ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাতের নেপথ্যে, একটি সংক্ষিপ্ত পাঠ
প্রকাশ: ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৩৮ পিএম
১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাত্র ৫ মাসের মাথায় জন্মভূমি ছাড়ছেন ফিলিস্তিনিরা। ছবি: আল জাজিরা
ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাতে এখন পর্যন্ত হাজার হাজার মানুষ প্রাণ দিয়েছে। উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষ। এই সংঘাতের গোড়াপত্তন হয় এক শতাব্দীরও বেশি আগে; ঔপনিবেশিক আমলে।
গত বছরের ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের সশস্ত্র গোষ্ঠী তথা স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের নজিরবিহীন এক হামলার পর অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ শুরু করে ইসরাইল। স্বাভাবিক কারণেই বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আবারও তীব্রভাবে নিবদ্ধ হয়েছে পরিস্থিতির দিকে যে, এর পরিণতি কোথায় গিয়ে ঠেকে।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর তথ্য অনুযায়ী, দক্ষিণ ইসরাইলের একাধিক শহরে হামলা চালিয়েছে হামাস যোদ্ধারা। এতে এখন পর্যন্ত ১৪০০ জনের বেশি ইসরাইলি নিহতের খবর পাওয়া গেছে। হামাসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, যুগ যুগ ধরে ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইলি বাহিনীর দমনপীড়ন, পবিত্র আল-আকসা মসজিদের মর্যাদাহানি এবং সাম্প্রতিক সময়ে ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর বসতি স্থাপনকারীদের (সেটলার) হামলার প্রতিশোধ হিসেবে ‘অপরারেশন আল-আকসা ফ্লাড’ শীর্ষক অভিযান চালানো হয়েছে।
অপরদিকে হামাসের হামলার জবাবে ইসরাইল নির্বিচারে গাজা উপত্যকায় বোমা হামলা চালিয়ে আসছে এক বছরের বেশি সময় ধরে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দখলদার বাহিনীর বর্বর হামলায় প্রায় অর্ধ লক্ষ নিরাপরাধ ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন কয়েক লক্ষ মানুষ। হতাহতদের একটি বড় অংশ নারী ও শিশু। জাতিসংঘের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, হতাহতদের প্রায় ৭০ শতাংশ নারী ও শিশু। গত বছরের অক্টোবরে দখলদার বাহিনীর হামলা শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত কয়েক লক্ষ ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। বাছবিচারহীন বিমান হামলায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে ছোট্ট ভূখণ্ড গাজা।
এ ছাড়া পুরো গাজা ভূখণ্ড দখল করে নিতে সীমান্তে কয়েক লাখ সেনা মোতায়েন করেছে ইসরাইল। শুধু তাই নয়, ২০০৭ সাল থেকে অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ‘সর্বাত্মক অবরোধ’ তথা খাদ্য, পানি, জ্বালানি এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে দখলদার রাষ্ট্রটি, যা আন্তর্জাতিক আইনে যুদ্ধাপরাধের শামিল।
তবে আগামী দিন কিংবা সপ্তাহগুলোতে কী ঘটবে- তা এই সংঘাতের ইতিহাসেই নিহিত রয়েছে।
বিগত কয়েক দশক ধরে পশ্চিমা মিডিয়া আউটলেট, শিক্ষাবিদ, সামরিক বিশেষজ্ঞ এবং বিশ্ব নেতারা ইসরাইল-ফিলিস্তিনি সংঘাতকে একটি জটিল, কঠিন ও অচলাবস্থা হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
বিশ্বের দীর্ঘতম চলমান দ্বন্দ্বগুলোর অন্যতম এটি। নিম্নে সংক্ষেপে এই সংঘাতের স্বরূপ উদঘাটনে একটি সহজ ও সংক্ষিপ্ত ঘটনাপুঞ্জি তুলে ধরা হলো।
বেলফোর ঘোষণা কী?
১০০ বছরেরও বেশি আগে অর্থাৎ ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর ব্রিটেনের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার বেলফোর ব্রিটিশ ইহুদি সম্প্রদায়ের একজন শীর্ষ ব্যক্তিত্ব লিওনেল ওয়াল্টার রথচাইল্ডকে সম্বোধন করে একটি চিঠি লেখেন।
ছোট্ট ওই চিঠিটি ছিল মাত্র ৬৭ শব্দের; কিন্তু এর বিষয়বস্তু ফিলিস্তিনিদের উপর সুদূরপ্রসারী যে প্রভাব ফেলেছিল, তা আজও অনুভূত হচ্ছে।
চিঠি অনুযায়ী ফিলিস্তিনে ইহুদি জনগণের জন্য একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং সেই লক্ষ্য অর্জন সহজতর করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয় ব্রিটিশ সরকার। ঐতিহাসিক সেই চিঠি বেলফোর ঘোষণা নামে পরিচিত।
মোটকথা একটি ইউরোপীয় শক্তি ইহুদিবাদী আন্দোলনকে এমন একটি দেশের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, যেখানে ফিলিস্তিনি আরব নেটিভরা জনসংখ্যার ৯০ শতাংশেরও বেশি।
১৯২৩ সালে ব্রিটিশ সরকার একটি ম্যান্ডেট তৈরি করে এবং তা ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল৷ ওই সময়কালে ব্রিটিশ প্রশাসন ব্যাপকভাবে ফিলিস্তিনে ইহুদি অভিবাসনকে সহায়তা করে- এর মধ্যে অনেক বাসিন্দাই ইউরোপে নাৎসিবাদ থেকে পালিয়ে এসেছিল। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও ধর্মঘটও করেছিল ফিলিস্তিনিরা। ফিলিস্তিনিরা তাদের দেশের পরিবর্তিত জনসংখ্যা এবং ব্রিটিশ সরকার তাদের ভূমি বাজেয়াপ্ত করে ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের কাছে হস্তান্তর করায় শঙ্কিত হয়েছিল।
১৯৩০ এর দশকে কী ঘটেছিল?
ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা অবশেষে আরব বিদ্রোহের দিকে পরিচালিত করে, যা ১৯৩৬ থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়।
১৯৩৬ সালের এপ্রিলে নবগঠিত আরব জাতীয় কমিটি ফিলিস্তিনিদেরকে একটি সাধারণ ধর্মঘট শুরু করার, ট্যাক্স প্রদান বন্ধ করার এবং ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ ও ক্রমবর্ধমান ইহুদি অভিবাসনের প্রতিবাদে ইহুদি পণ্য বয়কট করার আহ্বান জানায়।
ছয় মাসের ধর্মঘট কঠোরভাবে দমন করে ব্রিটিশরা। তারা ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে গণগ্রেফতার অভিযান শুরু করেছিল এবং ‘শাস্তিস্বরূপ’ বাড়িঘর ধ্বংস করেছিল। এটি ছিল এমন একটি পদক্ষেপ; যা ইসরাইল আজও ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করে চলেছে।
বিদ্রোহের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয়েছিল ১৯৩৭ সালের শেষের দিকে। ব্রিটিশ বাহিনী এবং উপনিবেশবাদকে লক্ষ্য করে গড়ে উঠা এই প্রতিরোধ আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন ফিলিস্তিনি কৃষকরা।
১৯৩৯ সালের দ্বিতীয়ার্ধে ব্রিটেন ফিলিস্তিনে ৩০ হাজার সৈন্য জড়ো করেছিল। গ্রামগুলোতে বিমান থেকে বোমাবর্ষণ করা হয়, কারফিউ জারি করা হয়, বাড়িঘর ভেঙ্গে দেওয়া হয় এবং প্রশাসনিক আটক ও হত্যা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
ব্রিটিশরা ইহুদি বসতি স্থাপনকারী সম্প্রদায়কে একযোগে সহযোগিতা এবং সশস্ত্র দল গঠন করে। ব্রিটিশ নেতৃত্বাধীন ইহুদি যোদ্ধাদের এমনই একটি ‘বিদ্রোহ দমন বাহিনী’ হলো স্পেশাল নাইট স্কোয়াড।
ইশুভের (একটি জাতীয় মুক্তি আন্দোলন যা ফিলিস্তিনে একটি স্বাধীন ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করে) অধীনে প্রাক-রাষ্ট্রীয় বসতি স্থাপনকারী সম্প্রদায়ের মধ্যে গোপনে অস্ত্র আমদানি করা হয় এবং হাগানাহকে (ইহুদিবাদী সামরিক সংস্থা) সম্প্রসারণের জন্য অস্ত্র কারখানা স্থাপন করা হয়। পরবর্তীতে এই আধাসামরিক বাহিনীই ইসরাইলের মূল সেনাবাহিনীতে পরিণত হয়।
এই তিন বছরের বিদ্রোহে ৫ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়। আহত হয় ১৫ হাজার থেকে ২০ হাজার। এ ছাড়া বন্দি হয় ৫ হাজার ৬০০।
জাতিসংঘের বিভাজন পরিকল্পনা কী ছিল?
১৯৪৭ সালের মধ্যে ফিলিস্তিনে ইহুদি জনসংখ্যার হার দাঁড়াল ৩৩ শতাংশে, কিন্তু তারা মাত্র ৬ শতাংশ জমির মালিক ছিল।
জাতিসংঘে ১৮১ নম্বর রেজ্যুলেশন (প্রস্তাব) গৃহীত হয়, যা ফিলিস্তিনকে আরব ও ইহুদি রাষ্ট্রে বিভক্ত করার আহ্বান জানায়।
ফিলিস্তিনিরা এই পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করেছিল; কারণ এতে প্যালেস্টাইনের প্রায় ৫৫ শতাংশ ভূমি ইহুদি রাষ্ট্রকে বরাদ্দ করা হয়, যার মধ্যে বেশিরভাগ উর্বর উপকূলীয় অঞ্চল রয়েছে।
অথচ ওই সময় ফিলিস্তিনিরা ঐতিহাসিক প্যালেস্টাইনের ৯৪ শতাংশের মালিক ছিল এবং এর জনসংখ্যার ছিল ৬৭ শতাংশ।
১৯৪৮ সালের নাকবা বা ফিলিস্তিনে জাতিগত নির্মূলকরণ
১৯৪৮ সালের ১৪ মে ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ইহুদিবাদী আধাসামরিক বাহিনী জায়নবাদী রাষ্ট্রের সীমানা সম্প্রসারিত করার জন্য ফিলিস্তিনি শহর ও গ্রাম ধ্বংস করতে সামরিক অভিযান শুরু করে।
একই বছরের এপ্রিলে জেরুজালেমের উপকণ্ঠে দেইর ইয়াসিন গ্রামে ১০০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি পুরুষ, মহিলা এবং শিশুকে হত্যা করা হয়।
এটি বাকি অপারেশনের জন্য শিকড় গেড়েছিল। এরপর ১৯৪৭ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত ৫০০টিরও বেশি ফিলিস্তিনি গ্রাম, নগর এবং শহর ধ্বংস করা হয়েছিল; যাকে ফিলিস্তিনিরা নাকবা বা ‘বিপর্যয়’ হিসেবে উল্লেখ করে।
কয়েক ডজন গণহত্যাসহ আনুমানিক ১৫ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছিল ওই সময়।
ইহুদিবাদী আন্দোলন ঐতিহাসিক প্যালেস্টাইনের ৭৮ শতাংশ দখল করে নেয়। অবশিষ্ট ২২ শতাংশ ভাগ করা হয়েছিল, যা বর্তমানে অধিকৃত পশ্চিম তীর এবং অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকা।
আনুমানিক সাড়ে ৭ লাখ ফিলিস্তিনিকে তাদের বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ করা হয়।
আজ তাদের ৬০ লাখ বংশধর ফিলিস্তিন, লেবানন, সিরিয়া, জর্ডান এবং মিশরসহ প্রতিবেশী দেশগুলোতে দারিদ্র্যপীড়িত ক্যাম্পে উদ্বাস্তু তথা শরণার্থী হিসেবে বসবাস করছে।
১৯৪৮ সালের ১৫ মে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেওয়া হয়।
এর পরের দিন প্রথম আরব-ইসরাইল যুদ্ধ শুরু হয় এবং ১৯৪৯ সালের জানুয়ারিতে ইসরাইল, মিশর, লেবানন, জর্ডান এবং সিরিয়ার মধ্যে যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে তা শেষ হয়।
১৯৪৮ সালের ডিসেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ রেজ্যুলেশন ১৯৪ পাস করে, যাতে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের ফিরে যাওয়ার অধিকার প্রদানের জন্য আহ্বান জানানো হয়।
নাকবার পরের বছরগুলো
অন্তত দেড় লাখ ফিলিস্তিনি নবগঠিত ইসরাইল রাষ্ট্রে রয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত ইসরাইলি নাগরিকত্ব দেওয়ার আগ পর্যন্ত প্রায় ২০ বছর ধরে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত সামরিক দখলদারিত্বের অধীনে বসবাস করতে হয় তাদের।
মিশর গাজা স্ট্রিপ (উপত্যকা) দখল করে নেয় এবং ১৯৫০ সালে জর্ডান পশ্চিম তীরে প্রশাসনিক শাসন শুরু করে।
১৯৬৪ সালে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) গঠিত হয় এবং এর এক বছর পর প্রতিষ্ঠিত হয় ফাতাহ রাজনৈতিক দল।
নাকসা বা ছয় দিনের যুদ্ধ এবং বসতি স্থাপন
১৯৬৭ সালের ৫ জুন ইসরাইল আরব জোটের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ছয় দিনের যুদ্ধ পরিচালনা করে। এ সময় দখলদাররা গাজা উপত্যকা, পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম, সিরিয়ার গোলান হাইটস (মালভূমি) এবং মিশরীয় সিনাই উপদ্বীপসহ ঐতিহাসিক প্যালেস্টাইনের বাকি অংশ দখল করে।
কিছু ফিলিস্তিনির জন্য এটি দ্বিতীয় জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি বা নাকসা তথা ‘বিপত্তি’ এর দিকে পরিচালিত করে।
১৯৬৭ সালের ডিসেম্বরে ফিলিস্তিনের মুক্তির জন্য মার্কসবাদী-লেনিনবাদী পপুলার ফ্রন্ট গঠিত হয়। পরের দশকে বামপন্থী গোষ্ঠীগুলোর দ্বারা ধারাবাহিক আক্রমণ এবং বিমান হাইজ্যাকিং ফিলিস্তিনিদের দুর্দশার দিকে বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়।
অধিকৃত পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকায় বসতি নির্মাণ শুরু হয়। একটি দ্বি-স্তরীয় ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছিল, যেখানে ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের ইসরাইলি নাগরিক হওয়ার সমস্ত অধিকার এবং সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হয়। বিপরীতে ফিলিস্তিনিদের একটি সামরিক দখলদারিত্বের অধীনে থাকতে হয়; যা তাদের জন্য বৈষম্যমূলক ছিল। এমনকি তাদের রাজনৈতিক বা নাগরিক অভিব্যক্তি প্রকাশের কোনো অধিকার ছিল না।
প্রথম ইন্তিফাদা ১৯৮৭-১৯৯৩
১৯৮৭ সালের ডিসেম্বরে গাজা উপত্যকায় প্রথম ফিলিস্তিনি ইন্তিফাদা শুরু হয়; যখন ফিলিস্তিনি শ্রমিকদের বহনকারী দুটি ভ্যানের সাথে একটি ইসরাইলি ট্রাকের সংঘর্ষে চার ফিলিস্তিনি নিহত হয়।
তরুণ ফিলিস্তিনিরা ইসরাইলি সেনাবাহিনীর ট্যাংক ও সৈন্যদের দিকে ঢিল ছুঁড়লে বিক্ষোভ দ্রুত পশ্চিম তীরে ছড়িয়ে পড়ে।
এটি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস প্রতিষ্ঠার পথও খুলে দেয়। যা মুসলিম ব্রাদারহুডের একটি অফ-শুট (শাখা সংগঠন) এবং ইসরাইলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধে নিযুক্ত।
তবে ইসরাইলি সেনাবাহিনীর কঠোর পদক্ষেপ এবং তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইতিজাক রাবিনের ‘ব্রেক দেয়ার বোনস’ (তাদের মেরুদণ্ড ভেঙে দাও) নীতির কারণে হামাসের কার্যক্রম আবদ্ধ ছিল। ‘ব্রেক দেয়ার বোনস’ নীতির মধ্যে সামারি কিলিং বা সংক্ষিপ্ত হত্যা (একটি সংক্ষিপ্ত মৃত্যুদণ্ড- যেখানে একজন ব্যক্তিকে একটি অপরাধের জন্য অভিযুক্ত করা হয় এবং তাৎক্ষণিকভাবে পূর্ণ ও ন্যায্যবিচারের সুবিধা ছাড়াই হত্যা করা হয়), বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ, কর্মীদের নির্বাসন এবং বাড়িঘর ধ্বংস অন্তর্ভুক্ত ছিল।
প্রাথমিকভাবে ইন্তিফাদা তরুণদের দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল এবং এর দিকনির্দেশনা এসেছিল ‘ইউনিফাইড ন্যাশনাল লিডারশিপ অব দ্য আপরাইজিং’ থেকে; এটি ইসরাইলি দখলদারিত্বের অবসান এবং স্বাধীন ফিলিস্তিন প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর একটি জোট।
১৯৮৮ সালে মুসলিম দেশগুলোর সংগঠন আরব লীগ ‘পিএলও’কে ফিলিস্তিনি জনগণের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
ইন্তিফাদার কর্মসূচির মধ্যে ছিল ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য জনসংহতি, গণবিক্ষোভ, আইন অমান্যকরণ, সুসংগঠিত ধর্মঘট এবং সাম্প্রদায়িক সহযোগিতা।
ইসরাইলি মানবাধিকার সংস্থা ‘বি'টিসেলেম’ এর মতে, ইন্তিফাদার সময় ইসরাইলি বাহিনীর হাতে ১ হাজার ৭০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে ২৩৭ জন শিশু ছিল। এ ছাড়া ১ লাখ ৭৫ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনিকে গ্রেফতার করা হয়েছিল।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাতের সমাধান খুঁজতেও উদ্বুদ্ধ করেছে ইন্তিফাদা।
অসলো বছর (অসলো চুক্তি) এবং ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ
১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তি স্বাক্ষর এবং প্যালেস্টাইন অথরিটি (পিএ) গঠনের মাধ্যমে শেষ হয় ইন্তিফাদা। পিএ হলো একটি অন্তর্বর্তী সরকার; যাকে অধিকৃত পশ্চিম তীর এবং গাজা উপত্যকায় সীমিত স্ব-শাসনের অধিকার প্রদান করা হয়।
পিএলও একটি দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের ভিত্তিতে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয় এবং কার্যকরভাবে এমন চুক্তি স্বাক্ষর করে- যা ইসরাইলকে পশ্চিম তীরের ৬০ শতাংশ এবং ভূখণ্ডটির ভূমি ও জলসম্পদের বেশিরভাগ নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার দেয়।
কথা ছিল- পিএ পশ্চিম তীর এবং গাজা উপত্যকায় একটি স্বাধীন রাষ্ট্র পরিচালনার নিমিত্তে প্রথম নির্বাচিত ফিলিস্তিনি সরকার গঠন করবে, যার রাজধানী হবে পূর্ব জেরুজালেম। কিন্তু তা আজ পর্যন্তও হয়ে উঠেনি৷
যারা পিএ-এর সমালোচনা করেন তারা এটিকে ইসরাইলি দখলদারিত্বের একটি দুর্নীতিগ্রস্ত উপ-কন্ট্রাক্টর হিসেবে দেখে থাকেন; যেটি ইসরাইলের বিরুদ্ধে গড়ে উঠা জনমত এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড দমনে ইসরাইলি সেনাবাহিনীর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সহযোগিতা করে।
ইসরাইল ১৯৯৫ সালে গাজা স্ট্রিপের চারপাশে একটি বৈদ্যুতিক বেড়া এবং কংক্রিটের প্রাচীর তৈরি করে, ফলে বিভক্ত ফিলিস্তিনি অঞ্চলগুলোর মধ্যে পারস্পাকি যোগাযোগ বা মেলামেশা বন্ধ হয়ে যায়।
দ্বিতীয় ইন্তিফাদা
দ্বিতীয় ইন্তিফাদা শুরু হয়েছিল ২০০০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর, যখন ইসরাইলের তৎকালীন বিরোধী নেতা এরিয়েল শ্যারন আল-আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণে একটি উস্কানিমূলক সফর করেন। সে সময় জেরুজালেমের পুরাতন শহর এবং এর আশপাশে হাজার হাজার নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়।
ফিলিস্তিনি বিক্ষোভকারী এবং ইসরাইলি বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষে দুই দিনে পাঁচ ফিলিস্তিনি নিহত এবং ২০০ জন আহত হয়।
ওই ঘটনাটি ব্যাপক সশস্ত্র বিদ্রোহের জন্ম দেয়। ইন্তিফাদার সময় ফিলিস্তিনি অর্থনীতি ও অবকাঠামোর নজিরবিহীন ক্ষতি করে ইসরাইল।
ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ (পিএ) কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোর পুনরায় নিয়ন্ত্রণ নেয় ইসরাইল এবং একটি বিচ্ছিন্ন প্রাচীর নির্মাণ শুরু করে। এতে ব্যাপক হারে বসতি নির্মাণের ঘটনা ঘটে এবং ফিলিস্তিনিদের জীবন-জীবিকা ও অনেক সম্প্রদায় ধ্বংস হয়।
যদিও আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বসতি স্থাপন অবৈধ, কিন্তু বছরের পর বছর ধরে হাজার হাজার ইহুদি বসতি স্থাপনকারী জাওনিস্ট কলোনিতে চলে এসেছে এবং চুরি করা (দখল করা) ফিলিস্তিনি ভূমিতে বসতি নির্মাণ করে চলেছে। কেবলমাত্র বসতি স্থাপনকারীদের জন্য রাস্তা এবং অবকাঠামো নির্মাণ যেহেতু ভূমিকে টুকরো টুকরো করে ফেলছে, ফলে অধিকৃত পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের জন্য জায়গা সংকুচিত হচ্ছে।
অসলো চুক্তি স্বাক্ষরের সময় পূর্ব জেরুজালেমসহ পশ্চিম তীরে মাত্র ১ লাখ ১০ হাজার ইহুদি বসতি স্থাপনকারী বাস করতো। অথচ আজ ফিলিস্তিনিদের কাছ থেকে বাজেয়াপ্ত করা ১ লক্ষ হেক্টর (৩৯০ বর্গমাইল) জমিতে বসবাসকারী ইহুদির সংখ্যা ৭ লাখের বেশি৷
ফিলিস্তিন বিভাজন এবং গাজা অবরোধ
পিএলও নেতা ইয়াসির আরাফাত ২০০৪ সালে মারা যান এবং এর এক বছর পর দ্বিতীয় ইন্তিফাদা শেষ হয়। গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি বসতিগুলো ভেঙে দেওয়া হয় এবং ইসরাইলি সৈন্য ও ৯ হাজার বসতি স্থাপনকারী ছিটমহলটি ছেড়ে চলে যায়।
এর এক বছর পর ফিলিস্তিনিরা প্রথমবারের মতো সাধারণ নির্বাচনে ভোট দেয়।
হামাস সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু ফাতাহ ও হামাসের মধ্যে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ, যা কয়েক মাস ধরে চলে। এতে শত শত ফিলিস্তিনি হতাহত হয়।
হামাস গাজা উপত্যকা থেকে ফাতাহকে বহিষ্কার করে এবং ফাতাহ- ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রধান দল- পশ্চিম তীরের কিছু অংশের নিয়ন্ত্রণ আবার শুরু করে।
হামাসকে ‘সন্ত্রাসবাদ’ এর অভিযোগে অভিযুক্ত করে ২০০৭ সালের জুন মাসে গাজা উপত্যকায় স্থল, বিমান এবং নৌ অবরোধ আরোপ করে ইসরাইল।
গাজা উপত্যকায় যুদ্ধ
ইসরাইল গাজায় চারটি দীর্ঘ সামরিক অভিযান পরিচালনা করেছে: ২০০৮, ২০১২, ২০১৪ ও ২০২১ সালে। এসব হামলায় বহু শিশুসহ হাজার হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে এবং কয়েক হাজার বাড়ি, স্কুল এবং অফিস ভবন ধ্বংস হয়েছে।
আবার এসব ভবন পুনর্নির্মাণও অসম্ভব হয়ে পড়েছে; কারণ ইসরাইলি অবরোধের কারণে গাজায় ইস্পাত ও সিমেন্টের মতো নির্মাণ সামগ্রী পৌঁছানো যায় না।
২০০৮ সালের হামলায় ইসরাইল আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ অস্ত্র- যেমন ফসফরাস গ্যাস ব্যবহার করেছিল।
২০১৪ সালের যুদ্ধ ৫০ দিন স্থায়ী হয়। ওই সময় ইসরাইলি হামলায় ২ হাজার ১০০ এর বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়। এর মধ্যে প্রায় ৫০০ শিশু এবং ১ হাজার ৪৬২ জন বেসামরিক নাগরিক ছিল।
এ ছাড়া অপারেশন প্রোটেক্টিভ এজ শীর্ষক ইসরাইলি অভিযানের সময় প্রায় ১ হাজার ১০০ ফিলিস্তিনি আহত হয়, ২০ হাজার ঘরবাড়ি ধ্বংস হয় এবং উদ্বাস্তু হয় অর্ধ মিলিয়ন (৫ লাখ) মানুষ।