Logo
Logo
×

আন্তর্জাতিক

ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে বৃহৎ শক্তিগুলোর ক্ষমতার প্রতিযোগিতায় বছর পার

ফারিহা জেসমিন ইসলাম

ফারিহা জেসমিন ইসলাম

প্রকাশ: ০১ জানুয়ারি ২০২৩, ০৪:২৫ পিএম

ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে বৃহৎ শক্তিগুলোর ক্ষমতার প্রতিযোগিতায় বছর পার

বিদায় নিল ২০২২, যাত্রা শুরু ২০২৩-এর।  বিশ্ব রাজনীতির মাঠে ব্যাপক টানাপোড়েন, অস্থিরতা সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ঘটনাবহুল একটি বছর হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় ২০২২-কে। 

বিশ্বজুড়ে কোভিডপরবর্তী নানান জটিলতা- আর্থিক মন্দা, অনিয়ন্ত্রিত মুদ্রাস্ফীতি, দেশে দেশে রাজনৈতিক উত্থান-পতন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যকার ক্ষমতার প্রতিযোগিতা, জলবায়ু উদ্বেগ,  বিশ্বকাপ ফুটবল ২০২২ এ রকম আরও অনেক  ঘটনায় ২০২২ সালে আন্তর্জাতিক রাজনীতি ছিল সরগরম। 

কোভিডপরবর্তী মহামারিপীড়িত পৃথিবীতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের  কারণে বিশ্ব পরিস্থিতি মোড় নেয় বহুমুখী সমস্যার  দিকে।  
পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোতে ইউক্রেনের যোগদানের সম্ভাবনা এবং দেশটিতে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা কেন্দ্র করে ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ভ্লাদিমির পুতিন-এর নেতৃত্বাধীন রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করে । পণ্ডিত জোসেফ নাই বলছেন '১৯৪৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত ইউরোপে যত সংঘাত হয়েছে, তার মধ্যে ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধ সবচেয়ে বিধ্বংসী সংঘাত। পশ্চিমের অনেকেই যখন এ যুদ্ধকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ হিসেবে দেখছেন, তখন পুতিন বলেছেন— ২০০৮ সালে ন্যাটো ইউক্রেনকে সদস্য বানানোর বিষয়ে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সেটি রাশিয়ার অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছিল; সে কারণে রাশিয়া এ সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে। 

অন্য অনেকে মনে করেন, শীতল যুদ্ধের সমাপ্তি এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর পশ্চিমারা রাশিয়াকে যথার্থ সমর্থন ও সহযোগিতা করতে ব্যর্থ হওয়ায় আজকের অবস্থার পেছনের একটি বড় কারণ। 

সামরিক আগ্রাসন হিসেবে বিবেচিত ইউক্রেনের মাটিতে রাশিয়ার এ হামলা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ইউরোপের সবচেয়ে বড় শরণার্থী সংকটের সূত্রপাত করেছে এবং ডেকে এনেছে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়। ৮.৮ মিলিয়নেরও বেশি ইউক্রেনীয় দেশ ছেড়ে পালিয়ে সীমান্তবর্তী দেশে আশ্রয় নিয়েছে এবং আরও লক্ষাধিক অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। 
পোল্যান্ড,  মলডোভা, রোমানিয়া, স্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি— এসব রাষ্ট্রে  ইউক্রেনের শরণার্থী আশ্রয় দিয়েছে। 

আজকের দিন পর্যন্ত চলমান এই যুদ্ধে ইউক্রেনের জনগণ সাক্ষী হয়েছে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ ও ধ্বংসযজ্ঞের। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন অন্যসব যুদ্ধের ভয়াবহতার চেয়ে এই যুদ্ধের ভয়াবহতা বেশি এবং অন্যান্য সশস্ত্র সংঘাতের মতো এখানে ও নিরপরাধ মানুষগুলো দুঃসহ দুর্ভোগ পোহাচ্ছে । 

সব আইন-কানুন ভঙ্গ করে রাশিয়া এলোপাতাড়ি আক্রমণ চালিয়েছে ইউক্রেনের ঘরবাড়ি থেকে শুরু করে সামরিক-বেসামরিক স্থাপনায় যাকে বলা হয় যুদ্ধের আইনের লঙ্ঘন বা  যুদ্ধাপরাধ। যুদ্ধের কিছু দিনের মধ্যে পুরো রাশিয়াজুড়ে হাজারও যুদ্ধবিরোধী প্রতিবাদকারীকে বিচারবহির্ভূতভাবে শাস্তি দেওয়া হয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের এ ভয়াবহ সহিংসতা ও বর্বরতা ছাড়িয়ে গেছে অতীতের অনেক ইতিহাস। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে মানবাধিকার বিপর্যয় পৌঁছে গেছে চূড়ান্ত সীমায় । 

