প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বিরোধিতার নির্মম শিকার রাশিয়ার ভাড়াটে সেনাদের দল ওয়াগনার গ্রুপের প্রধান ইয়েভজেনি প্রিগোজিন (৬২)। বুধবার মস্কোর অদূরে বিমান বিধ্বস্ত হয়ে মৃত্যু হয় তার (রাশিয়ার ঘোষণা মোতাবেক)।
প্রিগোজিনের মৃত্যুর পর থেকেই কার্যত নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়েছে ৫০ হাজারেরও বেশি যোদ্ধা বাহিনীর দল ওয়াগনার। পুতিন বিশ্বস্তখ্যাত এই প্র্রিগোজিন বাহিনীর ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। রাশিয়ার প্রভাব বিস্তারে আফ্রিকা ও সিরিয়ায় কাজ করেছে ‘বিকল্প রুশ সেনা’ হিসাবে।
দলনেতার মৃত্যুতে ওয়াগনারের গ্রুপের ভবিষ্যৎ এখন প্রশ্নবিদ্ধ। কর্তৃত্বহীন দলটির ভার কার হাতে উঠবে? কী হবে দলটির ওপর আষ্টেপৃষ্ঠে নির্ভরশীল আফ্রিকান দেশগুলোর? প্রিগোজিনের মৃত্যু-পরবর্তী এ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার ফোয়ারা ছুটছে সারাবিশ্বে।
প্রিগোজিনের মৃত্যুর পর প্রথম প্রশ্ন আধাসামরিক দলটির নেতৃত্বের ভার কার কাঁধে উঠবে? রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের (রুসি) রিসার্চ ফেলো জোয়ানা দেউস বলছেন, প্রিগোজিনের মৃত্যুতে ওয়াগনার বাহিনী ‘একটি নির্দিষ্ট পুনর্গঠনের’ দিকে এগিয়ে যাবে। প্রিগোজিনের রেখে যাওয়া নেতৃত্ব ও আদর্শ অনুসরণ করেই দলটিকে পরিচালনা করা হবে।
তিনি আরও বলেন, ‘আধাসামরিক বাহিনীটিতে হয়তো ভবিষ্যতে নতুন কেনো নাম আসবে। তবে দলটি ইতোমধ্যেই প্রমাণ করেছে এটি যেকোনো পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেওয়ার এবং রূপ দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। তিনি আরো বলেন, ওয়াগানারকে ‘একক’ হিসেবে দেখলে চলবে না বরং এটি ‘ঐক্য’। তাদের শেকড় অসংখ্য মাথাবিশিষ্ট প্রাণী হাইড্রার মতো বৈচিত্র্যে ছড়িয়ে আছে আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশে। তবে ইতিহাসবিদ ফিলাতোভা জোর দিয়ে বলেছেন, ‘রাশিয়া আফ্রিকায় তার প্রভাব আরও গভীর করার চেষ্টা চালিয়ে যাবে। আফ্রিকায় ওয়াগনারের মাধ্যমে রাশিয়ার কার্যক্রম ইউক্রেনে তাদের যুদ্ধ কৌশলের অংশ ছিল। রাশিয়ার যুদ্ধের অর্থায়নের জন্য মধ্য আফ্রিকার সোনা ও মালির সোনার প্রয়োজন। সুতরাং কিছুই পরিবর্তন হবে না।’
আটলান্টিক কাউন্সিলের নিরাপত্তা বিশ্লেষক রুসলানের মতে, প্রিগোজিনের মৃত্যুর পর রুশ গোয়েন্দা সংস্থা জিআরইউ থেকে কেউ দলটিকে নেতৃত্ব দেবে। মিস্টার পুতিনের জন্য সবচেয়ে কঠিন হবে এমন কাউকে খুঁজে বের করা যিনি আধাসামরিক বাহিনীটির জন্য অর্থের জোগান দিতে পারবে। ভালো ওয়াগনার কমান্ডার পাওয়া গেলেও অর্থদাতা হিসাবে প্রিগোজিনই প্রধান ব্যক্তি ছিল।
