ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদন
ইরানে হামলা চালিয়ে যুদ্ধকে আরও উসকে দিল ইসরাইল
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ২৬ অক্টোবর ২০২৪, ০৯:১৬ পিএম
ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার জবাবে ইসরাইল শনিবার সকালে ইরানে পাল্টা আক্রমণ চালিয়েছে। ইসরাইলের এই হামলা মধ্যপ্রাচ্যে গাজা যুদ্ধের প্রসঙ্গকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
শনিবার এক প্রতিবেদনে এমনটাই দাবি করেছে মার্কিন সংবাদ মাধ্যম ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসরাইলের শনিবারের হামলাকে গত ১ অক্টোবর ইসরাইলের দিকে ছোড়া ইরানের প্রায় ২০০টি ক্ষেপণাস্ত্রের পালটা প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা হচ্ছে।
এই আক্রমণটি একাধিক ধাপের মাধ্যমে কয়েক ঘণ্টা ধরে চলেছিল এবং ভোরের আগেই তা শেষ হয়।
ইসরাইল জানিয়েছে, তারা ইরানের বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থিত সামরিক স্থাপনায় আক্রমণ করেছে, যার মধ্যে ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণের স্থাপনা এবং বিমান প্রতিরক্ষা সাইটও রয়েছে। এই হামলাটি এমনভাবে পরিকল্পিত ছিল, যেন ভারি পাল্টা প্রতিশোধের আশঙ্কা না থাকে।
এই হামলার প্রেক্ষিতে ইরানে শনিবার স্থানীয় সময় সকাল ৯টা পর্যন্ত সব ফ্লাইট বাতিল ঘোষণা করেছিল। এর আগে ইরান হুমকি দিয়েছিল যে, যদি তার দেশের পারমাণবিক বা জ্বালানী তেলের অবকাঠামোতে আক্রমণ করা হয়, তবে তারা জোরালোভাবে এর প্রতিশোধ নেবে।
যুক্তরাষ্ট্রও ইসরাইলকে ওইসব লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত না হানার জন্য আহ্বান জানিয়েছিল এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারও আরও সংঘাতের বিরুদ্ধে সতর্ক করে দেয়।
এদিকে শনিবার ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ইসরাইলের আক্রমণগুলো রাজধানী তেহরানসহ প্রদেশটির সামরিক কেন্দ্রগুলো লক্ষ্য করে চালানো হয়। পাশাপাশি পশ্চিমের খুজেস্তান এবং ইলাম প্রদেশের লক্ষ্যবস্তুতেও আক্রমণ চালানো হয়েছে। তারা এখনও পুরো বিষয়টি তদন্ত করছে। তবে ইতোমধ্যেই জানিয়েছে যে, হামলায় সীমিত ক্ষতি হয়েছে।
ইরান সরকার জানিয়েছে, ইসরাইলের এ হামলায় তাদের দুজন সৈন্য নিহত হয়েছে।
এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইউসিএলএ) সিনিয়র রাজনৈতিক গবেষক এবং র্যান্ড-এর সেন্টার ফর মিডল ইস্ট পাবলিক পলিসির সাবেক পরিচালক ডালিয়া দাসা কায়ে বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে যা আমরা জানি, সেটি যদি সীমিত রাখা যায় তবে এটিই সেরা পরিস্থিতি হবে। কারণ ইসরাইল তাদের আক্রমণ ইরানি সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে সীমাবদ্ধ রেখেছে, পারমাণবিক বা তেল অবকাঠামোতে আঘাত করেনি’।
ডালিয়া আরও বলেন, ‘ইসরাইলের এই সীমিত আক্রমণ ইরানের জন্য পাল্টা প্রতিশোধ না নেওয়ার একটি সুযোগ তৈরি করেছে। তবে ইসরাইল এবং ইরান এখন সরাসরি এবং প্রকাশ্য সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে, যা আগের অবস্থার থেকে একেবারেই আলাদা’।
এ বিষয়ে মার্কিন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ইসরাইল আক্রমণ চালানোর কয়েক ঘণ্টা আগে তাদেরকে আগাম তথ্য দিয়েছিল এবং যুক্তরাষ্ট্র এই আক্রমণে অংশগ্রহণ করেনি।
ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এই হামলার পরিকল্পনা নিয়ে চলতি মাসের শুরুতেই প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সঙ্গে ফোনে আলোচনা করেছিলেন। আক্রমণ শুরু হওয়ার পর মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব লয়েড অস্টিন ইসরাইলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের সঙ্গে সংক্ষিপ্তভাবে ফোনে কথাও বলেন বলে মার্কিন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
এদিকে একজন সিনিয়র মার্কিন প্রশাসনিক কর্মকর্তা বলেন, ‘ইরান যদি আবারও পালটা আঘাত করার চেষ্টা করে, তবে আমরা প্রস্তুত থাকব এবং ইরানের জন্য তা ভয়াবহ পরিণতি হবে। তবে আমরা চাই না এমনটা ঘটুক। ইসরাইল ও ইরানের মধ্যে সরাসরি গোলা বিনিময়ের এখানেই শেষ হওয়া উচিত’।
জানা গেছে, ইসরাইলি আক্রমণের কয়েক ঘণ্টা আগে ইরানও আগাম সতর্কবার্তা পেয়েছিল, যা ইসরাইলের পক্ষ থেকে কয়েকটি আরব এবং ইউরোপীয় দেশের মাধ্যমে পৌঁছানো হয়েছিল। এই সতর্কবার্তায় ইসরাইলি হামলার লক্ষ্যবস্তুগুলো সম্পর্কে তথ্য ছিল। সেই সঙ্গে ইরান যদি পালটা আঘাত করে তবে পরবর্তী আক্রমণ আরও শক্তিশালী হবে বলেও তাতে ইঙ্গিত দেওয়া হয়।
যদিও ইসরাইল এই বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো মন্তব্য করেনি এবং নিউইয়র্কে জাতিসংঘে ইরানের মিশন থেকেও তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
এদিকে তেহরানের কেন্দ্রস্থলের একজন বাসিন্দা ওয়াল স্ট্রিট জার্নালকে জানিয়েছেন, তিনি শনিবার সকালে টানা বিস্ফোরণের শব্দে জেগে ওঠেন। ইরানি বাসিন্দার ভাষ্যমতে, ‘আতঙ্কে আমার বুক ধড়ফড় করছে’।
এ হামলার বিষয়ে ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, রাজধানীর আশেপাশে তিনটি স্থানে তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সক্রিয় ছিল। এর আগে ইরান কয়েক ঘণ্টার জন্য আকাশসীমা বন্ধ ঘোষণা করেছিল।
ইরান এর আগে গত ১ অক্টোবর ইসরাইলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। যা হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়া এবং হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহকে হত্যার প্রতিশোধ হিসাবে বিবেচিত হয়। এ হামলায় তারা প্রায় ২০০টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে।
সম্প্রতি আরব সরকারগুলোর সঙ্গে আলোচনায় ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান যে, সংঘাত আরও ছড়িয়ে পড়ুক- ইরান তা চায় না। সেই সঙ্গে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এও ইঙ্গিত দেন যে, তাদের সামরিক স্থাপনায় আঘাত হানলে তারা পালটা আঘাত না করেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে।
এই সামরিক অভিযান এবং হুমকিগুলো গাজায় শুরু হওয়া সংঘাতের সর্বশেষ বিস্তারকে চিহ্নিত করছে, যা শুরু হয়েছিল গত বছরের ৭ অক্টোবর। দীর্ঘদিন ধরে পরোক্ষ যুদ্ধ চালানোর পর ইসরাইল এবং ইরান এ বছরই সরাসরি দুবার গোলা বিনিময় করেছে।
ইসরাইল লেবাননেও একটি বড় আক্রমণ চালিয়েছে, যেখানে গত এক বছরে বারবার সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। দেশটিতে স্থল বাহিনী পাঠানো এবং গত এক মাসে প্রায় ৩,০০০ বিমান হামলা পরিচালনা করার মাধ্যমে ২,৫০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন বলে লেবানিজ স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।
এদিকে গাজায় সংঘর্ষ আরও বেড়েছে এবং উপত্যকাটির উত্তরাঞ্চলে ইসরাইলি বাহিনীর একটি বড় অভিযান চলছে।
ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের মতে, গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত ইসরাইলি আক্রমণে গাজায় প্রায় ৪৩ হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন। যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। তবে তারা জানায়নি যে, এই সংখ্যার মধ্যে কতজন হামাস যোদ্ধা রয়েছেন। এছাড়া আহত ও পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন এক লাখেরও বেশি ফিলিস্তিনি।
চলতি বছরের এপ্রিলে ইরান প্রথমবারের মতো ইসরাইলে সরাসরি আক্রমণ করার পর থেকেই মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে এই সংঘাত ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। ইরান থেকে আসা ৩০০টিরও বেশি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্রের আক্রমণ ইসরাইল এবং তার মিত্রদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে মূলত আটকানো সম্ভব হয়েছিল। প্রতিক্রিয়াস্বরূপ, ইসরাইল একটি সুনির্দিষ্ট হামলা চালিয়ে ইরানের একটি বিমান প্রতিরক্ষা রাডার স্থাপনায় আঘাত হানে।
এরপর অক্টোবরের শুরুতে ইরান দ্বিতীয়বার আক্রমণ করে, যা ছিল অনেকটা এপ্রিলের আক্রমণের মতোই। যা ইসরাইলের সামরিক ও নিরাপত্তা স্থাপনাগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করেছিল এবং খুব বেশি ক্ষতি করতে পারেনি।
এ সময় মার্কিন যুদ্ধজাহাজগুলোও ইসরাইলের দিকে ধাবিত বেশ কয়েকটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করতে সাহায্য করেছিল। তবে অনেকগুলো ক্ষেপণাস্ত্রই ইসরাইলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করে যাওয়ায় সেগুলো জনবসতিপূর্ণ এলাকায় আঘাত হানলে সম্ভাব্য ক্ষতি সম্পর্কে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়।
এ নিয়ে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইরানকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, এই আক্রমণ চালিয়ে ইরান একটি ‘বড় ভুল’ করেছে এবং এর জন্য তাদের চরম মূল্য দিতে হবে।
তারই জেরে শনিবার ভোরে নেতানিয়াহু এবং তার প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট তেলআবিবে সামরিক সদর দপ্তরের একটি ভূগর্ভস্থ বাঙ্কারে অবস্থান নিয়ে আক্রমণ পরিচালনা করছিলেন বলে জানায় ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।
ইসরাইলি সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, তাদের সমস্ত বিমান নিরাপদে ফিরে এসেছে এবং এই আক্রমণের ফলে ইরানে তারা আরও মুক্তভাবে অভিযান চালাতে পারবে।
এ বিষয়ে রাজনৈতিক গবেষক ডালিয়া দাসা কায়ে বলেন, গাজা যুদ্ধ ইসরাইল-ইরান সংঘাতকে ছায়া থেকে বের করে এনেছে। অর্থাৎ এই সংঘাত এখন আরও প্রকাশ্য এবং সরাসরি রূপে রূপান্তরিত হয়েছে।