সহপাঠিসহ ৫ বছরে ৬০ ব্যক্তির ধর্ষণের শিকার কিশোরী, অতঃপর?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ০২ মার্চ ২০২৫, ০৫:০২ পিএম

পাঁচ বছর আগে ভারতের অন্যতম সুবিধাবঞ্চিত সম্প্রদায়ের এক হতদরিদ্র দিনমজুরের ১৩ বছর বয়সি মেয়ে প্রথমবারের মতো প্রতিবেশীর দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হন।
পুলিশ জানিয়েছে, ওই ব্যক্তি নির্যাতনের ভিডিও ধারণ করে এবং সেটি ব্যবহার করে মেয়েটিকে ব্ল্যাকমেইল করে। যার ফলশ্রুতিতে মেয়েটি পরবর্তী পাঁচ বছর ধরে অর্ধশতাধিক ব্যক্তির দ্বারা ধর্ষিত ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়।
আর এসব ঘটনা তখনই প্রকাশ্যে আসে যখন মেয়েটি সম্প্রতি কেরালার একটি কলেজে এক পরামর্শদাতার (কাউন্সিলর) সঙ্গে কথা বলেন এবং তার ওপর ঘটে যাওয়া বিভীষিকাময় নির্যাতনের কথা জানান। বর্তমানে তার বয়স ১৮ বছর।
পুলিশ জানিয়েছে, এই মামলায় এখন পর্যন্ত ৫৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে ধর্ষণ, গণধর্ষণ এবং যৌন নিপীড়নের অভিযোগ আনা হয়েছে। আরও দুজন সন্দেহভাজন অভিযুক্ত দেশ ছেড়ে পালিয়েছে।
মামলার নথি ও পুলিশের সাক্ষাৎকার অনুযায়ী, অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন মেয়েটির স্কুলের সহপাঠী, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী এবং সম্পূর্ণ অপরিচিত ব্যক্তিরাও। যাদের বয়স নাবালক থেকে শুরু করে ৪০-এর কোঠায়।
এখনো অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দায়ের হয়নি। তবে তারা পুলিশ হেফাজতে রয়েছেন।
ভারতে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা ও জাতিবিদ্বেষ
ভারতে লিঙ্গবৈষম্য ও পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতির কারণে নারীদের প্রতি সহিংসতা ব্যাপকভাবে প্রচলিত। যদিও অপরাধীদের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে।
২০২৪ সালের আগস্টে কলকাতায় এক মেডিকেল কলেজ শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা ভারজুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভের জন্ম দেয়। কিন্তু কেরালার এই ঘটনাটি তেমন কোনো আলোড়ন সৃষ্টি করেনি।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এর কারণ হলো- ভুক্তভোগী একটি দলিত পরিবার থেকে এসেছে।
দলিতরা ভারতের বহু শতাব্দী পুরোনো জাতিভিত্তিক হিন্দু বর্ণব্যবস্থার সবচেয়ে নিচের স্তরে অবস্থান করেন এবং সামাজিকভাবে অবহেলিত। ঐতিহাসিকভাবে তাদের ‘অস্পৃশ্য’ হিসেবে দেখা হতো এবং তারা বিভিন্ন সামাজিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত থেকেছেন।
যদিও আইনের চোখে জাতিগত বৈষম্য নিষিদ্ধ। তবে বাস্তবে দলিতরা ব্যাপকভাবে বৈষম্যের শিকার হন। অনেক ক্ষেত্রে তাদের ওপর সংঘটিত অপরাধগুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনাই নেওয়া হয় না এবং ন্যায়বিচার পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
এ বিষয়ে দলিত অধিকার কর্মী সিনথিয়া স্টিফেন বলেন, যখন নির্যাতিতা দলিত সম্প্রদায়ের কেউ হন, তখন সাধারণত দেশজুড়ে ক্ষোভ ও প্রতিবাদ কম হয়। কারণ তাদের অনেকেই মনে করেন, এই মেয়েটি ‘আমাদের সমাজের অংশ নয়’।
প্রতারণা, হুমকি এবং যৌনপাচার
পুলিশ জানিয়েছে, প্রথমবার নির্যাতনের পর অভিযুক্ত ব্যক্তি মেয়েটির নগ্ন ছবি ও ভিডিও ব্যবহার করে তাকে ব্ল্যাকমেইল করতে থাকে। এরপর বিভিন্ন পুরুষ তাকে প্রতারণার মাধ্যমে ধর্ষণ করে।
