পুরুষদের আত্মহত্যায় ‘নারীদের যোগসূত্র’ টেনে তোপের মুখে কাউন্সিলর
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ১০ জুলাই ২০২৪, ০৮:৩৯ পিএম
সমাজে নারীদের ‘কর্তৃত্বপূর্ণ’ ভূমিকার সঙ্গে পুরুষদের আত্মহত্যার যোগসূত্র টেনে ‘বিপজ্জনক ও প্রমাণহীন’ মন্তব্য করে রীতিমতো তোপের মুখে পড়েছেন দক্ষিণ কোরিয়ার এক সিটি কাউন্সিলর।
সম্প্রতি সিউল সিটি কাউন্সিলর কিম কি-ডাক বলেছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ বেড়ে গেছে। এতে পুরুষদের জন্য চাকরি এবং বিয়ের জন্য মেয়ে পাওয়া কঠিন হয়ে গেছে।
তিনি বলেছেন, দেশটি সাম্প্রতিক সময়ে ‘নারী-প্রধান দেশে পরিবর্তন হওয়া শুরু করেছে’ এবং তার মতে এটাই সম্ভবত ‘পুরুষদের আত্মহত্যার চেষ্টা বেড়ে যাওয়ার আংশিক কারণ’ হতে পারে।
বিশ্বের ধনী দেশগুলোর মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়াতেই আত্মহত্যার হার বেশি। কিন্তু লিঙ্গ সমতার দিক থেকেও দেশটির রেকর্ড খুবই নেতিবাচক।
কাউন্সিলর কিমের ওই মন্তব্যের ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে এবং এটি হলো পুরুষ রাজনীতিকদের এ ধরনের ধারাবাহিক মন্তব্যগুলোর তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন।
দেশটির ডেমোক্র্যাটিক পার্টির রাজনীতিক কিম সিউলের হান নদীর সেতু এলাকায় আত্মহত্যার চেষ্টা সম্পর্কিত তথ্য উপাত্ত সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন পর্যালোচনার সময় এ ধরনের মন্তব্য করেন।
ওই প্রতিবেদনটি সিটি কাউন্সিলের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে। এতে দেখা যাচ্ছে, হান নদীতে আত্মহত্যার চেষ্টার সংখ্যা ২০১৮ সালে ছিল ৪৩০ জন। ২০২৩ সালে তা বেড়ে ২০৩৫ জনে দাঁড়িয়েছে। আর এই আত্মহত্যার চেষ্টাকারীদের মধ্যে পুরুষের হার ৬৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ৭৭ শতাংশে এসে পৌঁছেছে।
কিমের ওই প্রতিবেদন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন আত্মহত্যা প্রতিরোধ বিশেষজ্ঞরা। সিউল ইওনসেই বিশ্ববিদ্যালয়ের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ের অধ্যাপক সং হান বলেছেন, ‘যথেষ্ট প্রমাণ ছাড়া এ ধরনের দাবি করা খুবই বিপজ্জনক ও বোকামি।’
তিনি আরও বলেন, বৈশ্বিকভাবেই নারীদের চেয়ে পুরুষের আত্মহত্যার হার বেশি। যুক্তরাজ্যসহ অনেকে দেশে পঞ্চাশ বছরের কম বয়সিদের মৃত্যুর বড় কারণগুলোর একটি আত্মহত্যা।
অধ্যাপক সং হান বলেছেন, ‘এটা দুঃখজনক যে, কাউন্সিলর একে লিঙ্গ সংঘাত হিসেবে তুলে ধরেছেন। তবে পুরুষদের আত্মহত্যার চেষ্টার কারণগুলোকে নিয়ে বৈজ্ঞানিকভাবে গবেষণা করা উচিত’।
দক্ষিণ কোরিয়ায় পূর্ণ সময়ের কাজের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের সংখ্যায় যথেষ্ট পার্থক্য আছে। নারীরা অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে অস্থায়ী বা পার্ট টাইম কাজ করছে। বেতনের ক্ষেত্রেও পার্থক্য কমে আসছে। তবে এরপরেও নারীরা গড়ে ২৯ শতাংশ কম টাকা পেয়ে থাকেন।
দেশটিতে সম্প্রতি নারীবাদ বিরোধী আন্দোলন কিছুটা গতি পেয়েছে। কিছু হতাশ নারী বলছেন, তাদের জীবন মানোন্নয়ন করার চেষ্টায় বরং কিছুটা ক্ষতি হয়েছে।
কাউন্সিলর কিমের ওই প্রতিবেদনে এভাবে উপসংহার টানা হয়েছে যে, ‘নারী প্রধান প্রবণতা’ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য লিঙ্গ সমতা নিয়ে মানুষের সচেতনতা বাড়াতে হবে। যাতে করে ‘নারী ও পুরুষ উভয়েই সমান সুযোগ পেতে পারে’।
তার এই প্রতিবেদন নিয়ে সামাজিক মাধ্যম ‘এক্স’-এ তীব্র সমালোচনা করছেন দক্ষিণ কোরিয়ার মানুষ। তারা একে ‘প্রমাণহীন’ ও ‘বৈষম্যমূলক’ বলে আখ্যায়িত করছেন। একজন প্রশ্ন করেছেন, তারা সমান্তরাল বিশ্বে বাস করেন কি না?
অন্যদিকে দ্য জাস্টিস পার্টি একে লিঙ্গ বৈষম্য থেকে মুক্তি পেতে কোরিয়ান সমাজের যে ‘নারীরা লড়াই করছেন, তাদের ওপর সহজে দোষ চাপানোর একটা সহজ চেষ্টা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।
দলটির পক্ষ থেকে কাউন্সিলর কিমকে তার মন্তব্য প্রত্যাহার করে বরং কীভাবে সমস্যা থেকে উত্তরণ করা যায়, সেদিকে মনোনিবেশ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
কাউন্সিলর কিম সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, নারী-নিয়ন্ত্রিত সমাজের সমালোচনার উদ্দেশ্য তার ছিল না এবং তিনি পরিণতির কথা চিন্তা করেই এটা করেছেন, এতে নিজের ব্যক্তিগত অভিমত খুব একটা দেননি।
তারপরেও তার মন্তব্যকে দক্ষিণ কোরিয়ার সমাজে সবচেয়ে আলোচিত ইস্যুগুলো নিয়ে অবৈজ্ঞানিক ও কখনো উদ্ভট প্রস্তাবনার ধারাবাহিকতায় আসা মন্তব্য হিসেবে দেখা হচ্ছে। ইস্যুগুলোর মধ্যে আছে মানসিক স্বাস্থ্য, লিঙ্গ সহিংসতা এবং বিশ্বের সবচেয়ে কম জন্ম হার।
গত মাসে সিউলের আরেক কাউন্সিলর কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইটে ধারাবাহিক কিছু রিপোর্ট প্রকাশ করেন। যেখানে নারীদের জন্ম হার বাড়াতে জিমন্যাস্টিক ও পেলভিক ফ্লোর ব্যায়াম করতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে।
একই সময়ে সরকারের একটি থিংক ট্যাঙ্ক ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের স্কুল আগে শুরুর পরামর্শ দিয়েছে। যাতে সহপাঠীরা পরস্পরের কাছে আকর্ষণীয় হয় ও এর মধ্যে তারা বিয়ের জন্য প্রস্তুত হতে পারে।
এ বিষয়ে কোরিয়ান ইউমেন ট্রেড ইউনিয়নের ডিরেক্টর ইয়ুরি কিম বলেছেন, ‘এ ধরনের মন্তব্য থেকে বোঝা যায় দক্ষিণ কোরিয়ার সমাজ কতটা উদ্ভট।’
তার অভিযোগ, নারীরা আসলে কী ধরনের সমস্যা মোকাবিলা করছেন, রাজনীতিক ও নীতি নির্ধারকরা সেটি বুঝতে চান না। এর চেয়ে নারীদের বলির পাঠা বানাতেই বেশি আগ্রহী তারা।
ইয়ুরি কিম বলেন, ‘কর্মক্ষেত্রে আসার জন্য নারীদের দোষারোপ করা সমাজের অসমতাকেই কেবল দীর্ঘায়িত করবে।’
এদিকে দক্ষিণ কোরিয়ার সংসদে এখন ২০ শতাংশই নারী আর স্থানীয় কাউন্সিলরদের মধ্যে ২৯ শতাংশ।
সিউল সিটি কাউন্সিল জানিয়েছে, তাদের অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে রাজনীতিকরা যা প্রকাশ করে, সেগুলো যাচাইয়ের কোনো প্রক্রিয়া নেই। তাদের মতে, এই রিপোর্টগুলো যাদের, এর দায়ও নিতান্তই তাদের এবং তারা পরবর্তী নির্বাচনে পরিণাম ভোগ করবেন। সূত্র: বিবিসি