মিয়ানমারের ৮৬ শতাংশ চলে গেছে বিদ্রোহীদের দখলে। দেশটির বেশির ভাগ অঞ্চল বিশেষ করে সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে দেশটির ক্ষমতাসীন সামরিক জান্তা সরকার। এটা ঘটেছে মিয়ানমারের তিনটি জাতিগত বিদ্রোহী বাহিনী গত বছরের অক্টোবর মাসে সমন্বিতভাবে আক্রমণ শুরুর পর। মিয়ানমারে চলমান সংঘাত মূল্যায়ন করে বৃহস্পতিবার দুটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। তাতেই উঠে এসেছে এমন চিত্র। আলজাজিরা।
দ্য স্পেশাল অ্যাডভাইসরি কাউন্সিল ফর মিয়ানমারের (এসএসি-এম) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সাল থেকে মিয়ানমার সংঘাতের সামগ্রিক গতিপথটা এখন এমন- ‘প্রতিরোধ গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ বাড়ছে আর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে সামরিক জান্তা।’আর এই প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়েছে গত বছরের (২০২৩) অক্টোবরে। গত আট মাসে জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকাগুলো আরও বিস্তৃত করে সেখানে নিজেদের অবস্থান জোরদার করে তুলেছে।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে গণতন্ত্রপন্থি নেত্রী অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী। এরপর থেকেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটিতে অশান্তি বিরাজ করছে। সামরিক অভ্যুত্থানের পর দেশজুড়ে শুরু হওয়া বিক্ষোভ প্রতিবাদ নির্মমভাবে দমন করে জান্তা সরকার। দমনপীড়নের শিকার আন্দোলনকারীরা ও সু চির দলের নেতাকর্মীরা হাতে অস্ত্র তুলে নিয়ে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। আগে থেকেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই চালিয়ে আসা জাতিগত বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দেয় তারা।
এই সম্মিলিত বাহিনী গত বছরের অক্টোবরে ‘অপারেশন ১০২৭’ নামে জান্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে সমন্বিত আক্রমণ শুরু করে। বর্তমানে একাধিক ফ্রন্টে সম্মিলিত বিদ্রোহী ও সামরিক বাহিনীর মধ্যে লড়াই চলছে।
এতে প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো চেক পোস্ট, সামরিক ঘাঁটি ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে জান্তা সেনারা। এর ফলে ক্ষমতাসীন জান্তার দুর্বলতা ক্রমেই ফুটে উঠছে। স্পেশাল অ্যাডভাইজরি কাউন্সিল ফর মিয়ানমারের (এসএসি-এম) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৮৬ শতাংশ অঞ্চলে শহরগুলোর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে জান্তা কর্তৃপক্ষ। এসব শহর এখন পুরোপুরি বিদ্রোহীদের হাতে। এসএসি-এম বলেছে, মিয়ানমার রাষ্ট্রের মূল দায়িত্ব পালন করার মতো পর্যাপ্ত অঞ্চল আর সামরিক জান্তার নিয়ন্ত্রণে নেই। জান্তা উল্লেখযোগ্য অঞ্চল ছেড়ে এসেছে এবং এখনো দেশের যেসব এলাকার তাদের উপস্থিতি আছে তার অধিকাংশেই আত্মরক্ষামূলক অবস্থান নিতে বাধ্য হচ্ছে। গত বছরের অক্টোবরে মিয়ানমারের তিনটি জাতিগত বিদ্রোহী বাহিনী সমন্বিতভাবে আক্রমণ শুরু করার পর থেকে সামরিক বাহিনীর দুর্বলতা স্পষ্ট হতে শুরু করে।
তারপর থেকে জাতিগত বাহিনীগুলোর ধারাবাহিক আক্রমণে জান্তা বাহিনী পূর্বে থাইল্যান্ডের সঙ্গে থাকা দেশটির প্রায় সব সীমান্ত অঞ্চলের এবং পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর উপকূলের বহু অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ হারায়। আন্তর্জাতিক অলাভজনক গোষ্ঠী ক্রাইসিস গ্রুপ তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, অনেক সামরিক জয় পাওয়া জাতিগত সশস্ত্র বাহিনীগুলো তাদের বিস্তৃত নিজস্ব আবাসভূমিতে নিয়ন্ত্রণ জোরদার করেছে আর অনেকে খুদে স্বায়ত্তশাসিত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিকেও এগোচ্ছে। ক্রাইসিস গ্রুপের ভাষ্য অনুযায়ী, সামরিক বাহিনীর ক্রমবর্ধমান পরাজয়ে রাজধানী নেপিদোর অভিজাতদের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে, যা জান্তা প্রধান মিং অং হ্লাইংয়ের ভবিষ্যৎকে গুরুতর সন্দেহের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। যদিও তিনি তার অনুগত কর্মকর্তাদের সামরিক বাহিনীর জ্যেষ্ঠ পদগুলোতে পদায়ন করে রেখেছেন।
গোষ্ঠীটি বলেছে, হ্লাইং হয়ত এভাবে তার পদ ধরে রাখতে পারবেন। কিন্তু ক্রমবর্ধমান অসন্তোষের কারণে উৎখাতের চক্রান্তের মুখোমুখি হতে পারেন। মিয়ানমারের সীমান্ত অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ হারানো অব্যাহত থাকলে আর অ-রাষ্ট্রীয় প্রশাসন বাড়তে থাকলে প্রতিবেশী দেশগুলো, আঞ্চলিক জোটগুলো এবং আন্তজার্তিক মহল প্রতিরোধকারীদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ বাড়িয়ে তুলতে পারে, উভয় প্রতিবেদনে এমনটি বলা হয়েছে।