ফাইল ছবি
পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচন উদ্বেগ, রাজনৈতিক অস্থিরতা, দমন-পীড়ন ও সহিংসতার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই নির্বাচনের মাধ্যমেই গঠিত হবে পরবর্তী সরকার। তবে দেশটির প্রায় সব নির্বাচনের ফলের ওপর সেনাবাহিনীর প্রচ্ছন্ন প্রভাব থাকে বলেই ধারণা আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের।
সর্বশেষ অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে নওয়াজ শরিফ চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
তবে এই জয়ের পেছনে নওয়াজের জনপ্রিয়তাই নয়; বরং তার পেছনে কাজ করছে দেশটির সেনাবাহিনীর সমর্থন।
আরও পড়ুন: ইমরানের সমর্থিত প্রার্থীর কাছে হারলেন নওয়াজ শরিফ
অন্যদিকে দেশটির সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা ইমরান খান তিন মামলায় দণ্ডিত হয়ে আছেন নির্বাচনের বাইরে। আদালতে তেহরিক-ই-পাকিস্তানের দলীয় প্রতীক ব্যাট বাতিল হওয়ায় দলটির প্রার্থীরা লড়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে।
ইমরান খানের মতো নওয়াজ শরিফের বিরুদ্ধেও উঠেছিল দুর্নীতির অভিযোগ। সেই দুর্নীতি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে ২০১৭ সালে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন। শেষমেশ বাধ্য হন দেশ ছাড়তেও। নওয়াজের ক্ষমতায় আসীন ও পদচ্যুত হওয়ার পেছনে যেমন হাত ছিল দেশটির সেনাবাহিনীর, ইমরানের বেলাতেও তাই। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর থেকেই দেশটির রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে আসছে সেনাবাহিনী।
পাকিস্তানে সামরিক অভ্যুত্থান তো বটেই, এমনকি সরকারের গঠন কিংবা পতনের মতো বিষয়গুলোতেও অতীতে দেশটির সামরিক বাহিনীর ভূমিকা দেখা গেছে। কিন্তু দেশটির রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর এমন শক্তিশালী হয়ে ওঠার কারণ কী?
আর নির্বাচনের বাইরে থাকা ইমরান খানের ভবিষ্যৎইবা এখন কোন দিকে যাচ্ছে? এমন প্রশ্ন এখন পাকিস্তানের রাজনীতিতে ঘুরপাক খাচ্ছে। সামরিক বাহিনী কীভাবে রাজনীতিতে শক্তিশালী হয়ে উঠল?
আরও পড়ুন: মালদ্বীপের সঙ্গে ভারতের টানাপোড়েন, কী বার্তা দিল যুক্তরাষ্ট্র
এটার উত্তর লুকিয়ে আছে দেশটির ইতিহাসে। আরও স্পষ্ট করে বললে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের পরবর্তী কয়েক বছরে। এখানে চারটি ঘটনা তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথমটি হচ্ছে, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার এক বছরের মাথায় দেশটির প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মৃত্যু।
দ্বিতীয় ঘটনা, জিন্নাহর মৃত্যুর তিন বছরের মাথায় দেশটির আরেক শীর্ষ নেতা এবং তখনকার প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের গুলিতে নিহত হওয়া। এই দুই মৃত্যু পাকিস্তানের রাজনীতিতে নেতৃত্বের শূন্যতা তৈরি করেছিল।
তৃতীয় ঘটনা হচ্ছে, এই একই সময়ে কাশ্মীর নিয়ে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ দেশটিতে নিরাপত্তা সংকটও তৈরি করে। দেশটির সেনাবাহিনী নিরাপত্তা এবং বিদেশনীতিতে ভূমিকা রাখতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। কারণ তারা রাজনৈতিক নেতৃত্বের গৃহীত পদক্ষেপে সন্তুষ্ট ছিল না।
