দ্য ইকোনোমিস্টের নিবন্ধ
ট্রাম্পের জাতীয়তাবাদী নীতি ভারতের জন্য অভিশাপ নাকি আশীর্বাদ?
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৪:১৫ পিএম
ফাইল ছবি।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাচ্ছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে মোদির সঙ্গে ভালো সম্পর্ক হয়ে উঠেছিল। দ্বিতীয় মেয়াদে এই সম্পর্ক আরও ভালো হয়ে উঠতে পারে বলে আশা করছে ভারতীয়রা।
কিন্তু নরেন্দ্র মোদি এবার যে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন তা একটু আলাদা। কারণ আগের মতো তিনি নিয়মের দ্বারা আবদ্ধ নন। ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ অংশীদারদের ওপর চাপ প্রয়োগের সম্ভাবনা ততটাই বেশি, যতটা তাদের সঙ্গে সহযোগিতা করার সম্ভাবনা। তাই ভারতের কূটনীতিকরা যতটা মনে করেন তার চেয়ে বেশি দ্বন্দ্ব দেখা দিতে পারে। বাণিজ্য এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। এছাড়া অভিবাসন, প্রতিরক্ষা ও প্রযুক্তি নিয়ে নতুন উত্তেজনা তৈরি হতে পারে।
দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক দ্বিদলীয় বিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত। চীনের বিরুদ্ধে একে অপরের সুরক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের একে অপরের প্রয়োজন। ২০২০ সালে চীন ও ভারতের মধ্যে এক মারাত্মক সীমান্ত সংঘর্ষ দিল্লিকে ওয়াশিংটনের দিকে ঠেলে দিয়েছে। গত দশকে মোট বাণিজ্য দ্বিগুণ হয়ে ২০২৪ সালে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। আমেরিকান সংস্থাগুলো ভারতে এক দশমিক ৭ মিলিয়ন কর্মী নিয়োগ করেছে। ৫ মিলিয়ন ভারতীয়-আমেরিকান প্রবাসীদের দ্বারা মার্কিন অর্থনীতি উপকৃত হচ্ছে, যাদের মধ্যে ৮০ শতাংশ কলেজ ডিগ্রিধারী। ভারতীয় বংশোদ্ভূত কর্মকর্তারা অ্যালফাবেট ও মাইক্রোসফটের মতো প্রতিষ্ঠানে নেতৃত্ব দিচ্ছে।
থিংক-ট্যাংক প্রতিষ্ঠান ইউরোপীয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ট্রাম্পের নির্বাচনী জয়কে ভারতীয়রা স্বাগত জানিয়েছে, তাদের মধ্যে ৮৪ শতাংশ বিশ্বাস করেন যে তিনি ভারতের জন্য ইতিবাচক হবেন। তা অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় সর্বোচ্চ।
ট্রাম্প মানবাধিকার বিষয়ে উদারনৈতিক পরামর্শ প্রদানেও আগ্রহী নন, যা দীর্ঘদিন ধরে ভারতের অভিজাতদের বিরক্ত করে আসছে। ১০ ফেব্রুয়ারি ট্রাম্প ফরেন করাপ্ট প্র্যাকটিসেস অ্যাক্টের প্রয়োগ স্থগিত করে একটি নির্বাহী আদেশে সই করেছেন। মূলত এই আইনের অধীনে বিলিয়নিয়ার ও মোদীর সহযোগী গৌতম আদানি মার্কিন আদালতে অভিযোগের মুখোমুখি হয়েছিলেন।
তবুও আমেরিকার অতি জাতীয়তাবাদী মনোভাব ও নিজেদের সীমানার মধ্যে অর্থনৈতিক কর্যক্রমে আকর্ষণ করার আকাঙ্ক্ষা ভারতের ওপর চাপ তৈরি করতে পারে। অন্যদিকে ভারত নিজেদেরকে পুরোপুরি স্বাধীন মিত্র ও দেশের অভ্যন্তরেই উৎপাদন ঘাঁটি বানাতে চায়।
মূলত সমস্যা হলো বাণিজ্য। ট্রাম্প তার প্রথম মেয়াদে ভারতের অগ্রাধিকারমূলক-বাণিজ্য-অংশীদার মর্যাদা বাতিল করেন। যার মাধ্যমে অল্প শুল্ক বা জিরো শুল্ক সুবিধা দেওয়া হয়। তিনি নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে ভারতের ইরানি তেল আমদানিও নিয়ন্ত্রণ করেন এবং ভারতীয় ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর শুল্ক বৃদ্ধি করেন। বাণিজ্য নিয়ে যেকোনো বিরোধ এড়াতে মোদি এরই মধ্যে ছাড় দিচ্ছেন। ১ ফেব্রুয়ারি ভারতের বাজেটে পণ্যের তালিকার ওপর শুল্ক কমানো হয়েছে। মোদির সফরের আগে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের ভারতীয় আমদানিকারকরা মার্কিন সরবরাহকারীদের কাছ থেকে ক্রয়ের জন্য আলোচনা করছেন।
যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ অভিবাসীদের নিয়েও উত্তেজনা বিরাজ করছে। হাজার হাজার ভারতীয় অবৈধভাবে দেশটিতে বসবাস করছেন। যদিও এরই মধ্যে শুরু হয়েছে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া। তবে অবৈধ ভারতীয়দের ফেরত পাঠানোর ধরন নিয়ে ভারতের অভ্যন্তরে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। বাণিজ্যের মতো মোদি এক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্রকে সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তবে অবৈধ অভিবাসীদের নিয়ে রাজনৈতিক সংঘাত বৈধ প্রবাহকে ব্যাহত করতে পারে, বিশেষ করে ভারতের প্রযুক্তিসেবা শিল্পের সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তিদের। ২০২২ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এইচ-১বি দক্ষ কর্মী ভিসা দেওয়া বিদেশিদের মধ্যে প্রায় ৭২ শতাংশ ছিল ভারতীয়।
অন্যদিকে ভারত তাদের প্রতিরক্ষা সরঞ্জমের ক্ষেত্রে অনেকটাই রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল। তাই তাদের মস্কো নির্ভরশীলতা কমাতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
ভারতের উৎপাদন বৃদ্ধিতে সাহায্য করার সম্ভাবনা ট্রাম্পের অনেক কম। এরই মধ্যে তিনি মোদিকে আরও আমেরিকান সরঞ্জাম কিনতে অনুরোধ করেছেন। ট্রাম্প ভারতের একাধিক অংশীদারের সঙ্গে জড়িয়ে থাকার মতবাদের প্রতি ধৈর্য হারিয়ে ফেলতে পারেন। তাছাড়া তিনি ভারতকে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে নিরাপত্তা অংশীদারত্ব জোরদার করার জন্য চাপ দিতে পারেন।
অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো প্রযুক্তি। ভারত অনেক ক্ষেত্রেই আমেরিকার সঙ্গে একমত। যেমন ভারতীয় টেলিকম নেটওয়ার্ক থেকে হুয়াওয়ের সরঞ্জাম অপসারণের জন্য পদক্ষেপ নিয়েছে এবং অ্যামাজন, অ্যাপল ও অন্যান্য সিলিকন ভ্যালি জায়ান্টদের কাছ থেকে বড় বিনিয়োগ আকর্ষণ করেছে।
কিন্তু ভারতের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো নিজস্বভাবে একটি প্রধান প্রযুক্তি খেলোয়াড় হওয়া। মোদি সরকার একটি ভারতীয় বৃহৎ ল্যাংগুয়েজ মডেল তৈরিতে তহবিল সংগ্রহ করতে চায় ও সেমিকন্ডাক্টর প্ল্যান্টে ভর্তুকি দিচ্ছে। মূলত ভারত নিজস্ব ডিজিটাল প্রযুক্তিতে নজর দিচ্ছে। তবে ট্রাম্পের জাতীয়তাবাদী নীতি মোদির এই উচ্চাকাঙ্খায় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।