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে শুরু হয়েছে ক্ষমতার প্রতিযোগিতা। খাবার, শ্রম, তথ্য, অভিবাসন সবকিছুরই অস্ত্রিকরণ চলছে বর্তমান বিশ্বে। উন্মুক্ত সমুদ্র বা মহাকাশ অথবা বৈশ্বিক ক্ষমতার কেন্দ্র বিন্দু পর্যন্ত পৌঁছাতে রাষ্ট্রগুলো লড়ে যাচ্ছে তাদের নিজ নিজ কোমল শক্তি দিয়ে। অর্থনীতি, রাজনীতি, নিরাপত্তা ইত্যাদি নিয়ে আমেরিকা-চীনের দূরত্ব দিন দিন বাড়ছে। এশিয়ার অগ্রগামী পরাশক্তি চীনের প্রতি আমেরিকার এই বৈরিতা চীনের ভবিষ্যৎ উত্থানে কতুটুকু বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে সেটা ভাবনার বিষয়। 

ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি জোসেফ বরেল বলছেন— বিশ্ব রাজনীতিতে একটা মেসি মাল্টিপোলারিটি তৈরি হয়েছে, যেখানে ভারত, তুরস্ক , ইরান , সৌদি আরব, ব্রাজিলের মতো দ্বিতীয় কাতারের ধনী এবং সম্ভাবনাময় দেশগুলো পৃথিবীর অস্থির রাজনীতির সময়টাতে নিজেদের জাতীয় স্বার্থে  বিভিন্ন রকম প্রভাব বিস্তার করে লাভবান হচ্ছে । 
ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুধু একটি দখলমূলক জাতীয়তাবাদের কারণে নয়; বরং এটা ইঙ্গিত করে রাশিয়া স্নায়ুযুদ্ধপরবর্তী ইউরোপিয়ান নিরাপত্তা অবকাঠামোতে স্বার্থ অনুযায়ী নিজের অবস্থান পোক্ত করতে চায়। ইউরোপের নিরাপত্তাই  শুধু হুমকির মুখে নয়, রাশিয়ার পক্ষে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করা সম্ভব, এ ধরনের ভীতি পুরো বিশ্বকে একটা হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে, যা ১৯৬২ সালের কিউবান ক্ষেপনাস্ত্র সঙ্কটের চেয়ে কোনো অংশে কম উদ্বেগের কারণ নয় ।  
বিশ্বজুড়ে পোক্ত হয়েছে কম উদারতাবাদী, পপুলিস্ট কিংবা কর্তৃত্ববাদী শাসকদের শাসন। ফলে বেড়েছে মানুষে মানুষে সামাজিক বিভাজন, অর্থনৈতিক অসমতা, রাজনৈতিক বিভক্তি যার কারণে আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক সংস্থাগুলো ও পৃথিবীর নিরাপত্তা এবং শান্তি রক্ষায় অবদান রাখতে হিমশিম খাচ্ছে ।  

বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতার ঢেউ ছাড়াও ২০২২ বিশ্বকে কাঁপিয়েছে আর্থিক মন্দায়।  কোভিডপরবর্তী পৃথিবী একটি ভঙ্গুর অর্থনীতির কবলে পড়েছে ২০২২ সালে বিশ্ববাসীকে হতবাক করেছে ।  রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলস্বরূপ উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি , দ্রব্যমুল্যের ঊর্ধ্বগতি, খাদ্যের জ্বালানি সংকট বিশ্বজুড়ে মানুষের জীবনে ডেকে এনেছে বিপর্যয় । ২০২২-এ সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দা বিরূপভাবে আহত করেছে আমেরিকা, ইউরোপ , চীনের মতো  শক্তিশালী দেশের অর্থনীতিকেও। 

যার অব্যাহত নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হয়তো ২০২৩ সালে তীব্র রূপে দেখা দিতে পারে । ২০২২ সাল পরিবেশ কূটনীতিকেও ভাবিয়েছে ব্যাপক।  জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতা দেখতে শুরু করেছে  উন্নয়নশীল দেশ ছাড়া ও উন্নত রাষ্ট্রগুলো। কিন্তু নিয়মানুযায়ী জলবায়ু সম্মেলন হয়ে গেলে ও  কার্বন নিঃসরণ, ক্ষতি মোকাবিলায় তহবিল গঠনের ব্যাপারে সঠিক, কার্যকরী এবং  চলমান উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হচ্ছে বৃহৎ শক্তিগুলো । কোভিডপরবর্তী সময়ে চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কঠিন বাস্তবতায় জলবায়ু বিভ্রাট দেশগুলো খাদ্য নিরাপত্তা , ভূ-রাজনীতি, অর্থনৈতিক-সামাজিক  অবস্থানের ওপর চরম নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে বলাবাহুল্য । 

তা ছাড়া জলবায়ু বিষয়ে কোনো ঐকমত্যে আসতে না পারা বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থা এবং শাসন পদ্ধতিকেও প্রশ্ন বিদ্ধ করেছে । স্পষ্ট হয়েছে জলবায়ু বিষয়ে  আন্তর্জাতিক শাসকগোষ্ঠীর দুর্বলতা । বিরূপ জলবায়ু পরিস্থিতে রাষ্ট্রগুলোর উচিত একসঙ্গে কাজ করা এবং বিপদগ্রস্ত বা ভুক্তভোগী দেশগুলোর দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া। কিন্তু জাতিগুলোর এক হয়ে কাজ করতে না পারার ব্যর্থতা বৈশ্বিক জলবায়ু পরস্থিতিকে আরও নাজুক এবং বিপজ্জনক করে তুলবে । 

ব্রিটেনে ক্ষমতার রদবদল, রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মহা প্রয়াণ, পাকিস্তানের অস্থির রাজনীতি, ইরানের গণবিক্ষোভ, মালয়েশিয়ার জাতীয় নির্বাচনে মাহাথিরের হেরে যাওয়া, আফগানিস্থানে  কট্টরপন্থি তালেবানের উত্থানপরবর্তী বিতর্কিত শাসন , ২০২২ সালের আরও কিছু উল্লেখ্যযোগ্য আন্তর্জাতিক ইস্যু যা বিশ্বজুড়ে অস্থিরতা তৈরি করেছে বিগত বছরে । তা ছাড়া তাইওয়ান বিষয়ে আমেরিকা-চায়নার ঠাণ্ডা অসন্তোষ চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে উত্তেজনা ছড়িয়েছে । আর্থিক মন্দার এই সময়ে এ ধরনের বৈরিতা অপেক্ষাকৃত কম শক্তি সম্পন্ন বা ছোট অর্থনীতির দেশগুলোকে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন করেছে। বৃহৎ শক্তিগুলোর এমন বৈরী আচরণ, আর্থিক অবরোধ প্রদান বা অন্যান্য পদক্ষেপ আসলে নিজেদের মধ্যকার সহযোগিতাকেই কেবল মারাত্মকভাবে আঘাত করে না; বরং পুরো বিশ্বকেই হুমকির সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। 

তবু ২০২২ সালের দেওয়া অনেক আনন্দবার্তার মধ্য থেকে সেরা হিসেবে একটাই নজরে আসছে আর তা হলো প্রতীক্ষিত বিশ্বকাপ ফুটবল ২০২২। খেলাধুলা বরাবরই আনন্দ উদ্দীপক এবং  জাতিগুলোর মধ্যকার সহযোগিতার মাধ্যম। বিশ্ববাসী ২০২২ সালে আনন্দের সঙ্গে উপভোগ করেছে ফিফা ফুটবল । আর্জেন্টাইন ভক্তদের উদ্বেলিত করে মেসির জাদুতে বিশ্বকাপ উঠেছে আর্জেন্টাইনদের ঘরে,  বহু বছর যার রেশ রয়ে যাবে । 

বর্তমান একটু পরেই অতীত হবে, আর অতীত কখনো ফিরে আসবে না। সময় কেবল রেখে যায় স্মৃতিচিহ্ন, বিভিন্ন ঘটনা-দুর্ঘটনার প্রভাব কিংবা ফল। সদ্য বিদায় নেওয়া ২০২২ সাল  কালের গর্ভে বিলীন হলেও নানান ইতিবাচক অথবা নেতিবাচক ঘটনার কারণে আন্তর্জাতিক রাজনীতির ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। মর্ত্যের মানুষ ২০২২-কে স্মরণ করবে আর্জেন্টাইনদের বিশ্বকাপ বিজয়ে বা  রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ভয়াবহতায় ।  

লেখক:কলাম লেখক ও সহকারী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম