Logo
Logo
×

আন্তর্জাতিক

জন্মের পর থেকেই গণতন্ত্রের স্বাদ পায়নি পাকিস্তান

Icon

হৃদিতা ইফরাত

প্রকাশ: ১১ আগস্ট ২০২৩, ০৯:৪৭ পিএম

জন্মের পর থেকেই গণতন্ত্রের স্বাদ পায়নি পাকিস্তান

পাকিস্তান—রাজনৈতিক দর্শনে জন্মের পর থেকেই ‘অপূর্ণ আত্মা’। দেশভাগের (১৯৪৭) আঁতুড় ঘরে জন্ম নেওয়া পৃথিবীর মানচিত্রে অস্থির দেশটির শাসনতন্ত্রে শৈশবকাল থেকেই ‘বদহজম’র ভাইরাস। জনশাসন নীতি বা সরকার যন্ত্রের ‘সুস্বাদু গণতন্ত্রে’ একেবারেই অরুচি। মন চাইলেও পেটে সয় না! মস্তিষ্কখেকো অ্যামিবার মতো গণতন্ত্র খাদক এ ভাইরাসের নাম ‘সেনাবাহিনী’। 

ভূখণ্ডের পাক-প্রণালিতে বাসা বেঁধে থাকা এক অপ্রতিরোধ্য ‘ক্যানসার’। ৭ লাখ ৯৬ হাজার ৯৫ বর্গকিলোমিটারজুড়ে থাকা ২৪ কোটিরও বেশি মানুষ একই রোগে ভুগছে বছরের পর বছর। এই এক ব্যামোতেই জন্মের পর থেকেই গণতন্ত্রের স্বাদ নিতে পারেনি দুর্ভাগা পাকিস্তান! ফরেন পলিসি, ডন, পলিটিকো, দ্য ডিপ্লেম্যাট।

কাগজে-কলমে গণতন্ত্রের নিশানা মিললেও পাকিস্তান কখনই পূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ছিল না। ইতিহাসের তুলি টানলেই দেখা মিলবে সেসব খণ্ড চিত্রের। দেশটির প্রকৃত ক্ষমতা বরাবরই শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর ওপর নির্ভর করে। দশকের পর দশক ধরেই পরোক্ষভাবে তারাই দেশ শাসন করছে। ক্ষমতা সরকারের হতে তুলে দিলেও ‘নবাবের চাবুক’ নিয়ে বসে থাকে পর্দার আড়ালে। বন্দুকের নলে লেখা থাকে দেশ পরিচালনার প্রেসক্রিপশিন। সিংহাসনের পেছনে বসে আসল ‘রাজা’ তারাই। সরকার-প্রধানমন্ত্রী ‘নামকাওয়াস্তে’। নিজেদের মর্জিমতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করেছে।  রাজনৈতিক দল তো বটেই, বিচারকদেরও প্রভাবিত করে। আর নির্বাচনের সময় বুক ফুলিয়ে চালায় অবাধ কারচুপি। 
 
দেশটির ‘ক্যান্টনমেন্ট গণতন্ত্রের’ এখন এমন হাল হয়েছে, যে দলই ক্ষমতায় আসে সেনাবাহিনীর সমর্থন নিশ্চিত করার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। তবে ইতিহাস বলছে, নির্বাচিত সরকার এবং জাতীয় পরিষদ ‘সেনাপ্রধান’র তুলনায় সবসময়ই কম ক্ষমতা ভোগ করেন। যখন পুরোপুরি সামরিক আধিপত্য না থাকে তখন চলে ছায়া সামরিক শাসন। এ কারণেই পাকিস্তানকে ‘হাইব্রিড শাসন’র অন্তর্ভুক্ত ধরা হয়।

১৯৫৮ সালে সরাসরি সামরিক শাসনের মুখোমুখি হয় পাকিস্তান। তখন প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা সামরিক আইন জারি করেন ও সংবিধান স্থগিত ঘোষণা করেন। কমান্ডার-ইন-চিফ জেনারেল আইয়ুব খান মির্জাকে লন্ডনে নির্বাসিত করে ক্ষমতা নিজ হাতে তুলে নেন। জেনারেল মুহাম্মদ মুসা সেনাপ্রধান হিসেবে তার স্থলাভিষিক্ত হন। খান তার অধীনে একটি নতুন বেসামরিক-সামরিক সরকারের নামকরণ করেন। 

১৯৭১ সাল পর্যন্ত সামরিক এ ধারা অব্যাহত থাকে। দ্বিতীয় সামরিক শাসন ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৮ পর্যন্ত স্থায়ী হয়। ধর্মীয় রক্ষণশীলতা বৃদ্ধির কারণে একে নিপীড়নের সময়কালও বলা হয়। জেনারেল জিয়া-উল-হক একটি ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। এরপর তৃতীয়বারের মতো ১৯৯৯ থেকে ২০০৭ সালে ক্ষমতায় আসে জেনারেল পারভেজ মোশাররফ। তার হাত ধরে পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো জাতীয় ক্ষমতায় উদারপন্থি শক্তির আগমন ঘটে।

সেনাবাহিনীর হাত ধরে এলেও অনেকের ধারণা ছিল তেহরিক-ই ইনসাফের চেয়ারম্যান, দেশের ক্রিকেট মাঠের শিরোমণি ইমরান খান পাকিস্তানের রাজনীতির হাওয়া কিছুটা হলেও বদলে দেবেন। তবে শেষমেশ দেখা যায়, পূর্বসূরিদের মতোই নড়েবড়ে দশা খানের মসনদেরও। 

সেনাবাহিনীর রেষারেষি-মন কষাকষির জেরে মেয়াদ শেষের বছর দুয়েক আগে থেকেই দুলতে থাকে তার গদি। সুযোগে সেই পুরোনো পথ ধরেই সেনাবাহিনীর সঙ্গে হাত মেলায় পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজের দল। একপর্যায়ে মেয়াদ শেষের আগেই অনাস্থা ভোটের সাংবিধানিক নাটকে ৩ বছর ৮ মাসের মাথায় ইতি ঘটে ইমরান যুগের। তারপর শুরু হয় ঠান্ডা লড়াই। গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলছে। তিনি সামরিক বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করেছেন। তবে তা পাকিস্তানের রাজনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তনের জন্য নয়। জেনারেলদের চাপ দিয়ে নিজে ক্ষমতায় ফিরে আসার জন্য। সেনাবিরোধী এ শক্তিতেই জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠে গেছেন তিনি। পাকিস্তানে এখন একটাই নেতা ইমরান খান। হঠাৎ এই গণজোয়ারে শঙ্কিত হয়ে ওঠে ক্ষমতার আলোয় থাকা দেশটির শরিক জোট। সরকার-সেনা যোগসাজশে শুরু হয় হত্যা পরিকল্পনা, রাজপথে বন্দুক হামলার শিকার হন অনেকে। একপর্যায়ে গ্রেফতার। ৯ মে-এর ওই গ্রেফতার-কাণ্ডে উত্তাল হয়ে ওঠে পাকিস্তান। রাওয়ালপিন্ডির সেনা সদর দপ্তর, লাহোর, পেশোয়ারসহ বেশ কয়েকটি ক্যান্টনমেন্টে ভাঙচুর চালায় ইমরান সমর্তকরা। নড়ে ওঠে সামরিক কলকাঠি, জমে ওঠে ক্ষমতার খেলা। শুরু হয় ধরপাকড়। ইমরান খানের দলের প্রায় ১৩ হাজার নেতাকর্মীকে আটক করে সরকার। 

একপর্যায়ে ইমরান খান আওয়াজ তোলেন, সেনাবাহিনী তার দলকে ভেঙে দিতে চায়। তার রাজনৈতিক কর্মজীবনের অবসান ঘটাতে চায়। নির্বাচনের ঠিক আগে আগে মামলার পর মামলায় তার কারাবাস এটাই প্রমাণ করে পাকিস্তান ‘হাইব্রিড’ শাসনে চলছে। গণতন্ত্রের জন্য একটি বেসামরিক বিরোধীদলের প্রয়োজন তেমনি নিয়ম দ্বারা সীমাবদ্ধ একটি সরকারও প্রয়োজন। তবে পাকিস্তানে বর্তমানে এ দুটি ব্যাপারই উধাও।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম