গাজা উপত্যকার খান ইউনিসে ধ্বংসস্তূপের ওপর আগুনের পাশে বসে আছেন ফিলিস্তিনিরা।
গাজায় নিরীহ ফিলিস্তিনিদের ওপর যে গণহত্যা চলছে, তা বিশ্বকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছে: শোষক এবং তাদের বিরুদ্ধে যারা লড়াই করছে।
ইসরাইলি সরকার গত এক বছরের বেশি সময় ধরে নিরীহ ফিলিস্তিনি নাগরিকদের ওপর আক্রমণ চালাচ্ছে। তারা আন্তর্জাতিক আইনের মৌলিক নীতিগুলো স্পষ্টভাবে লঙ্ঘন করছে এবং যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং গণহত্যাসহ নানা ধরনের অপরাধে লিপ্ত রয়েছে।
দুঃখজনকভাবে, তারা কেবল ফিলিস্তিনিদের ওপর নয়, লেবাননের মানুষ, এমনকি মারোনাইট খ্রিস্টানদের ওপরও অমানবিক অত্যাচার চালাচ্ছে।
মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে নির্বিচারে নিরীহ নাগরিকদের ওপর গণহত্যা চালানো ইসরাইলি সরকারকে থামাতে পারে, এমন কোনো শক্তিই যেন নেই!
প্রথমত, জাতিসংঘের কাছ থেকেই এটি প্রত্যাশা করা হয়। কেননা সংস্থাটি একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন হিসেবে বৈশ্বিক শান্তি এবং স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য দায়বদ্ধ। জাতিসংঘ বার বার ইসরাইলকে আন্তর্জাতিক আইন এবং সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সংগঠনের সিদ্ধান্ত মেনে চলার জন্য আহ্বান জানিয়ে আসছে।
তবে ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ থোড়াই কেয়ার করছে, তারা কোনো আন্তর্জাতিক আইন বা জাতিসংঘের সিদ্ধান্তকে গুরুত্বই দিচ্ছে না।
এমনকি ইসরাইলি নিরাপত্তা বাহিনী জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ভবনগুলোতেও হামলা চালিয়েছে। সেই সঙ্গে জাতিসংঘের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সমালোচনাও করেছে।
উদাহরণস্বরূপ, ইসরাইল গাজা উপত্যকায় জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনআরওএ) ভবন এবং স্কুলগুলোকে বোমা হামলা চালিয়েছে। এছাড়া ইসরাইলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরায়েল কাতজ জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসকে দেশটিতে প্রবেশ করতে নিষেদ্ধ করেছেন।
সম্প্রতি ইসরাইল লেবাননে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষীদের ওপরও হামলা করেছে। যা আন্তর্জাতিক আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন।
তবে জাতিসংঘ ইসরাইলি সরকারের লঙ্ঘনগুলোর বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। উলটো এর সংস্থাগুলোর এবং কর্মকর্তাদের অধিকার রক্ষায় অক্ষম থেকেছে।
অন্যদিকে ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম এবং গাজা উপত্যকাকে দখলকৃত এলাকা হিসেবে বিবেচিত করা হলেও, ইসরাইল জাতিসংঘের রেজুলেশনগুলো কখনও গ্রহণ করেনি।
তাই স্পষ্ট যে, জাতিসংঘ ইসরাইল সরকারের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না, যতক্ষণ না যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলো ইসরাইলের বর্বরতার বিপক্ষে অবস্থান করছে।
দ্বিতীয়ত, ইসলামী সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি) এবং আরব লীগ- এই দুটি আন্তর্জাতিক সংগঠন হিসেবেও ইসরাইলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে।
ওআইসির উদ্দেশ্য হলো- জেরুজালেমের স্বাধীনতা ও রক্ষা। ওআইসি প্রতিষ্ঠার প্রথম পদক্ষেপটি ১৯৬৯ সালে আল-আকসা মসজিদে অগ্নিকাণ্ডের প্রতিক্রিয়ায় নেওয়া হয়।
তবে দুঃখের বিষয় হলো বিভিন্ন কারণে ওআইসির ৫৭টি সদস্য রাষ্ট্র ইসরাইলের বিরুদ্ধে কোনো যৌক্তিক প্রতিক্রিয়া জানাতে সমর্থ হয়নি। অধিকাংশ ওআইসি সদস্য আরব রাষ্ট্রগুলো থেকেই প্রতিক্রিয়া আশা করে বসে থাকে।
অন্যদিকে আরব লীগের দৃষ্টিকোণ থেকে সাম্প্রতিক ফিলিস্তিন পরিস্থিতিতে কোনো প্রতিবাদ করার প্রবণতা নেই। অধিকাংশ আরব সরকার পশ্চিমা শক্তির ওপর অত্যধিক পরিমাণে নির্ভরশীল এবং ইসরাইলি আক্রমণের বিরুদ্ধে তারা কথা বলতে পারেনি।
উলটো আরবের কিছু সরকার ইসরাইলি আক্রমণকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমর্থনও করে। অপরদিকে, অপর কিছু সরকার সাম্প্রতিক পরিস্থিতির বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার মতো ক্ষমতাহীন। তারা ফিলিস্তিনি সমস্যার প্রতি রীতিমত উদাসীন হয়ে পড়েছে।
ফিলিস্তিন এবং অন্যান্য আরব জনগণের বিরুদ্ধে গণহত্যার এই পরিস্থিতিতে ইসরাইলি জনসাধারণের বেশিরভাগ অংশই বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সরকারের বর্বরতার পক্ষে।
অন্যদিকে অনেক ইহুদি, যারা বিভিন্ন দেশের নাগরিক, তাদেরকেও ইসরাইলের বর্বরতায় যোগ দিতে দেখা গেছে। আবার যারা ইসরাইলি আক্রমণের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলছেন, তারা জ়ায়নবাদী চক্রের দ্বারা তীব্র সমালোচনা ও নিপীড়নের শিকার হন। তবে এই প্রতিবাদগুলো ইসরাইলি সরকারের নীতি ও কৌশলে কোনো প্রভাব ফেলতে পারছে না।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- পশ্চিমের জ়ায়নবাদী সমর্থকরা ইসরাইলি আক্রমণ রোধে সবচেয়ে প্রভাবশালী ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে। যদি পশ্চিমা সরকারগুলো, যারা প্রধানত বৈশ্বিক জ়ায়নবাদী লবির দ্বারা প্রভাবিত, তাদের সমর্থন বন্ধ করে দেয়, তবে ইসরাইল সরকার মধ্যপ্রাচ্যের জনগণের ওপর আক্রমণ চালাতে সক্ষম হবে না।
পশ্চিমা সরকারগুলোর অকারণ ও সীমাহীন সমর্থনই মূলত ইসরাইলকে তাদের অপরাধ সংঘটন করতে উৎসাহিত করছে। ফলে এই পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো ইসরাইলের সকল অপরাধে সহায়ক।
এক কথায়, ফিলিস্তিন-ইসরাইল প্রশ্নটি শুধু একটি স্থানীয় বা আঞ্চলিক সংঘাত নয়। বরং এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। এটি বিশ্বকে দুটি রাজনৈতিক ফ্রন্টে বিভক্ত করেছে- যার একটি শোষকের ঔপনিবেশিক মানসিকতা এবং অপরটি শোষিতের মানবতা।
প্রথম দলের কর্মকাণ্ড সম্পূর্ণরূপে শক্তি এবং উপাদানগত হিসাবের ওপর নির্ভরশীল। যেখানে দ্বিতীয় দলের কর্মকাণ্ড মানবিক মূল্যবোধের ওপর নির্ভর করে।
সর্বশেষে এটি স্পষ্ট যে, শোষণ দীর্ঘকাল টিকে থাকবে না এবং যারা শোষণ দ্বারা উপার্জন করে তাদের পরিণতি হবে ভয়াবহ।
(ডেইলি সাবাহতে প্রকাশিত মুহিতিন আতামানের লেখা অবলম্বনে)