মোদিকে দেওয়া নওয়াজ শরিফের বার্তা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ১৩ জুন ২০২৪, ১০:১২ পিএম
নরেন্দ্র মোদি তৃতীয়বারের মতো ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর পাকিস্তানি নেতৃত্বের পক্ষ থেকে তাকে শান্তির বার্তা পাঠানো হয়েছে। সোমবার প্রথমে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ তাকে অভিনন্দন জানান। এরপর তার ভাই সে দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফও সমাজিকযোগাযোগ মাধ্যমে মোদিকে অভিনন্দন বার্তা পাঠান।
এক্স হ্যান্ডেলে (সাবেক টুইটারে)-এ পোস্ট করা তার সেই বার্তায় নওয়াজ শরিফ লিখেছেন, ধারাবাহিকভাবে তৃতীয়বার ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য আমি মোদিকে উষ্ণ অভিনন্দন জানাই। নির্বাচনে ধারাবাহিক বিজয় আপনার নেতৃত্বের প্রতি মানুষের আস্থার প্রতিফলনকে দর্শায়।
একই সঙ্গে আরও একটি বার্তা পাঠিয়েছেন পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী। যিনি ২০১৩ সালে ক্ষমতায় আসার পর বেশ কয়েকবার নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। তিনি লিখেছেন, আসুন আমরা এই অঞ্চলের ঘৃণার পরিবর্তে আশার হাত ধরে এখানে বসবাসকারী ২০০ কোটি মানুষের উন্নয়ন ও কল্যাণের কথা চিন্তা করি।
জবাবে মোদি লিখেছেন, অভিনন্দন বার্তার জন্য ধন্যবাদ। ভারতের জনগণ সর্বদাই শান্তি, নিরাপত্তা এবং প্রগতিশীল চিন্তাধারার সমর্থক। আমাদের জনগণের কল্যাণ ও সুরক্ষাকে সর্বদাই আমাদের তরফে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
এদিকে চলতি বছরের মার্চ মাসে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক আবার শুরু করার ইঙ্গিত দিয়ে জানিয়েছিলেন, পাকিস্তান বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করছে।
কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তানের সঙ্গে শান্তি ও সে দেশের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার প্রশ্নে ভারতীয় নেতৃত্ব আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসবাদ ও নিরাপত্তার মতো বিষয়গুলোকে উত্থাপন করে এসেছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স-এ নরেন্দ্র মোদি ও নওয়াজ শরিফের মধ্যে সংক্ষিপ্ত কথোপকথনের প্রসঙ্গে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গিয়েছে।
জিও নিউজের ক্যাপিটাল টক অনুষ্ঠানে এ বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ মন্তব্য করেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নরেন্দ্র মোদিকে অভিনন্দন জানানো একটি আনুষ্ঠানিক বার্তা। এটি কূটনৈতিক স্তরে করা হয়।
তিনি বলেছেন, তো আমরা কোথায় প্রেমপত্র পাঠিয়েছি? শাহবাজ শরিফ যখন প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, তখন তিনি (নরেন্দ্র মোদি) আমাদের অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। তাই এখন কূটনৈতিক প্রয়োজন মেটাতে আমরাও একই কাজ করেছি।
এ বিষয়ে তার মতামত জানিয়েছেন ভারতীয় সাংবাদিক সুধীন্দ্র কুলকার্নি, যিনি পররাষ্ট্রসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও পর্যবেক্ষণ করেন।
এক্স হ্যান্ডেলে নওয়াজ শরিফের পোস্ট এবং তার প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর দ্রুত প্রতিক্রিয়াকে একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হিসাবে বর্ণনা করে বলেছেন যে, এটি ব্যাক চ্যানেল মারফত বার্তার কাজ করতে পারে এবং দুই দেশের মধ্যে অচলাবস্থা নিরসনের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলতে পারে।
বিবিসির সঙ্গে কথোপকথনের সময় কুলকার্নি বলেন, নওয়াজ শরিফ আরও একবার মোদির দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, যার সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক ভালো।
‘আর শাহবাজ শরিফ এর আগেই ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতির কথা বলেছেন।’
তার মতে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকেও আমন্ত্রণ জানানো হলে ভালো হতো। কিন্তু এখন এক্স হ্যান্ডেলে পোস্টের মাধ্যমে দুই দেশের নেতাদের মধ্যে কথোপকথনকেও তিনি স্বাগত জানিয়েছেন।
সাংবাদিক সুহাসিনী হায়দার আন্তর্জাতিক সম্পর্কের দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখেন। তিনি মনে করেন, নরেন্দ্র মোদির জবাবে নওয়াজ শরিফের বার্তার মতো হয়তো ততটা উষ্ণতা নেই, তবে মোদি অবশ্যই তার (নওয়াজ শরিফের) মতামতকে সম্মান জানিয়েছেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এই বিষয়ে পরস্পরবিরোধী বিশ্লেষণ রয়েছে।
বিশ্লেষক আজিজ ইউনুস জানিয়েছেন, নওয়াজ শরিফের বার্তায় ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়ে তার ক্রমাগত চেষ্টার প্রতিফলন দেখা যায়।
বিশ্লেষক রাজা রুমিও কিন্তু একই মত পোষণ করেন। তিনি নরেন্দ্র মোদি ও নওয়াজ শরিফের মধ্যে কথোপকথনকে ইতিবাচক হিসাবে বর্ণনা করেছেন।
সরদার হামজা জাহিদ নামে এক জনৈক সোশ্যাল মিডিয়া ইউজার লিখেছেন, আন্তর্জাতিক নেতাদের বার্তার জবাব দিতে মোদির কয়েক ঘণ্টা সময় লেগেছে, কিন্তু নওয়াজ শরিফের বার্তা পাওয়ার দুই ঘণ্টা পরই তার (নরেন্দ্র মোদির) উত্তর এসেছে।
তবে আয়মাল কমল নামে এক সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী আবার মনে করেন, নরেন্দ্র মোদি তার জবাবে নওয়াজ শরিফকে উপহাস করেছেন।
অন্যদিকে, প্রধানমন্ত্রী মোদি তার জবাবে (ভারতীয়দের) নিরাপত্তার বিষয়ে কথা বলায় তার প্রশংসা করেছেন অনেক ভারতীয় সোশ্যাল মিডিয়া ইউজার।
আলোচনা শুরুর ক্ষেত্রে এক্স হ্যান্ডেলে এ বার্তা বিনিময়কে ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হলেও বিশ্লেষকরা মনে করেন দুদেশের মধ্যে বরফ গলতে এখনও কিছুটা সময় লাগতে পারে।
সাংবাদিক সুহাসিনী হায়দার বলছেন, পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নতির আগে দুই দেশে হাইকমিশনার মোতায়েন করা, কৃষি ক্ষেত্রে বাণিজ্য এবং আফগানিস্তান ট্রানজিট খোলার মতো প্রাথমিক পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।
অন্যদিকে সুধীন্দ্র কুলকার্নির মতে, দুদেশের জন্যই সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে শুধুমাত্র কাশ্মীর সমস্যা নিয়ে শান্তি ও নিরাপত্তার বিষয়ে কথা বলা। এই প্রসঙ্গে নিয়ন্ত্রণরেখায় ক্রস ফায়ারিং প্রতিরোধের বিষয় উল্লেখ করেছেন তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব আইজাজ চৌধুরী বলেন, মোদি তার অবস্থান পরিবর্তন করেন নাকি সীমান্ত সন্ত্রাস নিয়ে কথা বলতে থাকেন সেটা দেখার বিষয়। কারণ এবার পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে পাকিস্তান তাদের দেশে সন্ত্রাসবাদের জন্য ভারতীয় অপারেটিভদের দোষারোপ করছে। তার মতে, দুদেশের মধ্যে আলাপ-আলোচনা হওয়া উচিত।
আইজাজ চৌধুরী বলেন, আমার মতে, ভারত সরকার যদি পাকিস্তানের সঙ্গে কথা বলে তবে তা তাদের স্বার্থের পক্ষে হিতকর হবে। তবে সম্ভবত তাদের (ভারতের) নিশ্চয়ই কোনো গ্র্যান্ড স্ট্র্যাটেজি (দুর্দান্ত রণকৌশল) রয়েছে, যে কারণে তারা (পাকিস্তানের সঙ্গে) কথা বলতে চায় না।
আপাতত সবার সবার চোখ থাকবে জুলাই মাসে কাজাখস্তানে এসসিও (সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন) বৈঠকের দিকে, যেখানে নরেন্দ্র মোদি এবং শাহবাজ শরিফ দুজনেরই অংশ নেওয়ার কথা রয়েছে।
সূত্র: বিবিসি।