যে কারণে ইরানকে এত ভয় ট্রাম্পের

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৭:৫৩ পিএম

ডোনাল্ড ট্রাম্পের আগের আমলে ইরাকে মার্কিন হামলায় নিহত হন ইরানি কমান্ডার কাসেম সোলাইমানি। এরপর থেকেই ট্রাম্প আশঙ্কা করছেন, ইরান যে কোনোভাবে তাকে হত্যার চেষ্টা করতে পারে।
লেখক অ্যালেক্স আইজেনস্ট্যাড তার ট্রাম্পকে নিয়ে লেখা ‘রিভেঞ্জ: দ্য ইনসাইড স্টোরি অব ট্রাম্পস রিটার্ন টু পাওয়ার’ বইয়ে এমনই দাবি করেছেন।
বইটিতে মার্কিন কর্তৃপক্ষ ইরানের সম্ভাব্য হামলা নিয়ে কতটা উদ্বিগ্ন ছিল এবং বিষয়টি ট্রাম্পকে কিভাবে প্রভাবিত করেছিল, সেই সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম অ্যাক্সিওসে আইজেনস্ট্যাড লিখেছেন, ২০২৪ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণার সময় ডোনাল্ড ট্রাম্পকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। এটা সবাই জানেন।
আইজেনস্ট্যাডের দাবি, এ হামলার পেছনে ইরানের হাত ছিল। জনসমক্ষে ইরানের হুমকি সবাই যতটা ধারণা করে, বাস্তবে এই হুমকি আরও বেশি ও গুরুতর। এই হুমকি মোকাবিলায় ট্রাম্পের দল বেশ কিছু ব্যতিক্রমী সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়েছিল। যার মধ্যে একটি ছিল ছদ্মবেশী বিমান ব্যবহার করা, যাতে সম্ভাব্য হামলা প্রতিহত করা যায়।
ইরানি হুমকি এখনো ট্রাম্পের মাথায় ঘুরছে। যার ইঙ্গিত মেলে গত সপ্তাহে তার এক বক্তব্য থেকেই।
ট্রাম্প বলেন, যদি ইরানি গোয়েন্দারা তাকে ‘হত্যার চেষ্টা করে’, সেক্ষেত্রে তিনি তার প্রশাসনকে ইরানকে ‘সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস’ করার নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন।
পরে অবশ্য ট্রাম্প তার এই বক্তব্য খানিকটা সংশোধন করে বলেন, তিনি ইরানের সঙ্গে একটি ‘নিশ্চিত পারমাণবিক শান্তিচুক্তি’ চান।
আইজেনস্ট্যাড দাবি করেন, ইরান ২০২০ সাল থেকেই ট্রাম্পকে লক্ষ্যবস্তু করে চলেছে। কারণ সেই বছরেই ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট থাকাকালে তার নির্দেশে এক বিমান হামলায় ইরানের শীর্ষ সামরিক নেতা কাসেম সোলাইমানি নিহত হন।
ট্রাম্পের দল আশঙ্কা করেছিল যে, ইরানিরা তার ব্যক্তিগত বিমানে হামলা চালাতে পারে। গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর ফ্লোরিডার ওয়েস্ট পাম বিচে ট্রাম্পের গলফ কোর্সে তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালানো হলে এই উদ্বেগ আরও বেড়ে যায়।
অবশ্য আইজেনস্ট্যাড স্বীকার করে নিয়েছেন, এ ঘটনায় ইরানের জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ নেই। একইভাবে এ ঘটনার ঠিক দুই মাস আগে পেনসিলভানিয়ায় ট্রাম্পের ওপর হামলার ঘটনায়ও ইরানের জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ নেই। এ হামলায় অবশ্য ট্রাম্পের কানের একটি অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
তবে ফ্লোরিডার ঘটনার পরপরই ট্রাম্পের নিরাপত্তা দল এতটাই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে যে, তারা ট্রাম্পকে একটি ছদ্মবেশী বিমানে ভ্রমণের ব্যবস্থা করে। এই বিমানটি ছিল তার বন্ধু ও রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী স্টিভ উইটকফের। এই উইটকফই বর্তমানে ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক দূত।
তখন ট্রাম্পের ব্যক্তিগত বিমান ‘ট্রাম্প ফোর্স ওয়ানে’ তার প্রচারাভিযানের বেশিরভাগ স্টাফদের তোলা হতো। আর ট্রাম্প উঠতেন উইটকফের বিমানে। এই বিষয়টি ট্রাম্পের অনেক সহযোগীকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। কারণ, তারা ভয় পাচ্ছিলেন, যদি ওই বিমানে হামলা হয়, তবে তারা মারা যেতে পারেন।
প্রচারাভিযানের দুই প্রধান ব্যবস্থাপক সুজি ওয়াইলস (যিনি এখন হোয়াইট হাউসের চিফ অব স্টাফ) ও ক্রিস লাসিভিটা নিরাপত্তার স্বার্থে আলাদা হয়ে যান। ওয়াইলস ট্রাম্পের সঙ্গে উইটকফের বিমানে ওঠেন, আর লাসিভিটা থাকেন ট্রাম্প ফোর্স ওয়ানে।
তবে অনেকেই এ বিষয়ে অবগত ছিলেন না। কিছু সহকারী বিমান উড্ডয়নের ঠিক আগে বুঝতে পারেন যে, ট্রাম্পের নির্ধারিত জানালার আসনটি খালি পড়ে আছে। লাসিভিটা তখন সবাইকে বলেন, বস আজ আমাদের সঙ্গে যাচ্ছেন না। তাকে অন্য এক বিমানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এটি ভবিষ্যতে এমন পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার একটি পরীক্ষামূলক পদক্ষেপ মাত্র।
প্রচারাভিযানের শীর্ষ নেতারা আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেন, ট্রাম্পের দল ইরানি হামলার টার্গেট হচ্ছে না; তবে যেহেতু শত্রুর কাছে ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র থাকার শঙ্কা ছিল, অনেকেই ভাবতে বাধ্য হন, তাহলে তাদের কেনো এ বিমানে তোলা হলো?
সেই ফ্লাইটের অভিজ্ঞতা ছিল যেন এক বিভীষিকা। সেখানে অনেক সহকর্মী একে অন্যের সঙ্গে রসিকতা করছিলেন, কিন্তু ভেতরে-ভেতরে চরম আতঙ্কিত ছিলেন। পরে ট্রাম্পের তিন সহযোগী আইজেনস্ট্যাডকে বলেন, ‘ব্যাপারটা ছিল ভয়ংকর, আমরা বুঝতে পারছিলাম, এটা সত্যিই গুরুতর ঘটনা।’
১৮ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের লং আইল্যান্ডে এক সমাবেশের পর সিক্রেট সার্ভিস ট্রাম্পের প্রচারাভিযানের নেতাদের সতর্ক করে দেয়, তারা গোয়েন্দা তথ্য পেয়েছে- ট্রাম্পের গাড়িবহরে হামলা চালানোর পরিকল্পনা থাকতে পারে। লাসিভিটা তখন ঠাট্টার সুরে ট্রাম্পের সোশ্যাল মিডিয়া প্রধান ড্যান স্কাভিনোকে বলেন, গাড়ির জানালা দিয়ে মাথা বের করে ছবি তুলতে যেও না। কারণ তুমি তখন একেবারেই টার্গেট হয়ে যাবে।
ট্রাম্পের প্রচারাভিযানের সদস্যরা জানান, ট্রাম্প ইরানি হুমকি নিয়ে জনসমক্ষে যতটা হালকাভাবে কথা বলতেন, বাস্তবে তিনি এর চেয়ে অনেক বেশি উদ্বিগ্ন ছিলেন। সমাবেশে তিনি প্রায়ই সোলাইমানিকে হত্যার বিষয়ে গর্ব ভরে বলতেন; কিন্তু যখন ইরানের হুমকি প্রকট হয়ে ওঠে, তখন সহকারীরা লক্ষ্য করেন, তিনি এ বিষয়ে কম কথা বলতে শুরু করেছেন।
ব্যক্তিগতভাবে, ট্রাম্প তার নির্বাচনী প্রচারের সমাবেশগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে বেশি চিন্তা করতে থাকেন। একপর্যায়ে তিনি ভাবতে থাকেন, ভোটাররা কি চার বছর ধরে এ ধরনের হত্যাচেষ্টার শঙ্কা সহ্য করতে চাইবে?
জনগণ সহ্য করবে কিনা, সেটাই এখন দেখার বিষয়। আইজেনস্ট্যাডের বক্তব্য যদি সঠিক হয়, তাহলে এটি স্পষ্ট যে, ট্রাম্প ইরানের ভয়ে ব্যাপকভাবে ভীত। আর যেহেতু তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েই গেছেন, আগামী চার বছর মার্কিন জনগণকে ট্রাম্পের হত্যাচেষ্টার শিকার হওয়ার যে শঙ্কা, সেটি মেনে নিতেই হবে।