
ছবি: সিবিএস
রাশিয়া ২০২২ সালে ইউক্রেনে হামলা শুরু করে। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ইউক্রেনকে করে সহযোগিতা করেছে। একইসঙ্গে কিয়েভের পক্ষে রয়েছে ইউরোপ। এক্ষেত্রে তুরস্কের ভূমিকা ছিল অনেকটা কৌশলী। তুরস্ক একদিকে ইউরোপের দেশ, আবার মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোর দ্বিতীয় বৃহত্তম সদস্য। কিন্তু তারপরও সরাসরি রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়নি আঙ্কারা।
ইউক্রেনের সঙ্গে থাকা প্রতিরক্ষা চুক্তির অংশ হিসেবে একদিকে কিয়েভকে ড্রোন সরবরাহ করেছে, অন্যদিকে ইউরোপ ও আমেরিকার পক্ষ থেকে মস্কোর বিরুদ্ধে আরোপিত বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞার অংশীদার হয়নি আঙ্কারা। অর্থাৎ কিয়েভকে ড্রোন দিলেও মস্কোর সঙ্গেও কূটনৈতিক সম্পর্ক অক্ষুণ্ন রেখেছে এরদোগানের দেশ। পাশাপাশি শুরু থেকেই ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে তুরস্ক। এ নিয়ে নিরপেক্ষ ভেন্যু হিসেবে আঙ্কায় রাশিয়া, ইউক্রেন ও জাতিসংঘের প্রতিনিধির সমন্বয়ে কয়েক দফা বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেই হিসেবে ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের ক্ষেত্রে অন্যতম উদ্যোক্তা হিসেবে বিবেচনা করা হয় এরদোগান ও তার দেশকে।
কিন্তু গেল জানুয়ারি মাসে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তখন থেকেই পুরো চিত্র পাল্টে যেতে থাকে। ইতোমধ্যে ইউক্রেনকে সব ধরনের সহযোগিতা করা বন্ধ করে দিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। নির্বাচনের আগে থেকেই ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছিলেন ট্রাম্প। ক্ষমতাগ্রহণের পর যেন তড় সইছে না তার। ক্ষমতার একমাস যেতে না যেতেই যুদ্ধ বন্ধের চূড়ান্ত উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইউক্রেন থেকে বেরিয়ে ট্রাম্প এখন পূর্ণ মনোযোগ দিতে চাইছেন মধ্যপ্রাচ্যে। অর্থাৎ গ্রেটার ইসরাইল প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ক্ষমতার প্রথম মেয়াদে যে কাজ শুরু করেছিলেন, এবার সেটা চূড়ান্ত করতে চান তিনি। আব্রাহাম অ্যাকর্ডের অধীনে ইসরাইলের সঙ্গে মুসলিম- বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ক্ষেত্রে ওই সময় অনেক দূর অগ্রসর হয়েছিলেন ট্রাম্প। সে সময় মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম প্রভাবশালী দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং বাহরাইন, মরক্কো ও সুদান ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকরণের চুক্তি করে। শোনা যাচ্ছিল, সৌদি আরবও চুক্তির দ্বারপ্রান্তে চলে এসেছে। কিন্তু তার মধ্যেই ট্রাম্পের শাসনকাল শেষ হয়।
এরপর বাইডেন প্রশাসন ২০২৩ সালের অক্টোবরে গাজায় শুরু হওয়া ইসরাইলি আগ্রাসনে উলঙ্গ সমর্থন দিয়েছে, কিন্তু ট্রাম্পের সেই মিশন নিয়ে তেমন কোনো কথা বলতে দেখা যায়নি। তবে ট্রাম্প দায়িত্ব নিয়েই সেই অসমাপ্ত মিশন শেষ করার কাজ শুরু করেছেন। ইতোমধ্যে ফিলিস্তিনিদের তাড়িয়ে গাজা দখলের ঘোষণা দিয়েছেন বহুল আলোচিত এই রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট। সৌদি আরবসহ আশপাশের কয়েকটি আরব দেশ ট্রাম্পের এই ঘোষণার প্রতিবাদ করেছে ঠিকই, কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান ঘটানোর যে প্রক্রিয়া শুরু করেছেন, সেটার নোঙর ফেলেছেন রিয়াদে।
ইতোমধ্যে ওয়াশিংটনের উদ্যোগে সৌদি রাজধানীতে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের মধ্যে বৈঠক হয়েছে, যেখানে ডাকা হয়নি যুদ্ধের অপরপক্ষ ইউক্রেনকে। এমনকি আমেরিকার অন্যতম পার্টনার ইউরোপ এবং এতদিন ধরে যুদ্ধ বন্ধের প্রচেষ্টা চালানো তুরস্ককেও এই বৈঠকে রাখা হয়নি।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, সৌদি আরব কেন এমন একটা বৈঠকের আয়োজক দেশ হলো- যেখানে যুদ্ধ বন্ধের অন্যান্য স্টেকহোল্ডার- এমনকি খোদ ইউক্রেনের উপস্থিতি নেই?
এ ব্যাপারে পশ্চিমা বিশ্লেষকদের বরাত দিয়ে মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএন বলছে, সৌদি আরবের ডিফ্যাক্টো শাসক মোহাম্মদ বিন সালমান বিগত কয়েক বছর যাবত তার দেশকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন। কিন্তু মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্টের কলাম লেখক সাংবাদিক জামাল খাশোগির হত্যাকে কেন্দ্র করে বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে তার টানাপোড়েন শুরু হয়। এর ফলে তার সে প্রচেষ্টা খানিকটা বাধাগ্রস্ত হয়েছে, তবে ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর সেই সুযোগ লুফে নিতে চাচ্ছেন এমবিএস হিসেবে পরিচিত সৌদি ক্রাউন প্রিন্স। এমবিএস সৌদি আরবকে তেলের ওপর পূর্ণ নির্ভরশীলতা থেকে বের করে আনার জন্য ২০২৩ ভিশন ঘোষণা করেছেন। এর অংশ হিসেবে বিগত কয়েক বছরে দেশটিতে বেশ কিছু বিতর্কিত সংস্কারও করা হয়েছে।
ওই বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান ঘটানোর মধ্যস্থতা করার মাধ্যমে রিয়াদ নিজেকে প্রভাবশালী হিসেবে প্রমাণ করতে চায়। আর তা সম্ভব হলে সেই প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে বিন সালমান গাজা তথা ফিলিস্তিন ইস্যুর একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান করতে পারবেন বলেও মনে করছেন তারা।
কিন্তু সৌদি আরব তা করতে পারবে কি না- সেটা সময়ই বলে দেবে। কারণ কেউ কেউ মনে করছেন, ইউক্রেন যুদ্ধের অন্যান্য স্টেকহোল্ডার তথা তুরস্ক ও ইউরোপ এবং খোদ কিয়েভকে কৌশলে এই আলোচনা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে কি না- সেটাও দেখার বিষয়। কারণ এই পক্ষগুলো মধ্যপ্রাচ্যে দ্বি-রাষ্ট্রিক সমাধান তথা ফিলিস্তিন ও ইসরাইল রাষ্ট্রে বিশ্বাসী।
পাশাপাশি- শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যকার এই আলোচনার আয়োজক হওয়ার ক্ষেত্রে তুরস্কের প্রভাব খর্বের ইচ্ছাও সৌদি আরবের থাকতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ দীর্ঘ বছর, বিশেষ করে এরদোগান তুরস্কের ক্ষমতায় বসার সময় থেকে, রিয়াদ ও আঙ্কারার মধ্যে টানাপোড়েন চলছে। তুরস্কে এরদোগানপন্থিদের ক্ষমতার উত্থানকে সৌদি কর্তৃপক্ষ তাদের রাজতন্ত্রের জন্য হুমকি মনে করে। মূলত সে কারণেই এই টানাপোড়েন। এমন পরিস্থিতি বিন সালমান চাইতেই পারেন যে, ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান ঘটানোর ক্রেডিট তার ঝুলিতে পড়ুক। এতে বিগত বছরগুলোতে মুসলিম দেশগুলোর পাশাপাশি বহির্বিশ্বে তুরস্কের যে অবস্থান তৈরি হয়েছে, সেটার প্রভাব খানিকটা খর্ব হোক। তবে এ জায়গাতেই নতুন খেল দেখিয়েছেন তুর্কি নেতা রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান।
অর্থাৎ- যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা যখন রিয়াদে বৈঠক করেন, তখন আঙ্কারা সফর করেছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। তিনি অভিযোগ করেছেন, যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তা দেওয়ার নাম করে ইউক্রেনের ৫০ শতাংশ খনিজ সম্পদের মালিক হতে চায়। কিন্তু আমি তো দেশ বিক্রি করে দিতে পারি না। আমি ইউক্রেনকে রক্ষার জন্য লড়াই করছি। তাছাড়া ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট এককভাবে সৌদি আরব সফরের যে সূচি ঘোষণা করেছিলেন, সর্বশেষ সেটাও স্থগিত করে দিয়েছেন তিনি।
অন্যদিকে, ট্রাম্প প্রশাসন শুধুমাত্র রাশিয়ার সঙ্গে বৈঠক করায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ইউরোপের দেশগুলো। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বলেছেন, আমরা ইউক্রেনে পাকাপোক্ত ও দীর্ঘস্থায়ী শান্তি চাই। সেটা অর্জন করতে হলে রাশিয়াকে অবশ্যই তাদের আগ্রাসন বন্ধ করতে হবে। সেইসঙ্গে ইউক্রেনীয়দের জন্য অবশ্যই টেকসই ও নির্ভরযোগ্য নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে হবে। তা না হলে মিনস্ক চুক্তির মতো করে এ যুদ্ধবিরতি চুক্তি ভেস্তে যাওয়ার শঙ্কা থেকে যাবে। ২০১৪ ও ২০১৫ সালে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে সংঘাত বন্ধের চেষ্টায় মিনস্ক চুক্তি হয়েছিল।
এর আগে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ফরাসি নেতার সঙ্গে আলাপকালে ইউরোপের নিজস্ব সশস্ত্রবাহিনী গঠনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। অন্যদিকে, তুরস্কও অনেকদিন থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ চেয়ে আসছে। সুতরাং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমেরিকার ওপর নির্ভরশীল না হয়ে যদি একক ইউরোপীয় শক্তির উত্থান হয় এবং সেইসঙ্গে তুরস্ক যদি ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) মেম্বারশিপ পেয়ে যায়, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।