Logo
Logo
×

আন্তর্জাতিক

আরব নিউজের বিশ্লেষণ

এরদোগানের পুনঃনির্বাচনে কেমন হবে তুর্কি পররাষ্ট্রনীতি?

Icon

রওশন প্রধান

প্রকাশ: ৩০ মে ২০২৩, ০৪:৫৯ পিএম

এরদোগানের পুনঃনির্বাচনে কেমন হবে তুর্কি পররাষ্ট্রনীতি?

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান এবং রুশ নেতা ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: আরব নিউজ

গত রোববারের রানঅফ নির্বাচনে আরও পাঁচ বছরের জন্য ম্যান্ডেট পেয়েছেন তুরস্কের ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান। এ অবস্থায় তুরস্কের পররাষ্ট্রনীতি কোন দিকে এগুবে তা হয়তো কোনো গোপন বিষয় নয়। অর্থাৎ বিগত বছরগুলোর অভিজ্ঞতায় যেসব ক্ষেত্রে আঙ্কারার স্বার্থ রক্ষা হয়েছে, সেসব কৌশলগত নীতির ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকতে পারে।

এ বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জার্মান মার্শাল ফান্ডের আঙ্কারা অফিসের পরিচালক ওজগুর উনলুহিসারসিকলি মনে করছেন, এরদোগানের প্রধান অগ্রাধিকার হবে রাশিয়া এবং উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে অত্যধিক প্রয়োজনীয় নগদ অর্থের প্রবাহ নিশ্চিত করা, ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অস্বস্তির অবসান ঘটানো, যাতে তিনি পশ্চিমা বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারেন।

সম্প্রতি সৌদি সংবাদমাধ্যম আরব নিউজকে তিনি বলেন, ‘যদিও ইউরোপ বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক আবার ট্র্যাকে ফিরিয়ে আনার আশা করা যায় না, তবে তারা অন্তত স্থিতিশীল হতে পারে। কারণ স্বার্থের দিক বিবেচনায় এরদোগান এবং পশ্চিমারা উভয়ই তা থেকে উপকৃত হবেন।’

এরদোগানের পুনঃনির্বাচনের পর ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিনন্দন বার্তাগুলোও সেরকমই ইঙ্গিত দেয়।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এরদোগানকে পুনঃনির্বাচিত হওয়ায় অভিনন্দন জানিয়েছেন এবং টুইট করে বলেছেন, ‘আমি দ্বিপাক্ষিক সমস্যা এবং বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জগুলোতে ন্যাটো মিত্র হিসেবে একসঙ্গে কাজ চালিয়ে যেতে আগ্রহী।’

উনলুহিসারসিকলির মতে, এরদোগানকে তার তৃতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথমদিকে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

তিনি বলছেন, তুরস্কের নির্বাচনের কারণে এখন পর্যন্ত সংযম দেখিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তবে আগামী দিনগুলোতে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা ইস্যু এবং ন্যাটোর সদস্য বৃদ্ধির বিষয়ে আরও জোরালোভাবে চাপ দেবে ওয়াশিংটন। এফ-১৬ যুদ্ধ বিমান কেনার জন্য তুরস্কের অনুরোধ এবং অন্যান্য ইস্যুতে এরদোগানের সিদ্ধান্ত তুর্কি-মার্কিন সম্পর্ককে যে কোনো দিকে পরিচালিত করতে পারে।

প্রসঙ্গত, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন রাশিয়ার তৈরি এস-৪০০ মিসাইল সিস্টেম কেনার কারণে ২০১৯ সালে তুরস্ককে পঞ্চম প্রজন্মের জেট এফ-৩৫ প্রোগ্রাম থেকে বাদ দিয়েছিল। পরবর্তীতে বাইডেন দায়িত্ব নেওয়ার পর কিছুটা নমনীয়তা দেখালেও গিট্টু খোলেনি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এরদোগান তৃতীয় মেয়াদে বিজয়ের পর তুরস্ক আন্তর্জাতিক আইন মেনে দেশটির নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চলগুলিতে কয়েক হাজার সিরিয়ান শরণার্থীকে প্রত্যাবাসনের সাম্প্রতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে পারে।

এরদোগানের নতুন মিত্র সিনান ওগান, যিনি রানঅফে তাকে সমর্থন দিয়েছেন, তার প্রচারণার সময় বলেছিলেন যে, তিনি প্রয়োজনে জোর করে শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের বিষয়টি বিবেচনা করবেন।

দ্য ফিউচার লিটারেসি কোম্পানির বিশ্লেষক এবং ইনস্টিটিউট ফর তুর্কি স্টাডিজের প্রতিষ্ঠাতা ক্যারল ওয়াসিলেস্কি বলছেন, এরদোগান সম্ভবত তার অস্পষ্ট বৈদেশিক নীতি অব্যাহত রাখবেন, যেখানে একদিকে তুরস্ক তার পশ্চিমা মিত্রদের মন জোগাবে এবং সে কারণেই এরদোগান শেষ পর্যন্ত সুইডেনের ন্যাটোর সদস্যপদে সম্মত হলে আমি অবাক হব না। অন্যদিকে আবার স্পষ্টতই তার স্বার্থের বিষয়ে গুরুত্ব দেবে, যদিও তাতে ন্যাটোর অভ্যন্তরীণ সংহতির কিছুটা ক্ষতিও হতে পারে।’

সুইডেনের ন্যাটোর সদস্যপদ প্রাপ্তির বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে প্রত্যাখ্যান করে আসছেন এরদোগান। তবে আগামীতে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে এফ-১৬ যুদ্ধবিমান পেতে এটিকে একটি ট্রাম্প কার্ড হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন তিনি। আসছে জুলাইয়ে ন্যাটোর পরবর্তী শীর্ষ সম্মেলনের আগে ফাইটার জেট নিয়ে আলোচনা হতে পারে। কারণ শীর্ষ সম্মেলনে এরদোগান ও বাইডেন বৈঠকে মিলিত হতে পারেন বলে আশা করা হচ্ছে।

কিন্তু অন্যদিকে সিরিয়ার কুর্দি মিলিশিয়া তথা মার্কিন প্রশাসন সমর্থিত পিপলস প্রোটেকশন ইউনিট বা ওয়াইপিজি নিয়ে এরদোগানের অস্বস্তি তার তৃতীয় মেয়াদেও অব্যাহত থাকতে পারে। কারণ তার সরকার ওয়াইপিজি-কে তুরস্কে নিষিদ্ধ কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির (পিকেকে) একটি শাখা হিসেবে বিবেচনা করে।

তুরস্কের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুলেমান সোইলু শুক্রবার বলেছেন, নির্বাচনের পর ‘যে কেউ তুরস্কে আমেরিকানপন্থি নীতি অনুসরণ করবে, তাকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত করা হবে।’ নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে ওয়াশিংটনের সঙ্গে আঙ্কারার সম্ভাব্য লেনদেন সম্পর্কে ইঙ্গিত দিয়ে এমন কথা বলেন তিনি।

ওয়াসিলেস্কি মনে করছেন, এরদোগানের জয় তুরস্কে ইউরো-এশীয় অংশের জন্য নিরাপত্তা ব্যবস্থায় নিজেদের শক্তিশালী করার আরেকটি সুযোগ হিসেবে কাজ করতে পারে। 

তার মতে, পাঁচ বছরের পরিপ্রেক্ষিতে এক্ষেত্রে এমন কিছু হতে পারে, যা পশ্চিমের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্কের উপর আরও বড় ছায়া ফেলবে।

‘আমি অবাক হব না, যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কের উপর চাপ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়- বিশেষ করে যেগুলো তাদের স্বার্থের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়। যেমন রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা,’ বলেন ওয়াসিলেস্কি।

তিনি মনে করছেন, তুর্কি-রাশিয়ান সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে আঙ্কারা ও ক্রেমলিনের সাথে তার বর্তমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক অব্যাহত রাখার পাশাপাশি দুই নেতা অর্থাৎ রুশ নেতা পুতিন ও এরদোগানের মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্কের সাহায্যে জ্বালানির ক্ষেত্রে সহযোগিতাকে আরও গভীর করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

রাশিয়া এবং উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কও এরদোগানকে পশ্চিমা বাজার থেকে তুরস্কের অর্থনীতিকে আরও স্বাধীন করার লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করবে। আঙ্কারা এখন পর্যন্ত রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় যোগ দেয়নি, তবে কিয়েভকে সামরিক সহায়তা প্রদানও অব্যাহত রেখেছে।

সম্প্রতি রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় শক্তি সংস্থা রোসাটম তুরস্কে ২০ বিলিয়ন ডলারের (তুরস্কের প্রথম) পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ উদ্বোধন করেছে। বিশ্বের বৃহত্তম এ পারমাণবিক নির্মাণ প্রকল্পের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যোগ দেন রাশিয়ান নেতা ভ্লাদিমির পুতিন ও এরদোগান। ওই সময় পুতিন বলেছিলেন, এই প্ল্যান্টটি তুর্কি-রাশিয়া সম্পর্ককে আরও গভীর করেছে।

এ বিষয়ে ওয়াসিলেস্কি বলছেন, ‘পুতিন ভাল করেই জানেন যে, রাশিয়া এবং তুরস্কের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তার স্বার্থের জন্য অত্যাবশ্যক, বিশেষ করে ইউক্রেনের উপর রাশিয়ান আগ্রাসনের পর। তাদের এই সুসম্পর্ক অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে তীব্র প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবেন।’

এই বিশ্লেষক আরও বলছেন, ‘তুরস্ককে গ্রেট পাওয়ার’ হিসেবে পরিচিত করার যে স্বপ্ন ও ন্যারেটিভ এরদোগান তৈরি করেছেন, দেশকে ‘গ্যাস হাব’-এ পরিণত করতে পারলে সেটি আরও সহজ হবে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম