Logo
Logo
×

আন্তর্জাতিক

বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় কোন পথে হাঁটবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প?

ফারিহা জেসমিন ইসলাম

ফারিহা জেসমিন ইসলাম

প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২৪, ০১:০৭ পিএম

বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় কোন পথে হাঁটবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প?

একদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে ছড়িয়ে পড়া ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাতে যখন বিশ্ব রাজনীতির মাঠ সরগরম তখনই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন যেন বিশ্ববাসীর উৎকণ্ঠা আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। অবশেষে ভোট প্রাপ্তির দিক থেকে ২০১৬ সালের তুলনায় অধিকতর শক্তিশালী হয়ে ডেমোক্র্যাট প্রতিদ্বন্দ্বী কমালা হ্যারিসকে হারিয়ে আবারও নাটকীয়ভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতার মসনদ পেলেন ৭৮ বছর বয়সি ডোনাল্ড ট্রাম্প। 

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে পুরো  বিশ্বের চোখ স্থির ছিল একদিকেই। কে হচ্ছেন পরবর্তী মার্কিন  প্রেসিডেন্ট যিনি পৃথিবীর অন্যতম ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের একজন।  বাস্তবিক যার এক আঙ্গুলের ইশারায় বদলে যেতে পারে অনেক দেশের রাজনৈতিক চিত্র, বহু মানুষের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে  বিশ্ববাসীর অপেক্ষার পালা শেষ হল গত ৬ নভেম্বর ২০২৪ । ডেমোক্র্যাটদের  হারিয়ে  বিশ্বমোড়ল খ্যাত আমেরিকার ৪৭ তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন রিপাবলিকান দলের ডোনাল্ড ট্রাম্প। এ জয়ের মধ্য দিয়ে  মাত্র চার বছর পর পুনরায় হোয়াইট হাউসে উত্থান হতে চলেছে আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট  ডোনাল্ড ট্রাম্পের।  এমতাবস্থায় সবার মনে একটাই প্রশ্ন- কেমন হবে ট্রাম্প সরকারের পররাষ্ট্র নীতি? নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী  মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ বন্ধ করে শান্তি ফিরিয়ে আনতে তাঁর পরিকল্পনাসমুহ কি? ট্রাম্পের কাছ থেকে এমন প্রশ্নের উত্তর পেতেই যেন মুখিয়ে আছে বিশ্ববাসী। 

বলাই বাহুল্য, এরইমধ্যে  ফিলিস্তিনের গাজায় চলমান ইসরাইলি বোমা  হামলায় প্রাণ হারিয়েছে তেতাল্লিশ হাজার ফিলিস্তিনি। নতুন করে লেবাননে শুরু হওয়া হামলায়  তিন হাজারেরও বেশি লেবানিজ জনগণের প্রাণহানি ঘটেছে। নির্বাচনি প্রচার চলাকালে ডোনাল্ড ট্রাম্প তিনি ক্ষমতায় আসার আগেই নেতানিয়াহু প্রশাসনকে গাজা থেকে  সরে আসতে আহবান জানিয়েছেন। যুদ্ধাক্রান্ত পৃথিবীতে তাঁর এরূপ শাণিত বার্তা প্রাণিত করেছে বহু শান্তিকামী মানুষকে। তারপরও আমেরিকার পুরনো গৌরব ফিরিয়ে আনতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ডোনাল্ড ট্রাম্প তার উত্তরসূরিদের পথেই হাঁটবেন কিনা তা নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে আছেন আরও অনেক দেশ এবং দেশের জনগণ।  

শুরু থেকেই আমেরিকার অর্থনীতিকে চাঙা করা এবং দেশটির উপর থেকে অবৈধ অভিবাসনের চাপ কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছেন মার্কিন বিজনেস টাইকুন এবং হোয়াইট হাউসে প্রত্যাবর্তিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। করোনা পরবর্তী বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দায় মার্কিন অর্থনীতি যখন ধুকছিল ঠিক তখনই রাশিয়া -ইউক্রেন যুদ্ধে জো বাইডেনের কিয়েভের প্রতি আর্থিক, রাজনৈতিক এবং কৌশলগত সমর্থন আমেরিকাকে শুধু বিতর্কিতই করেনি বরং আর্থিকভাবে ভীষণ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে মার্কিন অর্থনীতি। 

বিভিন্ন রিপোর্ট বলছে বাজারে তেলের দাম বৃদ্ধি, নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং তীব্রতর মূল্যস্ফীতিতে  যখন মার্কিনিরা ধৈর্য হারাচ্ছেন তখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত রাশিয়ার বিপক্ষে ইউক্রেনে আমেরিকার যুদ্ধব্যয় ক্ষুব্ধ করেছে মার্কিন জনগণকে। জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার আগে গ্যাসের দাম কমানোর প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবিক তা করে দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন। রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধ এবং রাশিয়ার বিপক্ষে আমেরিকার অবস্থানের কারণে সৃষ্ট আচলাবস্থা নিম্নবিত্ত মার্কিন জনগণের স্বাভাবিক জীবনযাপনে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে বিশেষ করে আর্থিক দিক থেকে তারা বিপদগ্রস্ত।  

অন্যদিকে মিত্রদেশ ইসরাইলের প্রতি হামাসের বিপক্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অকুণ্ঠ সমর্থনে বিশ্বশান্তি দাবানলে পুড়ছে তা বুঝতে কারো বাকি নেই । 

আর তাই মার্কিন জনগণ বাইডেনের এরূপ পররাষ্ট্রনীতির বিরোধীতার প্রমাণ দাখিল করেছেন ২০২৪ সনের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে , যখন তারা বাইডেন কে বাদ দিয়ে বিভিন্নভাবে বিতর্কিত বিজিনেস টাইকুন ট্রাম্পকে পুনরায় প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখতে ভোট দিয়েছেন।  ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি ইঙ্গিত দেয় হয়তো বা নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর কাজটি করে বেড়াবেন না ট্রাম্প সরকার। যুদ্ধে ব্যয় কমিয়ে কিংবা বরাদ্দ বন্ধ করে আমেরিকার জনগণের আর্থিক সচ্ছলতার কথা ভাববেন ট্রাম্প। অনিয়মিত  অভিবাসন রুখে দিয়ে স্থানীয় শ্রম বাজার চাঙ্গা করতেও এই সরকার দূরদর্শিতা দেখাবে আশা করা যায় । 

 বড় প্রশ্ন রয়ে যায়, কী নির্ধারিত হবে ফিলিস্তিনিদের জন্য এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ভবিষ্যৎ কী? অর্থাৎ আমেরিকায় পুনঃনিরবাচিত ডোনাল্ড ট্রাম্প এর নতুন নেতৃত্ব বিশ্বের হারিয়ে যাওয়া শান্তি পুনঃস্থাপনে কি ভূমিকা রাখবে সেটাই দেখার বিষয়। 

সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে  হারিয়ে স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী পৃথিবীতে একক পরাশক্তি হিসেবে  আবির্ভূত হওয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনো একক না হলেও বিশ্বরাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়।  বলাই বাহুল্য, তার পশ্চিমা মিত্রদের নিয়ে আমেরিকা এখনো একটি বড় শক্তি।  আর তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মদদপুষ্ট ইসরাইল ফিলিস্তিন প্রশ্নে এতোটাই আগ্রাসী। ২০২৩ সালে হামাসের বিরুদ্ধে শুরু করা ইসরাইলি হামলা গাজা ছাড়িয়ে লেবানন,  সিরিয়া পর্যন্ত গড়িয়েছে । এতে নেতানিয়াহু প্রশাসন বাইডেনের কাছ থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণে সামরিক সহায়তা পেয়েছে যা  বিশ্বশান্তির পথকে দুর্গম করেছে স্বীকার করতে হয়। 

 নির্বাচনি প্রচারে বিশ্বশান্তি ফিরিয়ে আনতে মুহূর্তেই যুদ্ধ বন্ধ করা প্রয়োজন বলে বার বার উল্লেখ করে ট্রাম্প বলেছিলেন ক্ষমতা পেলে যুদ্ধ বন্ধ করতে তৎপর হবেন । সে ক্ষেত্রে আমরা ট্রাম্পের প্রথম প্রয়াস হিসেবে  ফিলিস্তিন-ইসরাইলের মধ্যে একটি দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধবিরতি আশা করতে পারি।  তবে ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের সরকার কিন্তু এই শান্তির সপক্ষে বার্তা দেয়নি । প্রথম মেয়াদে নেতানিয়াহুর  সঙ্গে বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। নির্বাচনে জয়ের পর যদি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রথম মেয়াদের মত নেতানিয়হুর প্রতি আগ্রহ জিইয়ে রাখেন তবে তা ইসরাইলের প্রতি বাইডেনের সমর্থকেও ছাড়িয়ে যাবার সন্দেহ থেকে যায়।  

তবে ধারণা করা যাচ্ছে এবারের মেয়াদে ট্রাম্প-নেতানিয়াহু সম্পর্ক খারাপের দিকে মোড় নিতে পারে। যেহেতু নির্বাচনি প্রচারে ট্রাম্প যুদ্ধের বিপক্ষে কথা বলেছেন এবং ক্ষমতা পেলে যুদ্ধ বন্ধ করে বিশ্বে শান্তি আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। 

রাশিয়া- ইউক্রেন প্রশ্নেও আমেরিকা বর্তমান নীতি থেকে সরে আসবে আশা করা হচ্ছে।  এরই মধ্যে ট্রাম্পের পুনরায় আমেরিকা জয়কে ইতিবাচকভাবে ব্যাখা করেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ২০২২ সাল থেকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে  রাশিয়াকে নিষেধাজ্ঞা এবং কিয়েভকে সামরিক সহায়তা দিয়ে আসলেও ধারণা করা হচ্ছে জো বাইডেনকে অনুসরণ করতে আগ্রহী নন ট্রাম্প। নিজ দেশের অর্থনৈতিক বৈকল্য কাটাতে যুদ্ধে সহায়তা পাঠানো, রাজনৈতিক সমর্থন প্রদানসহ  মোটা দাগে তিনি ইউরোপ থেকে সরে আসবেন বলে আশা করা যায় । বিশ্ব শান্তি পুনঃস্থাপনের জন্য রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের ট্রাম্পের সঙ্গে বসবার আগ্রহ প্রকাশ শান্তি আলোচনার পথে একধাপ এগিয়ে দিল নব নির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্টকে । কিন্তু আমেরিকার পশ্চিমা অস্ত্র ব্যবসায়ী মিত্রদের চাপে পড়ে বা তাদের  মন রক্ষা করতে গেলে ডোনাল্ড ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আনতে কতোটা সক্ষম হবে তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা বসে ইউরোপে শান্তি আনায়নের ব্যবস্থা করার সুযোগ থাকলেও প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি হাতছাড়া হয়ে যাওয়া অঞ্চল ফিরে পেতে চাইলে বা চাওয়ার ব্যাপারে অনড় থাকলে ঘুরে যেতে পারে ঘটনা প্রবাহ। 

তবে চীনের সঙ্গে ইতমধ্যে প্রকট বাণিজ্য লড়াইয়ে লিপ্ত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উচিত হবে নির্বাচনি ইশতেহার অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের পালস বোঝা এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভেঙে পড়া অর্থনীতিকে পুনঃনির্মাণ করা। অর্থনৈতিক দিক থেকে মার্কিন মুলুককে তার পুরানো অবস্থান ফিরিয়ে দিতে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য নেহায়াতই জরুরি বৈকি। পূর্বে ট্রাম্প সরকারের ট্যারিফ যুদ্ধের মোকাবিলার জন্য চীন প্রস্তুত না থাকলেও এবার সবভাবে প্রস্তুত চীনের সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধের পরিবর্তে আলাপ এবং আপসের দরজা খুলে দিয়ে ব্যবসায়ী ট্রাম্প বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে পারেন।  

ডোনাল্ড ট্রাম্পের উচিত স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে  সতর্কতা অবলম্বন করা। যুদ্ধে আর্থিক, সামরিক সহায়তা প্রদান সম্পূর্ণ বন্ধ করে যুদ্ধ থেকে নিজেও সরে আসা এবং মিত্রদেরও সরে আসতে বাধ্য করা । অন্যথায় বিশ্বের তথা আমেরিকার শান্তিকামী জনগণ যে অবস্থান থেকে ট্রাম্পকে সরকার প্রধান  হিসেবে নির্বাচিত করেছে সেই বিশ্বাসে ফাটল ধরবে । 

লেখক: ফারিহা জেসমিন ইসলাম 

         শিক্ষক এবং  কলামিস্ট 

ঘটনাপ্রবাহ: মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ২০২৪


আরও পড়ুন

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম