যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় দেখা দিয়েছে নতুন সংকট। ধরা-ছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম। বিশেষ করে খাদ্য ও বস্ত্রের মূল্য রীতিমতো আকাশচুম্বী! যুদ্ধকালীন ভয়াবহতার মাঝে হঠাৎ মূল্যবৃদ্ধির এ ঘটনায় জনমনে দেখা দিয়েছে চরম ক্ষোভ। যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা! ভিটেবাড়ি, সহায়-সম্বল হারিয়ে এমনিতেই মৌলিক চাহিদা মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে, তার ওপর বেকারি-দোকান-বাজারে দাউদাউ করে জ্বলছে দ্রব্যমূল্যের আগুন।
অবস্থা এমন যে, বাজার করতে গিয়ে এখন খালি হাতেই বাড়ি ফিরছেন বেশির ভাগ গাজাবাসী। খেয়ে-পরে বেঁচে থাকাই এখন নতুন চ্যালেঞ্জ অবরুদ্ধ গাজায়। এ ঘটনায় একদিকে দোকান মালিকদের দোষ দিচ্ছে সাধারণ জনগণ। আর দোকানদারদের দাবি, খুচরা ব্যবসায়ীদের কারণেই বাড়ছে জিনিসপত্রের দাম। আলজাজিরা।
৭ অক্টোবর থেকে ইসরাইলের চালানো তাণ্ডবে ভয়াবহ খাদ্য সংকটে পড়েছে গাজা। শীতকাল হওয়ায় বেড়েছে পোশাকের চাহিদাও। কিন্তু বর্তমানে খাদ্য ও বস্ত্র- এই দুই পণ্যেরই মূল্য দ্বিগুণ হারে বেড়েছে। ইম আবদুল্লাহ নামে নাসের পাড়ার এক বাসিন্দা জানান, তিনি বাজারে খাবার ও শীতের কাপড় কিনতে এসেছিলেন। কিন্তু দোকানে সব কিছুরই মূল্য বেশি। তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা যখন বলে দাম তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে, এটা আমার বিশ্বাস হয় না। তারা দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। সংকটকালীন এ সময়ে অন্তত তাদের সুবিধা নেওয়া উচিত নয়।’ যুদ্ধ শুরুর আগে এবং পরের বাজারদর নিয়ে একটি তালিকা তৈরি করেছেন ইম আবদুল্লাহ। সেই তালিকা অনুসারে, বোতলজাত পানির মূল্য ২ শেকেল ছিল, যা বর্তমানে ৪ বা ৫ শেকেল। এক কিলো লবণের দাম ১ শেকেল ছিল, যা এখন ১২ শেকেল। অন্যদিকে চিনির মূল্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫ শেকেল। যুদ্ধের আগে মাত্র ৫ শেকেলেই পাওয়া যেত ৩ কেজি আলু। এখন এক কেজি আলুর দামই ২৫ শেকেল! ১০০০ শেকেলে নামমাত্র কিছু খাদ্যসামগ্রী পাওয়া যায়! পোশাকের ক্ষেত্রেও একই পরিস্থিতি। আগে ২০-২৫ শেকেলেই পাওয়া যেত একটি ট্র্যাকসুট। সম্প্রতি মূল্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৫ শেকেলে। আবদুল্লাহ বলেন, ‘এটা খুব অন্যায়। আমি আর নিতে পারছি না। আমি সমুদ্রের ধারে বসে কাঁদি!
কারণ আমি জানি না কিভাবে আমার পরিবারকে টিকিয়ে রাখতে পারি।’ অন্যদিকে ১৮ বছর বয়সি আহমদ আবুলনাজা বলেন, ‘উত্তর গাজা এখন বাকি অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন, এমন পরিস্থিতিতে একজন ব্যবসায়ীকে নির্ধারিত মূল্য থেকে পণ্য বিক্রি করা থেকে বিরত রাখা উচিত নয়। আমাদের আগের অবস্থায় ফিরে যেতে আরও পাঁচ বছর লাগবে।’
যুদ্ধকালীন অবরুদ্ধ গাজায় দরিদ্রতা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। ফিলিস্তিনের কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান ব্যুরো অনুসারে, গাজা উপত্যকায় দারিদ্র্যের হার ৫৩ শতাংশে পৌঁছেছে। দেশটির এক-তৃতীয়াংশ (৩৩.৭ শতাংশ) বাসিন্দা চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করছে।
গাজার প্রায় ৬৪ শতাংশ পরিবার পর্যাপ্ত খাদ্যহীন। বেকারত্ব বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৭ শতাংশে। এর ওপর জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় বেঁচে থাকাই কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি অবরুদ্ধ গাজা মুদ্রাস্ফীতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। গাজাভিত্তিক অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ইলহাসান বকরের মতে, পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় জন্য গাজা ৩০০ থেকে ২,০০০ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। চলমান পরিস্থিতি নিয়ে তিনি বলেন, ‘ইসরাইলের আক্রমণ গাজার অর্থনীতিতে ধস নিয়ে এসেছে।
বেসরকারি খাতের প্রত্যক্ষ ক্ষতি প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। যখন পরোক্ষ ক্ষতি প্রায় ১.৫ বিলিয়নের বেশি। কৃষি খাতে ক্ষতির পরিমাণ ৩০০ মিলিয়নে ডলারেরও বেশি।’ এমনকি বর্তমানে গাজার বাসিন্দাদের জন্য যে ত্রাণ পাঠানো হচ্ছে তাও যথেষ্ট নয়। তিনি আরও বলেন, ‘২২ অক্টোবর থেকে ১২ নভেম্বর পর্যন্ত ২০ দিনে ১,১০০ টিরও কম ট্রাক গাজা উপত্যকায় প্রবেশ করেছে। এতে চাহিদার মাত্র ১০ শতাংশ পূরণ হয়। ২.৩ মিলিয়ন জনসংখ্যার চাহিদা সরবরাহ করতে প্রতিদিন ১,০০০ থেকে ১,৫০০ ট্রাকের প্রয়োজন।’