দিন যত যাচ্ছে আফ্রিকায় ততই দল ভারী হচ্ছে সেনা সরকার। গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা হাতে নিচ্ছে সামরিক জান্তারা। ক্ষমতা হাতে নেওয়ার পেছনে কারণ দেখাচ্ছে- নির্বাচিত সরকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ। জান্তাদের দাবি, জনকল্যাণে গণতন্ত্রের যথাযথ প্রতিষ্ঠায় এমন পদক্ষেপ নিতে বাধ্য তারা। বিশেষভাবে আফ্রিকার সাহেল অঞ্চলটি আশপাশে প্রায় সব দেশেই চলছে জান্তাদের রমরমা শাসন। সেনেগাল, গাম্বিয়া, মৌরিতানিয়া, গিনি, মালি, বুরকিনা ফাসো, নাইজার, চাদ, ক্যামেরুন এবং নাইজেরিয়া নিয়ে গঠিত সাহেলের প্রায় সব দেশই সামরিক সরকারদের দখলে।
গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৫০-এর দশক থেকে এখন পর্যন্ত নির্বাচিত নেতাদের উৎখাত করার জন্য কমপক্ষে ২০০টি প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। ১৯৬০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত, এই অঞ্চগুলোতে প্রতিবছর গড়ে প্রায় চারটি অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিল। ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের পশ্চিম ও মধ্য আফ্রিকার বিশ্লেষক করিম ম্যানুয়েল বলছেন, সামরিক সরকারগুলো সাহেল অঞ্চলে নয় বরং বৃহত্তর পশ্চিম আফ্রিকার গণতন্ত্রকে হুমকিতে ফেলতে চাইছে। তিনি আরও বলেন, ‘এটি সামনের দিনগুলোতে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়াবে এবং স্থলভাগের পরিস্থিতিকে অনেক বেশি অস্থির ও অপ্রত্যাশিত করে তুলবে। এই অভ্যুত্থানগুলোর ফলে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ক্ষুণ্ন হচ্ছে।’ নিচে সাহেলের সামরিক শাসিত দেশগুলোর তালিকা তুলে ধরা হলো-
মালি : পশ্চিম আফ্রিকার একটি রাষ্ট্র মালি। সর্বশেষ অভ্যুত্থান শুরু হয়েছিল ২০২০ সালের আগস্টে। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম বোবাকাকে সৈন্যদের দ্বারা উৎখাত করেছিল কর্নেল আসিমি গোইতা। কথা ছিল ১৮ মাসের মধ্যেই বেসামরিক শাসনের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। কিন্তু কথা রাখেনি জান্তা সরকার। ৭ মাস পর, সামরিক বাহিনী অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রীকে অপসারণ করে ক্ষমতা নিজ হতে তুলে নেয়।
সুদান : গৃহযুদ্ধ ও সুদান যেন একে অপরের প্রতিশব্দ। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সামরিক উত্থানের শিকার দেশটি। এ পর্যন্ত ১৬ বার সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে সুদানে। ২০২১ সালের অক্টোবরে সুদান সামরিক শাসনের অধীনে চলে যায়। মারাত্মক বিক্ষোভের মধ্যে সৈন্যরা দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসক ওমর আল-বশিরকে ক্ষমতাচ্যুত করার প্রায় দুই বছর পরে এটি ঘটেছিল। অভ্যুত্থানের ১৮ মাস পরে এবং গণতন্ত্রে উত্তরণের আশার মধ্যে, সুদানের সেনাবাহিনী এবং আধা-সামরিক র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসর (আরএসএফ) মধ্যে লড়াই শুরু হয়। ভয়াবহ এ সংঘর্ষের ফলে শত শত মানুষের মৃত্যু হয়েছে। সুদানের এ গৃহযুদ্ধ এখনো চলমান।
বুরকিনা ফাসো : আফ্রিকা মহাদেশের পশ্চিমভাগে অবস্থিত একটি রাষ্ট্র। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে দেশটির প্রেসিডেন্ট রক কাবোরকে পদচ্যুত করে সেনাবাহিনী। ক্ষমতা হাতে তুলে নিতে দেশের সংবিধান ও জাতীয় পরিষদ স্থগিত করা হয়। সামরিক নেতারা দাবি করেন, নির্বাচিত সরকার সহিংসতা বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছে। অভ্যুত্থান নেতা লেফটেন্যান্ট কর্নেল পল-হেনরি দামিবার পরিস্থিতির উন্নতির আশ্বাস দেন কিন্তু আবারও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। ফলস্বরূপ, সামরিক বাহিনী এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে দ্বিতীয় অভ্যুত্থান শুরু করে। কথিত বিদ্রোহের পর ক্যাপ্টেন ইব্রাহিম ট্রাওর সেপ্টেম্বরে ক্ষমতায় আসেন।
চাদ : মধ্য আফ্রিকার দেশ চাদ ২০২১ সালের এপ্রিল থেকেই সামরিক শাসনে। ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চাদ শাসন করছেন প্রেসিডেন্ট ইদ্রিস ডেবি। পরে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াই করার সময় তিনি নিহত হন। সাংবিধানিক বিধানের বিপরীতে ক্ষমতা গ্রহণ করেন তার পুত্র, জেনারেল মহামত ইদ্রিস ডেবি। দেশে গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের জন্য ১৮ মাসের অন্তর্বর্তীকালীন রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে মনোনীত হন তিনি। ১৮ মাসের শেষের দিকে, সরকার ডেবির মেয়াদ আরও দুই বছর বাড়িয়ে দেয়। সেই বিক্ষোভের সূত্রপাত থেকে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা হতে তুলে নেয়।
নাইজার : পশ্চিম আফ্রিকার দেশ নাইজারে ২৬ জুলাই অভ্যুত্থানের ডাক দেন জেনারেল চিয়ানি। নাইজারের ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বাজুমকে এক সপ্তাহের মধ্যে ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে হুমকি দিয়েছে আফ্রিকার ১৫ দেশের জোট ইকোয়াস। তবে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন অভ্যুত্থানকারী সেনা কর্মকর্তা জেনারেল আব্দুররহমান চিয়ানি।
ঘানা : দুই দশকে আটটি সামরিক অভ্যুত্থানের অভিজ্ঞতা হয়েছে ঘানা। প্রথমটি ১৯৬৬ সালে সংঘটিত হয়েছিল। কারণ দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী কোয়ামে এনক্রুমাহকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পরের বছর, জুনিয়র সেনা সৈন্যদের দ্বারা আরেকটি অভ্যুত্থানের চেষ্টা হয়েছিল, যা পরবর্তীতে ব্যর্থ হয়েছিল।
নাইজেরিয়া : স্বাধীনতার পর দেশটি ১৯৬৬ থেকে ১৯৯৩ সালের মধ্যে আটটি অভ্যুত্থানের সম্মুখীন হয়েছিল।
সিয়েরা লিওন : ১৯৬৭ এবং ১৯৭১ সালের মধ্যে পরপর চারটি অভ্যুত্থানের শিকার হয় দেশটি।