ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের নাম পরিবর্তন নিয়ে এতো সমালোচনা কেন?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৩:০০ পিএম
-67a48addea18e-67ac631d47bd3.jpg)
সাম্প্রতি প্রায় নিঃশব্দেই নাম পরিবর্তন হয়ে গেল ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের। গত বছর ডিসেম্বর নাগাদ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নির্মিত ২৫০ বছর পুরনো দুর্গটির নাম বদলে রাখা হয়েছে ‘বিজয়’ দুর্গ। আরব সাগরের তীরে মহারাষ্ট্রের এক প্রাচীন স্থান, যার ছত্রে ছত্রে জড়িয়ে নানা উত্থান-পতনের ইতিহাস।
নরেন্দ্র মোদি প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্তারা জানান, ঔপনিবেশিক শাসনের ইতিহাসকে মুছে ফেলাই উদ্দেশ্য। কিন্তু ইংরেজ শোষণের ইতিহাস মুছতে গিয়ে অন্য এক শোষণের ইতিহাস মনে করিয়ে দিল না তো এই নাম?
এ বিষয়ে হিন্দুস্তান টাইমসের সঙ্গে কথা বলেছেন ভারতের খ্যাতানামা ইতিহাসবিদ কিংশুক চট্টোপাধ্যায়।
এক অত্যাচার ভুলতে অন্য অত্যাচার?
‘বাংলায় বর্গি আক্রমণের ভয়াবহ ইতিহাস এখনো প্রবীণদের মুখের ছড়া দগদগে স্মৃতির মতো বয়ে বেড়ায়। সেই বর্গি তো আদতে মারাঠারাই। তাদের দীর্ঘ দুই দশকের শোষণ, অত্যাচার অন্যান্য শাসকদের শোষণের ইতিহাসের মতোই অমলিন। ‘বিজয়’ দুর্গ নামকরণ পুরনো ইতিহাসকে ভুলতে অন্য এক শোষণের ইতিহাস চাপিয়ে দেয় বাংলার ওপর।’
‘বর্গি এলো দেশে’
‘অষ্টাদশ শতকের তৃতীয় ও চতুর্থ দশকে বাংলার তৎকালীন চিত্র কিছুটা তুলে ধরা যাক। মুঘল আমলে গোটা দেশে তখন রাজনৈতিক স্থিতাবস্থা। কিন্তু আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর সেই স্থিতাবস্থায় ভাঙন ধরতে শুরু করে। মুঘলদের বিরোধী শক্তি হিসেবে নতুন যেসব শক্তি উঠে আসতে শুরু করল, তার মধ্যে অন্যতম মারাঠা। মারাঠারা তাদের আধিপত্য বিস্তারের জন্য বরাবরই ‘চৌথ’ নামের কর চাপাত। যে অঞ্চলে এই কর চাপানো হবে, সেখানে উৎপাদিত ফসল তারা এক-চতুর্থাংশ নিয়ে যাবে। বিনিময়ে তারা সেই অঞ্চলে কোনো লুঠতরাজ চালাবে না। এইভাবেই রাজস্ব ব্যবস্থা আরোপিত হত। একে নিছক লুন্ঠন বলা যায় না। মারাঠাদের আধিপত্য সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে বাংলায়।’
মারাঠাজাতি হিন্দুদের গৌরব?
কিংশুক চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘মুর্শিদকুলি খাঁর রাজত্বের অবসানের পর ক্ষমতায় এলেন আলিবার্দি খাঁ। বাংলার টালমাটাল রাজনৈতিক অবস্থার অবসান হল। আলিবার্দি খাঁ অত্যন্ত সুচারভাবে মারাঠা আক্রমণ প্রতিহত করেন। ১৭৪৩ সালে মারাঠা আক্রমণের প্রধান নেতা ভাস্কর পণ্ডিতকে হত্যা করা হয়। এই ঘটনার পর শেষমেশ ১৭৫১ সালে বাংলায় মারাঠা আক্রমণ বন্ধ করতে সমর্থ হন।
‘তবে বন্ধ হওয়ার আরেকটি কারণও উল্লেখ করা জরুরি। মারাঠা যেখানে যেখানে তারা আধিপত্য বিস্তার করতে পারত না, সেখানে বৃথা সমরশক্তি ব্যয় করত না। বাংলায় বিফল হয়ে সে সময় তারা এগিয়ে যায় উত্তর ভারতের দিকে। সারা দেশ তখন মারাঠা নামে কম্পমান। তাদের ঠেকাতে উত্তর ভারত জুড়ে একাধিক ক্ষমতা সংগঠিত হয়। নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন আহমেদ শাহ আবদালি।’
তার ভাষ্য, পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে মারাঠারা সম্পূর্ণরূপে বিপর্যস্ত হয়। ১৭৬১ সাল তখন। আজ মারাঠা জাতিকে হিন্দুদের গৌরব হিসেবে তুলে ধরার একটা প্রবণতা দেখা দিয়েছে। কিন্তু মারাঠা আক্রমণ যেখানে যেখানে হয়েছে, সেসব জায়গায় হিন্দু, মুসলমান সমানভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে এই নামকরণকে হিন্দুত্বের বিজয়-নিশান হিসেবে দেখাও অনেকাংশে অনৈতিহাসিক।’
ইতিহাস বিকৃত করা সহজ
এই ইতিহাসবিদ বলছেন, ‘নামকরণের মধ্যে দিয়ে ইতিহাস বিকৃত করা বা মুছে ফেলার এই প্রবণতা কতটা সঙ্গত ও সার্থক শেষমেশ? এই মৌলিক প্রশ্নের দিকে এবার তাকানো যাক। ভারতে ঔপনিবেশিক শাসনের ইতিহাস দীর্ঘ। প্রশাসনের ওপরতলার কর্মকর্তাদের যুক্তি, সেই ছাপ মুছে ফেলতেই নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। কলকাতা ও কলকাতার সংস্কৃতিজুড়ে ঔপনিবেশিকতার এক মস্ত প্রভাব রয়েছে। তাহলে কী কলকাতার নামও পাল্টে দেওয়া প্রয়োজন এবার’?
তিনি বলছেন, শুধু নাম পরিবর্তন করলেই কি শহরের চরিত্র ও ইতিহাস বদলে ফেলা যায়? ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ বর্তমানে ভারতীয় সেনাদের ইন্টার্ন কম্যান্ড হেডকোয়ার্টার হিসেবে পরিচিত। কলকাতার ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির সঙ্গে আদ্যাপান্ত প্রশাসনিক ভবনটির যোগাযোগ আদৌ কি গভীর? সেদিক থেকে এই নামপরিবর্তন ‘ছাপ মোছার চেষ্টা’র সার্থকতা তো দূর, যর্থাথতা নিয়েই প্রশ্ন তুলে দেয়।
কিংশুক চট্টোপাধ্যায় বলেন, ঔপনিবেশিক শাসন দেশের যথেষ্ট ক্ষতি করেছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু নামপরিবর্তন করলেই তার প্রতিকার হবে বলে যদি কেউ মনে করেন, তাহলে কি ইতিহাসের মূল্যায়ন যথাযথ হল? ইতিহাস লেখা ভারি শক্ত, বরং বিকৃত করা সহজ। ছাপ মোছার এই উদ্যোগ বিকৃতিকেই প্রশ্রয় দেয়।’