প্রিগোজিন বাহিনীর বেশ প্রভাব ছিল মধ্য আফ্রিকা এবং মালিতে। নিরাপত্তা হুমকির কারণে দেশগুলোর সরকার ওয়াগনার বাহিনীর ওপর নির্ভরশীল ছিল। মালিতে, ক্ষমতাসীন সামরিক বাহিনী একটি জঙ্গি বিদ্রোহ বন্ধের সমাধানের জন্য মস্কোতে ছুটে গিয়েছিল। রাশিয়াও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে ওয়াগনারদের মোতায়েন করে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করেন। প্রতিবেশী বুর্কিনা ফাসোতেও ইসলামি জঙ্গিবাদ এবং সেনাবাহিনীর দখলের ফলে সৃষ্ট অস্থিতিশীলতায় এগিয়ে আসে প্রিগোজিনের ওয়াগনার বাহিনী। সর্বশেষ নাইজারে সাহেল একটি অভ্যুত্থানে জান্তাপন্থিরাও রাশিয়ার হস্তক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছিল। জুন মাসে প্রিগোজিনের বিদ্রোহের পরপরই আফ্রিকায় মস্কোর দেওয়া সহযোগিতাগুলো বন্ধ হয়ে যাবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
এ বিষয়ে রাশিয়ার পররাষ্ট্রবিষয়ক মন্ত্রী বলেছিল এ ঘটনাগুলো বাহিনীর কাজের ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে না। কেননা পশ্চিমাদের চেয়ে মস্কোর সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব বাড়াতে ওয়াগনার বাহিনীকে আফ্রিকায় সাহায্যে পাঠানো হয়। যদিও প্রিগোজিনের মৃত্যু নিঃসন্দেহে একটি বড় ট্র্যাজেডি। ধারণা করা হচ্ছে, ওয়াগনার বাহিনী মস্কোর জন্য পররাষ্ট্রনীতির গুরুত্বপূর্ণ একটি হাতিয়ার হয়ে উঠেছে।
সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক (সিএআর) প্রেসিডেন্ট ফাউস্টিন-আর্চেঞ্জ তোয়াদেরা বলেছেন, তার দেশ এবং রাশিয়ার মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক একই থাকবে।
তিনি আরও বলেন, রাশিয়ার সাথে আমাদের একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি হয়েছে। আমাদের সঙ্গে যে আধাসামরিক বাহিনী আছে তারা আগের মতোই তাদের কাজ চালিয়ে যাবে। হতে পারে তারা অন্য একজন বাহিনীপ্রধানকে খুঁজে নেবে। বাণিজ্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে, রুশদের সঙ্গে আমাদের একটি খনির লাইসেন্স, একটি মদ্যপান এবং একটি বনায়ন লাইসেন্স রয়েছে। প্রিগোজিন আর না থাকলেও এটি পরিবর্তন হবে না।
রুশ ইতিহাসবিদ ইরিনা ফিলাতোভা আফ্রিকায় ওয়াগনার বাহিনীর সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ককে ‘জয়-জয়’ পরিস্থিতি হিসাবে দাবি করেন। এক দিকে ওয়াগনার রাশিয়ার প্রতিপত্তি এবং অস্ত্র থেকে উপকৃত হয়েছেন। অন্য দিকে আফ্রিকার প্রাকৃতিক সম্পদে রাশিয়ার আইনত অগ্রাধিকার রয়েছে।
মালি বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে একটি। অথচ মালিতে ওয়াগনার ভাড়াটেদের জন্য প্রতি বছরে ১০০ মিলিয়নেরও বেশি পাউন্ড খরচ হতো। কে দিত এই মোটা অঙ্কের অর্থ? রাশিয়া নাকি মালিÑএখনো তা স্পষ্ট নয়। তবে নিরাপত্তা দেওয়ার বদলে মালির তেল খাতেও অংশীদারত্ব রাখত ওয়াগনার। প্রিগোজিন-পরবর্তী সম্ভাব্য ভবিষ্যতে কীভাবে ওয়াগনার চলবে তা অস্পষ্ট।