদিকে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে জেলেনস্কির বাদানুবাদ এবং বৈঠক ভেস্তে যাওয়ার ঘটনায় উচ্ছ্বাসিত মস্কো। এর জন্য ইউক্রেন প্রেসিডেন্টের ঘাড়েই দোষ চাপিয়েছে মস্কো। সাবেক রুশ প্রেসিডেন্ট তথা নিরাপত্তা পরিষদের উপপ্রধান দিমিত্রি মেদভেদেভ একটি বিবৃতিতে বলেছেন, ‘অহঙ্কারী বরাহনন্দন ওভাল অফিসে সপাটে থাপ্পড় খেয়েছেন।’
ট্রাম্প-জেলেনস্কি বৈঠক ভেস্তে পাওয়ার পর ইউক্রেনের সাহায্যে এগিয়ে এসেছে ব্রিটেন। রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে কিয়েভকে ২৮০ কোটি ডলারের ঋণ দেওয়ার কথা ঘোষণা করছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্টারমার। ফলে আগামী দিনে লড়াই আরও ছড়িয়ে পড়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি কোন খাতে বয়ে চলে, সেটাই এখন দেখার।