পাকিস্তানের নতুন সরকারের পথে ৫ কাঁটা
জেনারেলদের মন রক্ষাই হবে বড় চ্যালেঞ্জ
যুগান্তর ডেস্ক
প্রকাশ: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১০:২১ পিএম
পাকিস্তানে দীর্ঘদিন ধরেই আধিপত্য বিস্তার করে আসছে সামরিক বাহিনী। দেশটিতে গত ৭৬ বছরের ইতিহাসে কোনো প্রধানমন্ত্রী ৫ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করেননি। নির্বাচিত সরকার সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে বারবার।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এর ভূমিকা আরও ব্যাপক হয়েছে। এমনকি বৃহস্পতিবার নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা নতুন সরকারের বেলায়ও সামরিক বাহিনীর ভূমিকার হেরফের ঘটবে না। জেনারেলদের মন রক্ষাই হবে নতুন সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ। নিজস্ব নীতিনির্ধারণ থেকে শুরু করে দেশের যে কোনো সিদ্ধান্তে শক্তিশালী জেনারেলদের খুশি রাখার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখাই হবে সরকারের প্রধান কাজ। রয়টার্স, আলজাজিরা।
সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ ছাড়াও অর্থনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও সীমান্ত সুরক্ষাসহ নতুন সরকারের পথে আটকে রয়েছে পাঁচ বিষাক্ত কাঁটা। এর মধ্যে অন্যতম হলো অর্থনৈতিক সংকট। অনেকদিন থেকেই অর্থনৈতিক সংকটে ভুগছিল দেশটি। বৈদেশিক রিজার্ভ ৪.৪ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছিল।
মুদ্রাস্ফীতির পরিমাণ ৩০ শতাংশের কাছাকাছি। দেশটির ৪০ শতাংশের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছেন। প্রতিনিয়তই বাড়ছে রুপির অবমূল্যায়ন।
অর্থনৈতিক বিপর্যয় এড়াতে গত বছরের জুনে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ৩ বিলিয়ন ডলারের একটি একটি বেলআউট প্যাকেজ গ্রহণ করেছিল দেশটির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ সরকার। গত বছরের আগস্টে পাকিস্তানের অন্তর্র্বর্তী সরকারও ক্ষমতা গ্রহণের পর এই আইএমএফ প্রোগ্রামের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে প্রাথমিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিল।
এই আইএমএফ প্রোগ্রামের মেয়াদ শেষ হবে চলতি বছরের মার্চে। বিশ্লেষকরা জোর দিয়েছেন, দেশের অর্থনৈতিক স্থীতিশীলতা বজায় রাখতে আইএমএফের সঙ্গে একটি নতুন বর্ধিত কর্মসূচিতে প্রবেশ করতে হবে। ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই নতুন সরকারের জন্য এই বর্ধিত কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা করা হবে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রেও সংকটের বর্তমানে সংকটের মুখোমুখি পাকিস্তান।
কারণ সরকারের অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখবে সামরিক বাহিনী। স্পেশাল ইনভেস্টমেন্ট ফ্যাসিলিটেশন কাউন্সিল নামের একটি নতুন উচ্চ-ক্ষমতাসম্পন্ন সংস্থার প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে আনুষ্ঠানিকভাবে সেনাবাহিনী ভূমিকা রাখা শুরু করেছে। এছাড়া পাকিস্তানের আরও অনেক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের প্রধান পদ দখল করে আছেন অবসরপ্রাপ্ত অথবা বর্তমানে দায়িত্বরত অনেক জেনারেল।
ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্য দিয়েও যাচ্ছে পাকিস্তান। দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ও তার দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) অন্যান্য নেতার বিরুদ্ধে চলছে একের পর এক ক্র্যাকডাউন। গত আগস্ট থেকে কারাগারে আছেন ইমরান খান। এমনকি গতকালের নির্বাচনেও অংশ নিতে পারেনি পিটিআই। স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন দলের প্রার্থীরা। কারণ নির্বাচনের আগেই ইমরান খানের দলের ‘ব্যাট’ প্রতীক বাতিলসহ পিটিআইকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে অযোগ্য ঘোষণা করেছে পাকিস্তান নির্বাচন কমিশন (ইসিপি)।
তবে জেলে থেকেও ব্যাপক জনসমর্থন বজায় রেখেছেন ইমরান খান। নির্বাচনের আগের দিনও বোমা হামলায় প্রাণ গেছে অন্তত ২৬ জনের। দেশটির গণমাধ্যমের তথ্যমতে, গেল এক বছরে সহিংসতায় প্রাণহানির সংখ্যা ১ হাজারের বেশি। এমন অবস্থায় পাকিস্তান যেন বারবার কোনো রাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যে দিয়ে না যায় সে বিষয়েও খেয়াল রাখতে হবে পাকিস্তানের নতুন সরকারকে। কারণ বর্তমানে অর্থনীতিকে চাঙা করতে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের ক্ষেত্রে দেশে স্থিতিশীলতার প্রয়োজন।
পাকিস্তানে ২০১৪ সালে সামরিক অভিযানের মাধ্যমে অনেক ইসলামপন্থি দল প্রতিবেশী দেশ আফগানিস্তানে বিতাড়িত হয়েছিলেন। তবে গত ১৮ মাস অর্থাৎ প্রায় দেড় বছর ধরে দেশে জঙ্গি হামলা বেড়েছে।
২০২১ সালে আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতায় আসার পর তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) পুনর্গঠিত হয়। দলটি ন্যাটো-নেতৃত্বাধীন বাহিনীগুলোর রেখে যাওয়া উন্নত অস্ত্র ব্যবহার করছে বলেও জানা গেছে। পাকিস্তানে জঙ্গিরা একের পর এক হামলাও চালিয়েছে। কিন্তু পাকিস্তান বর্তমানে অর্থনৈতিক সংকটে থাকায় আরেকটি টেকসই সামরিক অভিযানে অর্থায়ন করার ক্ষমতাও নেই ইসলামাবাদের।
আফগানিস্তান ছাড়া ইরানের সঙ্গেও সংঘর্ষে জড়িয়েছে পাকিস্তান। গত মাসে এক দেশ আরেক দেশের ওপর কথিত ‘জঙ্গি ঘাঁটিতে’ টিট-ফর-ট্যাট বিমান হামলা চালিয়েছে। এই হামলার মাধ্যমে পশ্চিম সীমান্তে পাকিস্তানের জন্য একটি নতুন নিরাপত্তা উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
চলতি বছরের মে মাসের মধ্যে নির্বাচন করতে যাচ্ছে ভারত। আর ভারী ম্যান্ডেট নিয়ে ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকারের ক্ষমতায় ফিরে আসা পাকিস্তানের নতুন সরকারের জন্য চলমান সমস্যাগুলোকে আরও জটিল করে তুলতে পারে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সীমান্ত সমস্যার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়েও ভাবতে হবে পাকিস্তান সরকারকে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক অবনতির ফল কী হতে পারে তা দেখেছেন ইমরান খান। অন্যদিকে দেশটির দীর্ঘদিনের মিত্র চীন। দুই বিশ্ব পরাশক্তির সঙ্গেই সম্পর্ক স্বাভাবিক করে চলবে, নাকি কোনো একটিকে বেছে নেবে পাকিস্তান; সেটিও ঠিক করতে হবে নির্বাচনের পরই।