Logo
Logo
×

আন্তর্জাতিক

বাইফোকাল লেন্স

প্রিগোজিনের মৃত্যু কি দুই মাস আগেই নির্ধারিত হয়েছিল?

Icon

একেএম শামসুদ্দিন

প্রকাশ: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিগোজিনের মৃত্যু কি দুই মাস আগেই নির্ধারিত হয়েছিল?

অনেকেই বলেন, রাশিয়ার ভাড়াটিয়া বাহিনী ভাগনারপ্রধান যুদ্ধবাজ ইয়েভজেনি প্রিগোজিনের মৃত্যু দুই মাস আগেই নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। গত জুনে প্রিগোজিন যখন রাশিয়ার সামরিক নেতৃত্বকে উৎখাতের উদ্দেশ্যে ত্রিশ হাজার সদস্য নিয়ে মস্কো অভিমুখে রওনা দিয়ে ব্যর্থ হয়েছিলেন, তখনই তার আয়ু ফুরিয়ে এসেছে বলে অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকই মন্তব্য করেছিলেন। প্রিগোজিনের সেই সাড়া জাগানো বিদ্রোহের পর রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন তাৎক্ষণিকভাবে এ বিদ্রোহকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’ আখ্যায়িত করেছিলেন। প্রিগোজিনকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ আখ্যা দিয়ে তার এরূপ কর্মকাণ্ডকে তিনি তখন ‘পিঠে ছুরি মারা’র সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। তারপরই ধারণা করা হয়েছিল, প্রিগোজিন পুতিনের নিশানায় পরিণত হয়েছেন। পুতিন তাৎক্ষণিক মারাত্মক কোনো ব্যবস্থা না নিলেও মৃত্যুর ছায়া ঠিকই প্রিগোজিনকে অনুসরণ করছিল। ২৩ আগস্ট সন্ধ্যায় এক বিমান দুর্ঘটনায় প্রিগোজিনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তা বাস্তবে রূপলাভ করেছে বলে অনেকেই মনে করছেন।

প্রিগোজিন যেদিন বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান, সেই পুতিন ইউক্রেনের বাখমুত যুদ্ধের সময় প্রিগোজিনের পরামর্শদাতা রাশিয়ার এরোস্পেস বাহিনীর কমান্ডার সের্গেই সুরোভিকিনকে বরখাস্ত করেন। ভাগনার বাহিনীর মস্কো অভিমুখে যাত্রা পুতিনকে এতই বিক্ষুব্ধ করেছিল যে, প্রিগোজিনের সংস্পর্শে আসা গুরুত্বপূর্ণ সামরিক কর্মকর্তা হিসাবে পরিচিত সুরোভিকিনকেও রেহাই দেননি। প্রিগোজিনের বিদ্রোহের পর গত দুই মাস ধরে সুরোভিকিনকে প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। তার ভাগ্যে কী ঘটেছে তা এখন পর্যন্ত বোঝা যাচ্ছে না। পুতিন কেজিবিতে থাকাকালীন এমন কিছু অভ্যাস আয়ত্ত করেছিলেন যে, তার কিছু কিছু নমুনা আমরা পরবর্তীকালে দেখতে পাই। বিরোধীদের শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে পুতিন বড় বেশি হিসাবি। অন্য কোনো অপরাধের জন্য মাঝে-মধ্যে ক্ষমা করে দিলেও বিশ্বাসঘাতকদের তিনি কখনোই ক্ষমা করেন না। কারও ওপর অসন্তুষ্ট হলে কিংবা কাউকে শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে, ঠান্ডা মাথায় তিনি তা বাস্তবায়ন করেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা প্রিগোজিনের মৃত্যুর ঘটনাকেও পুতিনের ঠান্ডা মাথার কাজ বলে মনে করছেন।

গত জুনে বিদ্রোহের পর অনেকেই মনে করেছিলেন, পুতিন হয়তো প্রিগোজিনকে কঠোর শাস্তি দেবেন; কিন্তু পুতিন সে পথে হাঁটেননি। তিনি প্রিগোজিনকে শাস্তি না দিয়ে বেলারুশে নির্বাসনে পাঠালে অনেকেই তখন বিস্মিত হয়েছিলেন। মনে করা হয়েছিল, প্রিগোজিন পুতিনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েও শাস্তি এড়াতে পেরেছেন। বেলারুশ প্রেসিডেন্টের মধ্যস্থতায় তখন সিদ্ধান্ত হয়েছিল, প্রিগোজিন তার ভাড়াটে যোদ্ধাদের নিয়ে বেলারুশে অবস্থান করবেন। তবে পুতিন প্রিগোজিনকে রাশিয়ায় যাতায়াতের সুযোগও করে দেন। গত জুলাই মাসেও প্রিগোজিনকে সাধারণ পোশাকে সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরে দেখা গিয়েছিল। বিদ্রোহের অবসানের পর প্রিগোজিন তার নিরাপত্তা নিয়ে যতটুকু সতর্ক ছিলেন, বাধাহীন চলাফেরার কারণে ধীরে ধীরে সে বিষয়ে হয়তো কিছুটা ভাটা পড়ে গিয়েছিল। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এমন অবাধে চলাফেরার সুযোগ দেওয়ার পেছনে প্রিগোজিনকে নিয়ে পুতিনের হয়তো গভীর কোনো চিন্তা-ভাবনা ছিল। কিছুটা স্পষ্ট করে বলা যায়, এটি বিশ্বাসঘাতকের বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত শাস্তি দেওয়ার জন্য পুতিনের ঠান্ডা মাথার নতুন কোনো কৌশল ছিল।

প্রতিশোধ নেওয়া কিংবা পথের কাঁটা সরিয়ে ফেলার ক্ষেত্রে পুতিনের পূর্বের রেকর্ড তেমন ভালো নয়। দুই দশকের বেশি সময় ধরে যাদের হুমকি বলে মনে হয়েছে, তাদের অনেককেই নির্বাসিত, বন্দি কিংবা মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। অতীতে ভিন্নমতাবলম্বী রাজনীতিবিদ, কূটনীতিক, মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক এবং ব্যবসায়ীদের বিষ প্রয়োগ, নার্ভ গ্যাস প্রয়োগ, গুলি করে হত্যা, কিংবা উঁচু ভবন থেকে নিচে ফেলে মেরে ফেলার এমন অনেক রেকর্ড আছে। পুতিন ক্ষমতায় আসার পর থেকে তার অন্তত বিশজন প্রতিপক্ষ, সমালোচক বা ‘বিশ্বাসঘাতক’ খুব অদ্ভুতভাবে মারা গেছেন। তবে প্রতিপক্ষ ও সমালোচকদের মারা যাওয়ার এ তালিকা শুধু রাশিয়াতেই সীমাবদ্ধ নয়। যারা বিদেশে চলে গিয়েছিলেন, তারা হয়তো ভেবেছিলেন, রাশিয়ার বাইরে গেলে নিরাপদে থাকবেন; এমন অনেকে বিদেশে পাড়ি দিয়েও রহস্যজনক মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচতে পারেননি। যে প্রভাবশালী ব্যবসায়ী বরিস বেরেজোভস্কি, পুতিনের প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিপুল অর্থ জোগান দিয়েছিলেন, সেই বেরেজোভস্কিও তার হাত থেকে রক্ষা পাননি। পুতিনের সঙ্গে মতপার্থক্য হওয়ায় তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েও নিজেকে রক্ষা করতে পারেননি। ২০১৩ সালের মার্চে এ ব্যবসায়ীর রহস্যজনক মৃত্যু হয়। তার মৃতদেহ পাওয়া যায় যুক্তরাজ্যে তার নিজ বাড়িতে। ২০১৮ সালের মার্চে যুক্তরাজ্যে নির্বাসনে থাকা ভিন্নমতাবলম্বী আরেক রাশিয়ান হামলার শিকার হন বলে অভিযোগ ওঠে। সাবেক গুপ্তচর সের্গেই স্ক্রিপাল এবং তার মেয়ে ইউলিয়াকে বিষ প্রয়োগে মারার চেষ্টা করা হয়েছিল বলে জানা যায়। বিদেশের মাটিতে রহস্যজনক যতগুলো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল, তার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত নাম সাবেক গুপ্তচর আলেক্সান্ডার লিতভিনেঙ্কো; যিনি ২০০৬ সালে নভেম্বরে হঠাৎ অসুস্থবোধ করে লন্ডন হাসপাতালে মারা যান। পরে এক তদন্তে জানা যায়, সাবেক এ গুপ্তচর পলোনিয়াম ২১০-এর বিষক্রিয়ায় মারা গিয়েছেন, যা খুবই উচ্চমাত্রার একটা রেডিওঅ্যাকটিভ পদার্থ। রাশিয়ার অভ্যন্তরেও সমালোচক এবং ব্যবসায়ীদের এক দীর্ঘ তালিকা রয়েছে, যারা আকস্মিক মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন, তাদের কেউ কেউ ‘বাড়ির ওপর তলার জানালা থেকে পড়ে’ গিয়ে মারা গিয়েছেন। রাশিয়া এবং রাশিয়ার বাইরে ঘটে যাওয়া এমন অদ্ভুত মৃত্যুর তালিকা এত দীর্ঘ যে, এ অল্প পরিসরে তা বর্ণনা করাও সম্ভব নয়।

প্রিগোজিন প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। কথিত আছে, চেচনিয়ায় যুদ্ধ করা একজন রুশ সেনা কর্মকর্তা দিমিত্রি উতকিন ভাগনার বাহিনী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। উতকিনের পরে প্রিগোজিন এ বাহিনীর প্রধান হন। ভাগনার বাহিনীতে তার সম্পৃক্ত হওয়ার পেছনে পুতিনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে বলে জানা যায়। তরুণ বয়সে প্রিগোজিনের জীবনধারা নানা জটিলতার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে। এর মধ্যে জীবনের দশটি বছর কারা অভ্যন্তরেই কেটে গেছে তার। কারাগার থেকে বেরিয়ে তিনি ব্যবসায় মন দেন। প্রিগোজিনের রেস্তোরাঁর ব্যবসা ছিল। নব্বই দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের শুরুর সময়ে সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরে একটি বিলাসবহুল রেস্তোরাঁ ছিল তার। শহরের বিত্তবান, ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের যাওয়া-আসা ছিল ওই রেস্তোরাঁয়। এভাবেই ক্ষমতাধর ও প্রভাবশালীদের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ ঘটে প্রিগোজিনের। পুতিনেরও বেশ পছন্দ ওই রেস্তোরাঁ। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরও পুতিন তার বিদেশি অতিথিদের নিয়ে ওই রেস্তোরাঁয় যেতেন। এভাবেই পুতিনের সঙ্গে প্রিগোজিনের পরিচয় এবং ঘনিষ্ঠতা হয়। পুতিনের সুবাদেই তিনি পেয়ে যান ক্রেমলিনে খাবার সরবরাহের কন্ট্রাক্ট। এরপর, এভাবেই সামরিক বাহিনী ও সরকারি বিদ্যালয়ে খাবার সাপ্লাইয়ের কাজও পেয়ে যান তিনি। ক্রেমলিনের খাবার সরবরাহের মধ্য দিয়ে ‘পুতিনের পাঁচক’ হিসাবে পরিচিতি পান প্রিগোজিন। পরবর্তীকালে পুতিনের পরামর্শ ও সহযোগিতায় প্রিগোজিন ভাগনার বাহিনীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন; কিন্তু পুতিন কি তখন জানতেন, সামান্য রেস্তোরাঁ ব্যবসা থেকে উঠে আসা যে প্রিগোজিনকে বেসরকারি বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ পদে বসতে সহযোগিতা করেছিলেন, সেই প্রিগোজিনই একদিন, অস্ত্র ও জনবল নিয়ে তার সামরিক কর্তৃপক্ষকে উৎখাতের উদ্দেশ্যে মস্কো অভিমুখে যাত্রা করবে?

প্রশ্ন হচ্ছে, প্রিগোজিনের অবর্তমানে ভাগনার বাহিনীর কী হবে? প্রিগোজিনের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ভাগনার বাহিনীও কি ভেঙে যাবে? সাধারণত যে কোনো বাহিনীপ্রধানের অবর্তমানে উপপ্রধান সে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। ভাগনার বাহিনীর এখন কি সে সুযোগ আছে? ২৩ আগস্ট শুধু প্রিগোজিনের মৃত্যুই ঘটেনি; ভাগনার বাহিনীরও মৃত্যুঘণ্টা বেজে গেছে। সেদিন প্রিগোজিনের সঙ্গে ভাগনার বাহিনীর আরও একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি দিমিত্রি উতকিনও প্রাণ হারিয়েছেন। ভাগনার বাহিনীতে জ্যেষ্ঠতার ক্রমানুসারে প্রিগোজিনের পরেই দিমিত্রি উতকিনের স্থান। তিনি ভাগনার বাহিনীর উপপ্রধানের দায়িত্ব পালন করছিলেন। প্রিগোজিন ও উতকিন ছাড়াও সেদিন দুর্ঘটনায় ভাগনার বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ পদের অন্য সদস্যরাও একই ফ্লাইটে ছিলেন। প্রথাগত নিয়ম অনুসারে বাহিনীপ্রধান ও উপপ্রধান এভাবে একইসঙ্গে কোথাও মুভ করেন না। এ প্রথা অনুসরণ করা হয় এজন্য যে, বাহিনীপ্রধানের অবর্তমানে উপপ্রধান যেন ‘কমান্ড’ নিজ হাতে তুলে নিয়ে বাহিনীকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে প্রিগোজিন সে প্রথা অনুসরণ করেননি। হয়তো অনুসরণ করার উপায়ও ছিল না। তার এ ভুলের মাশুল দিতেই হবে। সামরিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রিগোজিন নিজ হাতে যেভাবে ভাগনার বাহিনী গড়ে তুলেছেন, এ সংকটকালে তার অবর্তমানে এ বাহিনী হয়তো অস্তিত্বহীন হয়ে পড়বে। এ ছাড়া বাহিনীর অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির মৃত্যু এ সংকটকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। তাদের অবর্তমানে ভাগনার বাহিনী টিকে থাকবে কিনা সে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। প্রিগোজিন ও তার সঙ্গীদের এ মৃত্যু পুতিনের জন্য পোয়াবারো হয়েছে। কে জানে, পুতিন হয়তো এরকমই চেয়েছিলেন।

একেএম শামসুদ্দিন: অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম