কেন সামরিক শক্তির সঙ্গে বেসামরিক প্রতিরক্ষাও জোরদার করছে নর্ডিক দেশগুলো
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:২৯ পিএম
ছবি : সংগৃহীত
ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধ বাল্টিক অঞ্চলের নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে আরও উত্তেজনাপূর্ণ করে তুলেছে। এ অবস্থায় নিজেদের জরুরি প্রস্তুতির নির্দেশিকা হালনাগাদ করার পদক্ষেপ নিয়েছে নর্ডিক দেশগুলো।
রাশিয়ার আক্রমণের শিকার হওয়ার আশঙ্কা দীর্ঘদিন ধরেই করে আসছে সুইডেন, ফিনল্যান্ড ও নরওয়ে। সেই আশঙ্কা থেকে দেশগুলো সম্প্রতি তাদের সামরিক শক্তি ও প্রতিরক্ষা বাজেট বৃদ্ধি করেছে। সেই সঙ্গে ফিনল্যান্ড ও সুইডেন ন্যাটোতে যোগদানের জন্য উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিয়েছে।
তবে যুদ্ধে কেবল সামরিক সক্ষমতাই একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। নাগরিক প্রতিরক্ষা এবং নাগরিকদের যুদ্ধকালীন জরুরি অবস্থার দিকেও বাড়তি নজর দিতে হয়। যার জন্য নিজেদের প্রস্তুত রাখারও প্রয়োজন মনে করছে দেশগুলো।
ফিনল্যান্ড, সুইডেন এবং নরওয়ে তাদের নাগরিকদের জন্য প্রস্তুতি নির্দেশিকা হালনাগাদ করে তা নাগরিকদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। ফিনল্যান্ড নির্দেশিকার ডিজিটাল কপি প্রকাশ করেছে। নরওয়ে এবং সুইডেন বাসাবাড়িতে নির্দেশাবলীর ছাপা কপি পাঠাচ্ছে।
এই নির্দেশিকায় চরম দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া, মহামারি এবং সম্ভাব্য সংঘাত পরিস্থিতির কথা বলা হয়েছে। এছাড়াও বেশ কয়েকটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এক সপ্তাহের প্রয়োজনীয় জল এবং খাদ্যের সঞ্চয় রাখা, স্থানান্তরের সময় কী আচরণ করতে হবে এবং বিদ্যুৎ বিপর্যয় কিভাবে মোকাবিলা করা যায়, এসব বিষয়ে বলা হয়েছে সেই নির্দেশিকায়।
ফিনল্যান্ডের নির্দেশিকার শিরোনাম দেওয়া হয়েছে ‘ঘটনা এবং সংকটের জন্য প্রস্তুতি'। নরওয়ের নির্দেশিকার শিরোনাম ‘কীভাবে আপনি নরওয়ের জরুরি প্রস্তুতিতে নিজের ভূমিকা পালন করতে পারেন।'
অন্যদিকে সুইডেনের নির্দেশিকার শিরোনামে সংঘাতের আশঙ্কার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। ‘সংকট বা যুদ্ধের ক্ষেত্রে' শিরোনামের নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, বিশ্বের নানা প্রান্তে যখন সশস্ত্র সংঘাত চলছে, এমন অনিশ্চিত সময়ে সন্ত্রাসবাদ, সাইবার আক্রমণ এবং বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণার মাধ্যমে সুইডেনকে দুর্বল ও প্রভাবিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
সুইডেনের নির্দেশিকায় আরও বলা হয়েছে, আমাদের অবশ্যই ঐক্যবদ্ধভাবে এই হুমকিগুলো মোকাবিলা করতে হবে, সুইডেন আক্রান্ত হলে প্রত্যেককে অবশ্যই সুইডেনের স্বাধীনতা এবং আমাদের গণতন্ত্র রক্ষার জন্য ভূমিকা পালন করতে হবে।
সুইডিশ সিভিল কন্টিনজেন্সি এজেন্সির মহাপরিচালক মিকায়েল ফ্রিসেল এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছেন, দেশের জাতীয় নিরাপত্তা পরিস্থিতি ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়েছে এবং বিভিন্ন সংকট ও যুদ্ধের সময়ে প্রতিরোধ জোরদার করতে হবে।
সুইডেন ২০১০ সালে বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণের নিয়ম স্থগিত করেছিল। কিন্তু ২০১৭ সালে তা আবার চালু করা হয়েছে। ফিনল্যান্ড এবং নরওয়েতে কয়েক দশক ধরে বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ চালু রয়েছে।
বেসামরিক প্রতিরক্ষার দীর্ঘ ইতিহাস
নর্ডিক দেশগুলোর জন্য জরুরি অবস্থার প্রস্তুতি নতুন কিছু নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং স্নায়ু যুদ্ধের সময়কার এই নির্দেশিকাগুলো আগে থেকেই চালু রয়েছে এবং নতুন পরিস্থিতে সেগুলো কেবল হালনাগাদ করা হয়েছে।
