ছবি: দ্য গার্ডিয়ান
মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যের আরাকান কিংডমের সাবেক রাজধানী ম্রাকউ দখল করে। সেইসঙ্গে মিনবিয়া ও কিউকতাও শহরেরও নিয়ন্ত্রণ নেয় তারা। প্রকৃতপক্ষে ২০২৩ সালের ১৩ নভেম্বর আরাকান আর্মি এবং দেশটির সামরিক জান্তার মধ্যে পুনরায় যুদ্ধ শুরু হয়। এরপর থেকে স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠীটি সফলভাবে রাজ্যের বেশ কয়েকটি শহর দখল করেছে। সেইসঙ্গে পার্শ্ববর্তী দক্ষিণ চিন রাজ্যের দুটি শহরও দখল করেছে আরাকান আর্মি। এছাড়া সামরিক জান্তার বেশ কিছু নৌযান এবং হেলিকপ্টার ধ্বংস করেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, একটি স্বাধীন আরাকান প্রতিষ্ঠার জন্য রাখাইন জাতীয়তাবাদীদের দীর্ঘদিনের যে স্বপ্ন, আরাকান আর্মির অব্যাহত এই বিজয়গুলো সেই স্বপ্নকে খুব কাছ থেকে হাতছানি দিচ্ছে।
১৭৮৫ সালে বার্মিজ মান্দালে কিংডমের কাছে আরাকান রাজত্বের পতন ঘটে। দীর্ঘ এই সময়ে বার্মিজ শাসকদের বিরুদ্ধে অসংখ্য বিদ্রোহ ও অভ্যুত্থান হয়েছে। কিন্তু এই প্রথমবারের মতো ম্রাকউ-এর নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম হয়েছে আরাকানিজরা। তাই ৮ ফেব্রুয়ারি সাবেক রাজধানী পুনরুদ্ধারের ঘটনাকে বিজয়ের খুব শক্তিশালী ইঙ্গিত হিসেবে দেখা হচ্ছে।
ব্রিটিশ ও জাপানি দখলদারিত্বের সময়ও রাখাইন রাজ্যের জনগণ ঔপনিবেশিক শক্তিকে তীব্রভাবে প্রতিরোধ করেছিল। ১৯৪৮ সালে গ্রেট ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীন হয় মিয়ানমার। এরপর রাখাইনের জনগণই সর্বপ্রথম কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়। কিন্তু তারপরও সাম্প্রতিক সময়ে আরাকান আর্মির যে অগ্রগতি, তা অতীতের যেকোনো অর্জনকে ছাপিয়ে গেছে৷
২০০৯ সালে মেজর জেনারেল তোয়ান ম্রাট নাইং এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ড. নিয়ো তোয়ান অংয়ের ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বে আরাকান আর্মির উত্থান ঘটে। যা রাজ্যটির জনগণের মধ্যে একটি নতুন আশার সঞ্চার করে। কারণ আরাকান লিবারেশন আর্মি বা আরাকান লিবারেশন পার্টির বর্তমান নেতৃত্ব একটি স্বাধীন আরাকান প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বড় ধরনের কোনো অগ্রগতি দেখাতে পারেনি। চীনা সীমান্তের কাচিন রাজ্যে ২০১৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে আরাকান আর্মি। সেখান থেকে তারা রাখাইন রাজ্যে প্রবেশ করে। এরপর ২০১৬ সালের শেষের দিকে ‘আরাকান ড্রিম ২০২০’ শীর্ষক একটি রাজনৈতিক রোডম্যাপ প্রকাশ করে আরাকান আর্মি; যা ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
‘আরাকান ড্রিম ২০২০’ পরিকল্পনায় পরিষ্কারভাবে বলা হয়- শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে রাখাইন রাজ্যে একটি স্বাধীন ঘাঁটি তৈরি করা হবে, যেখানে থাকবে একটি নিজস্ব প্রশাসনিক ব্যবস্থা। পরিকল্পনায় দেশের ভেতরে ও বাইরে অবস্থান করা রাখাইনের প্রতিটি মানুষকে এই আন্দোলনে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। যার ফলশ্রুতিতে ২০১৮ সালের শেষদিক থেকে ২০২০ পর্যন্ত মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সাথে রাজ্যটিতে দুই বছরের ব্যাপক লড়াই হয়। এতে ব্যাপকহারে বেসামরিক লোক উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়। রাখাইনের শত শত মানুষকে গ্রেপ্তার ও হত্যা করা হয়। উপরন্তু, ২০১৯ সালের জুন থেকে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অংসান সুচির নেতৃত্বাধীন কথিত বেসামরিক সরকারের আরোপিত ইন্টারনেট শাটডাউন সহ্য করতে হয় রাজ্যটির জনগণকে, এটিকে তৎকালীন বিশ্বের দীর্ঘতম ইন্টারনেট শাটডাউন হিসেবে মনে করা হয়।
