ট্রাম্পের যত বিতর্কিত মন্তব্য ও উক্তি
প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:৪১ পিএম
২০২৪ সালের নির্বাচনে বিপুল ব্যবধানে জিতে ২০১৬ সালের পর আরও একবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে হোয়াইট হাউসে জায়গা করে নিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে তার এই যাত্রা যেমন মসৃণ ছিল না, তেমনি এই যাত্রাপথে বেশকিছু বিতর্কিত মন্তব্য ও উক্তির কারণে শিকার হয়েছেন নানা সমালোচনার।
একজন প্রেসিডেন্ট, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিতর্কিত মন্তব্য এবং উক্তি বিশ্বজুড়ে আলোচিত এবং সমালোচিত। তার বিভিন্ন বক্তব্য তার সমর্থক এবং সমালোচকদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে।
এখানে ট্রাম্পের কিছু উল্লেখযোগ্য বিতর্কিত মন্তব্য তুলে ধরা হলো:
১. মেক্সিকান অভিবাসীদের নিয়ে মন্তব্য-
২০১৫ সালে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে তার প্রচারণার সময় ডোনাল্ড ট্রাম্প মেক্সিকান অভিবাসীদের নিয়ে বলেন, ‘মেক্সিকো আমাদের কাছে তাদের ভালো লোকজন পাঠাচ্ছে না। তারা ড্রাগ, অপরাধ এবং ধর্ষণকারীদের পাঠাচ্ছে। কেউ কেউ হয়তো ভালো লোক, কিন্তু বেশিরভাগই সমস্যার কারণ’।
তার এই বক্তব্য যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন নীতি ও মেক্সিকোর সঙ্গে সম্পর্কের ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছিল।
এই মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় ডেমোক্রেটিক পার্টি এবং অভিবাসী অধিকার কর্মীরা ট্রাম্পের মন্তব্যকে জাতিবিদ্বেষমূলক এবং বৈষম্যমূলক বলে অভিহিত করেন।
তবে ট্রাম্পের সমর্থকরা মনে করেন, তিনি মার্কিন জনগণের নিরাপত্তা রক্ষার কথা বলেছেন। এছাড়া ট্রাম্পের ওই বক্তব্য মেক্সিকো সীমান্তে তার ‘বর্ডার ওয়াল’ নীতির প্রাথমিক ভিত্তি স্থাপন করে। যা নিয়ে পরে ব্যাপক বিতর্ক হয়।
২. মুসলিম নিষেধাজ্ঞা-
২০১৫ সালে সান বার্নার্ডিনো হামলার পর ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিমদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করার আহ্বান জানান। ওই সময় তিনি বলেন, ‘মুসলিমদেরকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করতে হবে যতক্ষণ না আমরা বুঝতে পারছি কী হচ্ছে’।
এরপর ২০১৭ সালে ক্ষমতায় আসার পর ট্রাম্প সাতটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করেন।
এই নীতির সমালোচকরা মনে করেন, এটি জাতিগত এবং ধর্মীয় বৈষম্যকে উসকে দিয়েছে এবং এটি মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করেছে।
৩. জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে সন্দেহমূলক মন্তব্য-
ডোনাল্ড ট্রাম্প বহুবার জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। একবার তো একে ‘চীনের ষড়যন্ত্র’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
ট্রাম্প দাবি করে বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন একটি ধাপ্পা, যা চীন তৈরি করেছে। যাতে তারা যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদনশীলতায় প্রভাব ফেলতে পারে’।
জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারে বৈজ্ঞানিক তথ্য সত্ত্বেও ট্রাম্প বিশ্বাস করেন যে, এটি বিশ্বব্যাপী একটি ধাপ্পা। এই মন্তব্যের কারণে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ও দায়িত্বশীলতা নিয়ে তার প্রশাসনের ওপর ব্যাপক চাপ আসে।
এছাড়াও ট্রাম্প অনেক বিজ্ঞানী এবং জলবায়ু বিশেষজ্ঞদের তীব্র বিরোধিতার মুখে পড়েন।
৪. নারী নিয়ে অশালীন মন্তব্য-
২০০৫ সালে ট্রাম্পের একটি ভিডিও টেপ ফাঁস হয়। যেখানে তিনি নারীদের নিয়ে অবমাননাকর মন্তব্য করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘যখন তুমি একজন তারকা, তখন তারা তোমাকে কিছু করতে দিতে বাধ্য থাকে’।
এছাড়াও তিনি নারীদের নিয়ে আপত্তিকর ভাষায় কথা বলেছিলেন। ট্রাম্পের ভাষায়, ‘নারীদের প্রতি আমি খুবই আকর্ষণ অনুভব করি এবং আমি তাদের ইচ্ছেমতো স্পর্শ করতে পারি’।
এই মন্তব্যে তার বিরুদ্ধে প্রচুর সমালোচনা হয় এবং অনেকেই ট্রাম্পকে নারীবিদ্বেষী বলে আখ্যায়িত করেন।
এই মন্তব্য তার জনপ্রিয়তার ওপর প্রভাব ফেললেও পরবর্তীতে ক্ষমা চাওয়ার মাধ্যমে সমর্থকদের সহানুভূতি লাভ করার চেষ্টা করেন।
৫. ‘শিথহোল কান্ট্রিজ’ সম্পর্কিত মন্তব্য
২০১৮ সালে অভিবাসন সম্পর্কিত আলোচনায় আফ্রিকার কিছু দেশ এবং হাইতির মতো দেশকে তিনি ‘শিথহোল কান্ট্রিজ’ (অশ্লীল দেশ) বলে অভিহিত করেন।
এই মন্তব্য তার বৈদেশিক নীতির ওপর প্রভাব ফেলে এবং আন্তর্জাতিক মহলে তীব্র সমালোচিত হয়।
আফ্রিকান ইউনিয়ন এবং বেশ কিছু রাষ্ট্র তার এই মন্তব্যের নিন্দা জানায় এবং একে জাতিগত বৈষম্যের উদাহরণ হিসেবে আখ্যায়িত করে।
৬. ভোট জালিয়াতির অভিযোগ
২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর ট্রাম্প এবং তার সমর্থকরা নির্বাচনে ব্যাপক ভোট জালিয়াতির অভিযোগ করেন। তার অভিযোগের প্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক অস্থিরতা বেড়ে যায় এবং তার সমর্থকরা ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ক্যাপিটল হিলে হামলা চালায়।
পরবর্তীতে তদন্তে এসব অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত না হলেও তার সমর্থকদের মধ্যে বিভ্রান্তি ও হতাশা রয়ে যায়।
৭. ‘ফাইন পিপল অন বোথ সাইডস’ মন্তব্য
২০১৭ সালে ভার্জিনিয়ার শার্লটসভিলে শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদী এবং এর বিরোধীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় ট্রাম্প বলেন, ‘দুই পক্ষেই ভালো মানুষ আছে’।
তার এই বক্তব্যকে অনেকেই শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদীদের প্রতি সহানুভূতির ইঙ্গিত বলে মনে করেন এবং তার মন্তব্য মার্কিন জাতিগত বিভাজনকে আরও উসকে দেয়।
যদিও পরে তিনি সহিংসতার নিন্দা জানান। তবুও তার এই মন্তব্য নিয়ে ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি হয়।
৮. কোভিড-১৯ ও জীবাণুনাশক বিষয়ে মন্তব্য
২০২০ সালে করোনাভাইরাস মহামারীর সময় ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘যদি শরীরের ভেতরে জীবাণুনাশক ব্যবহার করা যায়, তবে হয়তো ভাইরাস ধ্বংস হবে’।
তার এই মন্তব্য চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করে। কারণ এটি জনসাধারণের জন্য বিপজ্জনক ধারণা ছড়াতে পারে।
তার এই মন্তব্য ব্যাপক সমালোচিত হয় এবং জনস্বাস্থ্য কর্মীরা তার এ ধরনের মন্তব্যের তীব্র নিন্দা জানায়।
৯. প্রেসের প্রতি আক্রমণ
ট্রাম্প সংবাদমাধ্যমকে ‘ফেইক নিউজ’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। সেই সঙ্গে একাধিকবার দাবি করেছেন যে, ‘প্রেস হলো জনগণের শত্রু’।
তার এই মন্তব্যের ফলে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে এবং সাংবাদিকদের জন্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ে।
গণমাধ্যমের অনেকেই এই মন্তব্যকে প্রেসের স্বাধীনতার ওপর আক্রমণ বলে উল্লেখ করেছেন এবং এটি গণতান্ত্রিক নীতিমালার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মনে করেছেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের এসব মন্তব্য এবং উক্তি বিভিন্ন সময়ে তাকে সংবাদের শিরোনামে নিয়ে আসে। তার ভক্তরা একে তার সৎ ও স্পষ্টভাষী চরিত্রের প্রতিফলন হিসেবে দেখেন। তবে বিরোধীরা মনে করেন, এ ধরনের বক্তব্য অযৌক্তিক এবং বিভাজন ও বিদ্বেষ সৃষ্টিকারী।
এছাড়াও বরাবরই ব্যাপকভাবে বিতর্কিত ট্রাম্পের ব্যক্তিগত জীবন। তার প্রথম স্ত্রী ছিলেন ইভানা জেলনিকোভা। তাদের ঘরে তিন সন্তান- ডোনাল্ড জুনিয়র, ইভাঙ্কা এবং এরিক। তবে ১৯৯০ সালে বিবাহবিচ্ছেদ হয় তাদের। বিচ্ছেদের সময় আদালতে তাদের আইনি লড়াই নিয়মিত গসিপে পরিণত হয়।
তার দ্বিতীয় স্ত্রী অভিনেত্রী মার্লা ম্যাপলস। এই ঘরে ট্রাম্পের একটাই মাত্র সন্তান টিফানি। টিফানির জন্মের দুই মাস পর ১৯৯৩ সালে ম্যাপলস এবং ট্রাম্প বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হন। তবে ৭ বছর পর ১৯৯৯ সালে তাদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়। বর্তমান (তৃতীয়) স্ত্রী মেলানিয়ার সঙ্গে আছে ব্যারন নামে একটি ছেলে সন্তান।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের ব্যক্তিগত জীবনে একাধিক বিতর্কিত অধ্যায় রয়েছে। একাধিকবার যৌন নির্যাতন ও বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। বিভিন্ন সময়ে লেখিকা থেকে শুরু করে পর্ন তারকা তার বিরুদ্ধে তুলেছেন যৌন নিপীড়নের অভিযোগ।