বিজেপিকে হারিয়ে ভারতের সর্বকনিষ্ঠ এমপি হলেন যে গৃহবধূ
বিবিসি বাংলা
প্রকাশ: ১০ জুন ২০২৪, ০৫:১১ পিএম
রাজস্থানের রাজধানী জয়পুর থেকে প্রায় ১৬০ কিলোমিটার দূরে আলওয়ার জেলার একটি গ্রাম সমুচী। গ্রামের সবচেয়ে বড় পাকা দোতলা বাড়ির সামনে শিশুরা খেলাধুলো করছিল। বাইরে একটা গাছের নিচে রাজস্থানি পোশাক পরে ঘোমটা মাথায় জড়ো হয়েছিলেন।
আর ঘরের ভেতরে গ্রামের আর ওই পরিবারটির কয়েকজন পুরুষ কোনো একটি বিষয়ে আলোচনা করছিলেন।
এই দোতলা বাড়িটি ভরতপুর লোকসভা আসন থেকে সদ্য নির্বাচিত সংসদ সদস্য সঞ্জনা জাটভের। ভারতের সবচেয়ে কম বয়সী সংসদ সদস্য হওয়ায় ফল ঘোষণার পর থেকেই খবরের শিরোনামে উঠে এসেছেন তিনি।
সোনালি জরি পাড়ের শাড়ি পরা, মাথায় ঘোমটা, হাতে ঘড়ি আর পায়ে চটি পরা একেবারেই সাধারণ গৃহবধূর মতো দেখতে এই নারীই সঞ্জনা জাটভ।
সঞ্জনা জাটভ ১৯৯৮ সালের পয়লা মে ভরতপুর জেলার ভুসাওয়ার গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। সাধারণ পরিবারে জন্ম নেওয়া সঞ্জনার বিয়ে হয় ২০১৬ সালে, ভরতপুর সীমান্ত সংলগ্ন আলওয়ার জেলার সমুচী গ্রামে।
বিয়ের আগে থেকেই তার স্বামী কাপ্তান সিং রাজস্থান পুলিশে কনস্টেবল পদে কর্মরত ছিলেন। স্বামীর উৎসাহে বিয়ের পরে স্নাতক হন মিজ জাটভ। তার ইচ্ছা ছিল সরকারি চাকরিতে ঢুকবেন।
বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জাটভ বলছিলেন, শ্বশুরবাড়িতে কখনও আমাকে পুত্রবধূ বলে মনে করা হয় নি, পরিবারের মেয়ে হিসাবেই দেখা হয়েছে। আমাকে পড়াশোনা করতে দিয়েছেন এরা। স্বামী সরকারি চাকরিতে ছিলেন বলে, আমিও সরকারি চাকরি করব, এমনটাই ভাবতাম। তবে ভাগ্য যা ঠিক করে রেখেছে, বাস্তবে তো সেটাই হওয়ার, তাই না?
তার স্বামী, পুলিশ কনস্টেবল কাপ্তান সিংয়ের কথায়, বিয়ের পরেও আমি তাকে স্নাতক-স্তরের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে বলি। নারীদের সম্পর্কে আমাদের পরিবারে ইতিবাচক চিন্তাভাবনা রয়েছে। সঞ্জনা রাজনীতিতে সময় দিতে চাননি, কিন্তু আমরা চেয়েছিলাম যে ও সঞ্জনা রাজনীতিতে যাক, পরিবার আর গ্রামের নাম উজ্জ্বল করুক।
সঞ্জনা জাটভ যে শুধু স্নাতক ডিগ্রি পেয়েছেন, তা নয়। এরপরে তিনি আইন পড়েছেন, এলএলবি ডিগ্রিও পেয়েছেন। তার কথায়, এসবই সম্ভব হয়েছে আমার স্বামী সবসময়ে পাশে থেকেছেন বলে।
ভোটের ফল ঘোষণার পরে জাটভের একটি ভিডিও খুব ভাইরাল হয়েছে। ওই ভিডিওতে তাকে নাচ করতে দেখা গেছে। সেই প্রসঙ্গ তুলতেই জাটভ হেসে বলেন, এত আনন্দ হয়েছিল যে আমি নাচতে শুরু করেছিলাম।
নীতীশকে প্রধানমন্ত্রীর পদ প্রস্তাব করেছিল ‘ইন্ডিয়া’ জোট!
সঞ্জনা জাটভ বলছিলেন, আমার বাবা ট্রাক্টর চালাতেন। বাপের বাড়ির দিকে কেউ কখনও রাজনীতি করেন নি। তবে, বিয়ের পর যখন তিনি শ্বশুরবাড়িতে আসেন, তখন তার মামা শ্বশুর ছিলেন গ্রামের ‘সর-পঞ্চ’ (গ্রামের প্রধান)। সেই থেকেই আমার প্রথম রাজনীতির প্রথম পাঠ শুরু হয়।
তিনি আলওয়ার জেলা পরিষদের সদস্য ছিলেন আর সেটাই ছিল রাজনীতিতে তার প্রথম সিঁড়ি।
তিনি রাহুল গান্ধীর ভারত জোড়ো যাত্রা এবং প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর ‘লাড়কি হুঁ লড় সক্তি হুঁ’ (আমি নারী, কিন্তু লড়াই করতে জানি) অভিযানেও যোগ দিয়েছিলেন।
গত বিধানসভা নির্বাচনে আলওয়ারের কাঠুমার আসন থেকে চারবারের বিধায়ক বাবুলাল বৈরওয়ার টিকিট কেটে দিয়ে সঞ্জনা জাটভকে প্রার্থী করেছিল কংগ্রেস দল। কিন্তু নির্বাচনে তিনি মাত্র ৪০৯ ভোটের ব্যবধানে হেরে যান।
তার কথায়, বিধানসভায় পরাজয়ের ধাক্কায় আমার বাবা মারা যান।
বিধানসভা নির্বাচনে পরাজয়ের পর লোকসভায় তিনি জিততে পারবেন, এমন আশা কীভাবে করেছিলেন, এই প্রশ্নের জবাবে জাটভ বলেন, জনগণ আমাকে অনেক ভালোবাসা আর সাহস জুগিয়েছে। বিধানসভা ভোটে হেরে গেছি বলে মনেই হয়নি। দলও মনে করে নি যে আমি একজন পরাজিত প্রার্থী ছিলাম। তাই আমাকে এমপি টিকিট দিয়েছে। দলের বিশ্বাসের কারণেই আমি আজ এই জায়গায় আসতে পেরেছি।
সঞ্জনা জাটভের জয়ের পরে সারা দেশে আলোচনা হচ্ছে তার কম বয়স নিয়ে। তবে রাজস্থানের সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয় হল যে তিনি বিজেপি সরকারের মুখ্যমন্ত্রী ভজন লাল শর্মার জেলায় তার দলের প্রার্থী তথা প্রাক্তন সংসদ সদস্য রামস্বরূপ কোলিকে হারিয়েছেন।
রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী ভজন লাল শর্মার নিজের জেলা ভরতপুরে বিজেপির প্রার্থীকে হারিয়ে দেওয়া কত বড় জয় তার কাছে?
সঞ্জনা জাটভের কথায়, আমি তো তাকে পরাজিত করি নি, জনগণ হারিয়েছে তাকে। তবে শুধু তার নিজের জেলায় নয়, তার নিজের গ্রাম আটারি গ্রামের তিনি পরাজিত হয়েছেন। সেখান থেকেও আমি বেশি ভোট পেয়েছি।
তার তরুণ বয়স এবং রাজনীতিতে তেমন একটা অভিজ্ঞতা না থাকায় ভরতপুরের উন্নয়নও বাধার সম্মুখীন হতে পারে, এরকম একটা আশঙ্কা নিয়ে আলোচনা চলছে।
তবে সঞ্জনা জাটভ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলছেন, আমি ভরতপুরকে উন্নয়নের নতুন দিশা দেখাব।
লোকসভা নির্বাচনের তিন দিন আগে ২৬ বছরে পা দিয়েছেন সঞ্জনা জাটভ। এর আগে রাজস্থানের কংগ্রেস নেতা শচীন পাইলট ২৬ বছর বয়সেই সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। সবথেকে কম বয়সী এমপি হওয়ার রেকর্ডটি এতদিন তারই দখলে ছিল।
সঞ্জনা জাটভ বলছিলেন, দুটি রেকর্ডেই নিজের জায়গায় থাকবে।