২০২০ সালের শেষের দিকে আরাকান আর্মি তাদের পরিকল্পনার বিষয়ে একটি কার্যকর চুক্তি সম্পাদন করতে সক্ষম হয়, ফলে এটির নেতৃত্বের প্রতি রাখাইনি জনগণের সমর্থন আরও বেড়ে যায়। তাছাড়া এক দশকের মধ্যে আরাকান আর্মিকে সমর্থন দেয় তাদের রাজনৈতিক শাখা ইউনাইটেড লিগ অফ আরাকান। ফলে এটি মিয়ানমারের সবচেয়ে শক্তিশালী জাতিগত সেনাবাহিনী হিসেবেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়। আরও একটি বিষয় লক্ষণীয়, সেটি হলো- বিদ্যমান অন্যান্য জাতিগত সশস্ত্র সংগঠনের মতো আরাকান আর্মি নতুন সদস্য নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়নি, যা রাখাইন জনগণের মধ্যে এটির ব্যাপক বৈধতারই প্রতিফলন।
গত বছরের নভেম্বরে রাখাইন রাজ্যটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, যখন আরাকান আর্মি দেশটির জান্তা বাহিনীর সাথে করা একটি নড়বড়ে যুদ্ধবিরতি চুক্তি ভঙ্গ করে। এরপর চলতি বছরের জানুয়ারিতে দক্ষিণ চিন রাজ্যের পালেতওয়া ও সামি শহর দখল করে তারা। তারপর একে একে পাউকতাও, মিনবিয়া, ম্রাকউ, কিয়কতাও, মাইবোন এবং উত্তর রাখাইনের তাউং পিও উপশহরের নিয়ন্ত্রণ নেয় আরাকান আর্মি। এছাড়া রামব্রী, কিয়াউকফিউ, পোন্নাগিউন, রাথেডাউং এবং মংডু টাউনশিপ-সহ রাজ্যের আরও অনেক অংশে যুদ্ধে লিপ্ত আরাকান আর্মি। জানুয়ারির শেষদিকে মংডু শহরে লড়াইয়ের সময় জান্তা সরকারের প্রায় ৪০০ সীমান্তরক্ষী বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। এর কিছুদিন আগে জান্তা বাহিনীর কয়েকশ সদস্য ভারতে পালিয়ে যায়।
রাখাইনে চলমান যুদ্ধের প্রতি ক্রমবর্ধমান ফোকাস সত্ত্বেও ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট এবং টেলিযোগাযোগে বিধিনিষেধের কারণে সেখানকার প্রকৃত সত্য ঘটনা নির্ধারণ করা কঠিন। সে যাইহোক, আরাকান আর্মি যেদিন সাবেক রাজধানীর ম্রাউকের দখল নেয়, সেদিন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রাখাইন নেটিজেনরা সোশ্যাল মিডিয়ায় বিজয় উদযাপন করেছিল এবং এটিকে তাদের আরাকান স্বায়ত্তশাসনের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন পূরণের সূচনা হিসেবে উল্লেখ করেছিল।
অবশ্যই এখনও অনেক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। তবে রাখাইন দীর্ঘকাল ধরে জাতিগত উত্তেজনা ও রাজনৈতিক অস্থিরতার একটি অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ রাখাইন এবং রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি অন্যান্য জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত এখানকার বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠী বার্মিজ শাসনের অধীনে বিগত কয়েক দশক ধরে ধারাবাহিকভাবে প্রান্তিকতা ও বৈষম্যের শিকার হয়েছে। উপরন্তু, ২০১৭ সালে উত্তর রাখাইনের রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গণহত্যামূলক ‘জাতিগত নির্মূলকরণ’ অভিযানের কলঙ্ক বহন করছে রাজ্যটি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে পুনরায় শুরু হওয়া চলমান সহিংসতা। যা আগের ক্ষতগুলিকে আরও গভীর করছে এবং ইতোমধ্যেই দেখা দিয়েছে একটি ভয়াবহ মানবিক সংকট।
তবে এত বিশৃঙ্খলা ও হতাশার মধ্যেও সেখানে আশার আলো রয়েছে। আরাকান আর্মির অব্যাহত সামরিক অগ্রগতি রাখাইন ও এর বাসিন্দাদের জন্য একটি ভিন্ন ভবিষ্যতের সম্ভাবনা হাজির করেছে। তবে সম্ভাব্য এই ভবিষ্যত কেমন হতে পারে- সে সম্পর্কে অনিবার্যভাবে কিছু প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। যেমন- আরাকান আর্মি কী ধরনের সমাজ কল্পনা করছে? রোহিঙ্গাসহ রাখাইনের সংখ্যালঘুদের সঙ্গে তারা কেমন আচরণ করবে? অবশ্য কেউ কেউ বলছেন, সামরিক জান্তার পরাজয় না হওয়া পর্যন্ত এমন প্রশ্ন রেখে দেওয়াই উত্তম।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনার জন্য খুব বেশি তাড়াহুড়ো করা যাবে না, আবার খুব বেশি দেরিও করা উচিত নয়। ২০২০ সালের গোড়ার দিকে আরাকান আর্মির শীর্ষ নেতৃত্ব ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে, তারা রাখাইনের জনগণের জন্য একটি সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক স্টেট তথা সামাজিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করছেন। কিন্তু সেটা কি সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে হবে, নাকি মিয়ানমারে সম্ভাব্য নতুন ফেডারেল সরকারের অধীনে হবে- অর্থাৎ গোষ্ঠীটি সামাজিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কোন মডেল অনুসরণ করবে- তা তিনি উল্লেখ করেননি। যদিও এটা অনুমান করা হচ্ছে যে, তারা রাজনৈতিকভাবে একদলীয় ব্যবস্থার দিকে ঝুঁকছে। আবার বর্তমান পরিস্থিতি বলে দিচ্ছে যে, একটি নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে গেলেও তাতে দীর্ঘ প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে।
যাইহোক, রাখাইনের এই নতুন যুগের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে সেখানকার বাসিন্দারাই। চলমান যুদ্ধে প্রতিদিনই নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও তারা স্থিতিশীল ও তাদের নিজেদের ভাগ্য গঠনের ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আরাকান আর্মির নেতৃত্ব তাদের মাঝে সেই নতুন যুগের আশার সঞ্চার করতে সক্ষম হয়েছে। বিচ্ছিন্ন সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে দীর্ঘকালের বিভাজন দূরীকরণের মাধ্যমে হতাশার মধ্যে আশার ঝলক দেখা দিচ্ছে।
কিন্তু তারপরও টেকসই উন্নয়ন ও শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এখনো অনেক বাধা-বিপত্তিতে ভরপুর রাখাইন। এটা যুক্তিসঙ্গত যে, বছরের পর বছর ধরে নিপীড়নের কারণে যেসব ক্ষত গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে, সেটা সহজেই সারানো যাবে না। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক খেলোয়াড়রাও তাদের প্রভাব বিস্তারের জন্য লড়াই করবে। যা সকলকে একমঞ্চে আনার প্রচেষ্টাকে জটিল করে তুলবে। তাছাড়া ভঙ্গুর শান্তি ও রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করার হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে চরমপন্থা। এইসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সকল স্টেকহোল্ডারকে সহযোগিতা ও সংলাপের মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। শান্তি, সমৃদ্ধি এবং মর্যাদার ভবিষ্যত চাওয়া রাখাইনের জনগণের জন্য একদম উচ্চাশা নয়, বরং এটা তাদের অধিকার। তবে এটি অর্জনের জন্য প্রয়োজন সাহসী নেতৃত্ব, অটল প্রতিশ্রুতি এবং পেছনে ফেলে আসা অর্থাৎ অতীতের কঠিন সত্যের মুখোমুখি হওয়ার প্রবল ইচ্ছা।
রাখাইন কিংডমের সাবেক রাজধানী ম্রাকউ দখল যদিও সেখানকার জনগণের মাঝে নতুন আশা দেখিয়েছে, তবে কোনো সন্দেহ নেই যে, আগামী সপ্তাহ কিংবা মাসগুলোতে তারা জান্তা শাসনের আরও নৃশংস কৌশলের মুখোমুখি হবে। হতে পারে সেটা আর্টিলারি শেলিং, বিমান হামলা কিংবা নির্বিচারে গণগ্রেপ্তার অথবা আরও অনেক কিছু।
যাইহোক, রাখাইনের ভাগ্যাকাশে ধীরে ধীরে সূর্য উঠছে এবং দীর্ঘ সংঘাতে ক্ষতবিক্ষত একটি জনপদে তার সোনালি আলো ফেলছে। নতুন যুগের এই আলোকে কাজে লাগিয়ে রাখাইনের জনগণ অতীতের শৃঙ্খল ভেঙে তাদের জন্মভূমিতে একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যত বিনির্মাণ করতে পারবে বলে প্রত্যাশা সকলের।
লেখক: সাংবাদিক