ফিনল্যান্ডের বেসামরিক প্রস্তুতি বিষয়ক পরিচালক জুসি কোরহোনেন জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলে’কে বলেছেন, ফিনল্যান্ড বা স্ক্যান্ডিনেভিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর ওপর সরাসরি সামরিক হুমকি না থাকলেও বৈশ্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি আরও অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। ফলে কী ঘটবে সে বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করাও কঠিন হয়ে উঠেছে। এই কারণেই এই প্রস্তুতির নির্দেশিকাগুলো হালনাগাদ রাখা গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বলেন, জনগণকে প্রস্তুত করে তুলতে অনেকটা সময় লাগে। এটা একটা প্রকল্পের বিষয় নয়। এটা এমন একটা প্রক্রিয়া যেখানে বিভিন্ন ধরণের ঘটনা মোকাবিলার জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ প্রস্তুতি থাকতে হবে।
এরইমধ্যে ফিনল্যান্ডের প্রায় চার লাখ মানুষ নির্দেশিকা ডাউনলোড করেছেন। কোরহোনেনের মনে করেন, ফিনল্যান্ডের ৬০ শতাংশ মানুষ এরই মধ্যে প্রস্তুত এবং তিন দিনের খাবার ও জলের মতো জরুরি পণ্য তারা সংগ্রহ করে রেখেছেন।
তিনি বলেন, আমাদের উদ্দেশ্য হলো বাকি ৪০ শতাংশ বাড়িও যাতে জরুরি সরবরাহ সংগ্রহে রাখে, সে ব্যবস্থা করা।
একটি গবেষণার কথা উল্লেখ করেছেন কোরহোনেন, যেখানে দেখা গেছে যে দেশটির গ্রামে বসবাসকারী মানুষ জরুরি অবস্থার জন্য সবচেয়ে ভাল প্রস্তুত হলেও তরুণ প্রাপ্তবয়স্করা সে তুলনায় সবচেয়ে কম প্রস্তুত।
সুইডেনের মানুষ কতটা প্রস্তুত?
সুইডেনের গোথেনবার্গের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ডেভিড ফার্ম মনে করেন, মানুষের মনে এখনও যুদ্ধের প্রস্তুতি নেই।
ফার্ম ডয়চে ভেলে’কে বলেন, আমি মনে করি, এখনও মানুষের কাছে প্রচারপত্র পৌঁছেনি। একবার সেগুলো পৌঁছোলে একটু বেশি উদ্বেগ সৃষ্টি হবে।
তবে তিনি মনে করেন, কিছুদিন পর মানুষ আবার শান্ত হয়ে যাবে৷ এটা নিয়ে আতঙ্কিত হবে না। ফার্মের মতে, আতঙ্ক তৈরি হোক বা না হোক, সম্ভাব্য পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত হতে সবাইকে তথ্য জানানো উচিত।
সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে একটি স্টার্টআপে কাজ করেন লুডভিগ কার্লবার্গ। তিনিও মনে করেন যুদ্ধের বিষয়টি নিয়ে সুইডেনে বেশিরভাগ মানুষ চিন্তিত নয়।
কার্লবার্গ বলেন, ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধের সঙ্গে মানুষ সুইডেনের কোনো সম্পর্ক খুঁজে পাচ্ছে না৷ এটি আসলে আমাদের জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত ও হুমকির মুখে ফেলছে, এমনটাও মানুষ মনে করে না৷ আমি মনে করি সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে যারা কাজ করেন, এমন নির্দিষ্ট কিছু খাতের মানুষ এ বিষয়ে বেশি সচেতন।
সুইডেনের মানুষ রাশিয়া এবং ইউরোপে যুদ্ধকে ভয় পায়, তবে তারা সংঘাতের ক্ষেত্রে নিজের দেশের অবস্থান নিয়ে অনেকটা ভ্রান্তিকর অবস্থান থেকেই আশাবাদী বলে মনে করেন কার্লবার্গ।
ফিনল্যান্ডের মানুষ যা ভাবছে
রুশ সীমান্তের ফিনিশ শহর ল্যাপেনরান্টায় হুমকিটা বেশি অনুভূত হচ্ছে। শহরের একজন শিক্ষক মারিকা কেসেলি বলেছেন, জরুরি পরিস্থিতির জন্য তিনি এখনও পুরোপুরি প্রস্তুত না হলেও সামরিক সংঘাতের জন্য প্রস্তুত হওয়া গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বলেন, যখন ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরু হয় তখন তিনি অনেক ভয় পেয়েছিলেন এবং এমনকি তার বৈদ্যুতিক গাড়ির পরিবর্তে একটি কমবাশ্চন ইঞ্জিনের গাড়ি চালানোর কথাও ভেবেছিলেন৷
কেসেলি বলেন, আমি একজন শিক্ষক এবং আমরা সাধারণত স্কুলে যুদ্ধের আশঙ্কা নিয়ে কথা বলি না; এটা খুবই ভীতিকর৷ যখন আমরা বন্ধুদের সঙ্গে থাকি তখন মাঝে মধ্যে এটা নিয়ে আলোচনা করি। কিন্তু সীমান্ত থেকে দূরে সরে যাওয়া এবং নতুন কাজ খোঁজার সম্ভাবনা বেশ কঠিন৷ তাই আমরা বিশ্বাস করার চেষ্টা করি যে একদিন এই পৃথিবী আরও শান্তিপূর্ণ হবে।