চতুর্থ বিষয় হচ্ছে, দেশটির রাজনৈতিক নেতারা এমনকি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ নিজেও শুরু থেকেই গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে না নিয়ে এক ধরনের কর্তৃত্ববাদী শাসনের দিকে হাঁটতে শুরু করেন। যেটা পরে দেশে অনৈক্য তৈরি করে।
এসব কিছু মিলেই পাকিস্তানে এমন একটা পরিস্থিতির উদ্ভব হয়, যেটা দেশটির সেনাবাহিনীকে রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ তৈরি করে দেয়।
পাকিস্তানের সামরিক বিশ্লেষক ইকরাম সেহগাল বলেন, পাকিস্তানে একটা ন্যারেটিভ আছে যে, আর্মি ছাড়া পাকিস্তানের অস্তিত্ব থাকবে না। কারণ দেশটিতে বহু জাতি, বহু বিভক্তি এবং নিরাপত্তার বহু সংকট আছে। ফলে সেখানে আর্মি পাকিস্তানকে টিকিয়ে রেখেছে। এটা হচ্ছে সামরিক দিক। এর বাইরেও আর্মি বাণিজ্যিকভাবেও শক্তিশালী এবং জনগণের মধ্যেও তার জনপ্রিয়তা আছে। তার চেয়ে বড় কথা— রাজনৈতিক দলগুলোই সেনাবাহিনীকে হস্তক্ষেপ করার অজুহাত তৈরি করে দিচ্ছে।
তার মতে, এ ক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন সবচেয়ে বড় এজেন্ডা হয়ে ওঠে পাকিস্তানে। রাজনৈতিক দলগুলো কেন সামরিক বলয়ে? পাকিস্তানে সর্বশেষ সামরিক অভ্যুত্থান ঘটেছিল ১৯৯৯ সালে। সে সময় ক্ষমতায় আসা পারভেজ মোশাররফের বিদায় ঘটে ২০০৭ সালে।
ইমরান খানের ভবিষ্যৎ কী?
এতো কিছুর মধ্যেই এখন এটা স্পষ্ট, পাকিস্তানের নির্বাচনে এখন যে দলই জিতুক তাকে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সমঝোতা করেই ক্ষমতায় আসতে এবং থাকতে হবে। কিন্তু তা হলে সেনা নিয়ন্ত্রণের এই রাজনীতিতে ইমরান খানের ভবিষ্যৎ কী? তার দল এবং রাজনীতি কি টিকে থাকতে পারবে?
দেশটির সামরিক বিশ্লেষক ইকরাম সেহগাল বলছেন, ইমরানের সামনে সে সুযোগ আছে এখনো। এর বড় কারণ হচ্ছে, তার বড় রাজনৈতিক সমর্থক গোষ্ঠী আছে। তার দল নির্বাচনে জিতে যাবে এমনটা কেউ আশা করছে না। কিন্তু পরাজিত হলেও তার প্রার্থীরা যদি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আসনে জিতে আসতে পারে, তা হলে সেটা তাকে সরকার এবং সেনাবাহিনীর সঙ্গে দর কষাকষির শক্তি এনে দেবে। এ ছাড়া তিনি পিপিপি, জামায়াতে ইসলামীর মতো দলগুলোর সঙ্গেও সমঝোতায় গিয়ে নিজের একটা অবস্থান তৈরি করতে পারেন। সুতরাং ইমরান খানের রাজনীতির ভবিষ্যৎ শেষ হয়ে যায়নি।
পাকিস্তানে এর আগেও সামরিক বাহিনীর সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে ক্ষমতা ছাড়ার, এমনকি দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ারও ইতিহাস আছে। পরে আবারও সোবাহিনীর সঙ্গে সমঝোতায় রাজনীতিতে ফিরে আসার নজিরও আছে। নওয়াজ শরিফ নিজেই একাধিকবার সে উদাহারণ তৈরি করেছেন।
ফলে যেকোনো নতুন রাজনৈতিক দৃশ্যপটে ইমরান খানেরও সে সুযোগ আছে বলেই মনে করা হচ্ছে। কিন্তু রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর যে নিয়ন্ত্রণ, পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলো খুব সহসাই সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে এমন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।