‘কেউ কেউ বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে মেয়েটিকে ফাঁদে ফেলেছিল। কেউ হুমকি দিয়েছিল, ঘটনা জানালে তাকে হত্যা করা হবে। আবার অনেক সময় একসঙ্গে চার-পাঁচজন দলবদ্ধভাবে তাকে ধর্ষণ করেছে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নির্যাতন চলত রাতের বেলা, যখন মেয়েটির বাবা ঘুমিয়ে পড়তেন। অভিযুক্তরা ইনস্টাগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে তাকে এভাবে দিনের পর দিন ফাঁদে ফেলতো’।
পুলিশ বলেছে, কিছু ঘটনায় মেয়েটিকে তার গ্রাম থেকে অনেক দূরের এলাকায় নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করা হয়েছিল। যা মানবপাচারের মতো অপরাধ হিসাবে গণ্য হতে পারে।
মেয়েটির গ্রামে প্রতিক্রিয়া
কেরালার সবুজ পাহাড়ের ছোট্ট গ্রামটিতে এ ঘটনা জানাজানি হলে সেখানকার মানুষ স্তম্ভিত হয়ে যায়।
তবে বিষয়টি কিশোরীটি জন্য আরও অমানবিক হয়ে দাঁড়ায়, যখন স্থানীয় কিছু নারী এই নির্যাতিতার পক্ষে দাঁড়ানোর পরিবর্তে অভিযুক্তদের প্রতি সহানুভূতি দেখান এবং মেয়েটিকেই দায়ী করেন।
স্থানীয় এক সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘গ্রামের অনেক নারী বলছেন, মেয়েটির পোশাক এবং চলাফেরাই তার ওপর নির্যাতনের কারণ’।
এক অভিযুক্তের মায়ের দাবি, ‘আমার ছেলে নির্দোষ। সে ছোটবেলা থেকে ওই মেয়েটিকে চেনে, তাকে কোলে-পিঠে করে বড় করেছে!’
দলিত নারীদের প্রতি সহিংসতা ও বিচারহীনতা
ভারতে দলিত সম্প্রদায়ের নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বহু বছর ধরেই একটি গুরুতর সমস্যা। ২০২২ সালে দলিত ও অন্যান্য নিপীড়িত সম্প্রদায়ের নারীদের ওপর ৪,২৪১টি ধর্ষণের মামলা রেকর্ড করা হয়। যা দিনে ১০টিরও বেশি ধর্ষণের সমান।
সিএনএন-এর সঙ্গে আলাপচারিতায় সমাজবিজ্ঞানী মধুমিতা পাণ্ডে বলেন, ‘যখন নির্যাতনকারী পরিচিত কেউ হন—বন্ধু, প্রতিবেশী, আত্মীয়—তখন অনেক সময় ভয়, সামাজিক লজ্জা বা পরিবারের সম্মানের কথা ভেবে ভুক্তভোগীরা মুখ খোলেন না।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, কেরালায় ৯৮ শতাংশ ধর্ষণের ঘটনায় ভুক্তভোগীর পরিচিত কেউ জড়িত থাকে।
বর্তমান অবস্থা ও আইনি লড়াই
এখন মেয়েটি একটি সুরক্ষিত আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছে এবং কাউন্সেলিং পাচ্ছে। পুলিশ জানিয়েছে, তারা মামলার জন্য ‘সর্বোচ্চ সংখ্যক পুলিশ সদস্য’ নিয়োজিত করেছে।
তবে ভারতে ধর্ষণের বিচারপ্রক্রিয়া অত্যন্ত দীর্ঘ ও জটিল। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, ২০২২ সালে ধর্ষণ মামলার মাত্র ২৭ শতাংশ ক্ষেত্রে অভিযুক্তদের দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে।
আশার আলো
সামাজিক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও দলিত মেয়েটি এ ঘটনা প্রকাশ্যে আনতে পেরেছে। যা একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন নির্দেশ করে।
দলিত অধিকারকর্মী সিনথিয়া স্টিফেন বলেন, ‘যদি সে অভিযোগ না আনত, তাহলে হয়তো তাকে বছরের পর বছর ধরে নির্যাতিত হতে হতো এবং কেউই তাকে সাহায্য করত না’।
মূলত এ ঘটনাটি ভারতের ন্যায়বিচার ব্যবস্থার জন্য আরেকটি কঠিন পরীক্ষা হতে যাচ্ছে। এখন দেখার বিষয়, দেশটির আদালত দলিত নারীদের প্রতি সংঘটিত অপরাধের বিরুদ্ধে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারে কিনা। সূত্র: সিএনএন, দ্য নিউজ মিনিটস, ইন্ডিয়া’স ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো