তুরস্কের সামরিক বাহিনী পেল ভয়ংকর আকিঞ্চি কিলার ড্রোন
সরোয়ার আলম, তুরস্ক থেকে
প্রকাশ: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৫:৫৭ এএম
২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রথম পরীক্ষামূলক উড্ডয়ন সম্পন্ন করে আকিঞ্চি ড্রোন। ফাইল ছবি
তুরস্কের বাইরাক্তার কোম্পানির তৈরি সর্বশেষ প্রযুক্তির এই কিলার ড্রোনটি দেশটির সামরিক সংস্থার কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। হস্তান্তর অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন তুরস্কের রাষ্ট্রপতি রিসেপ তাইয়্যিপ এরদোগান।
আকিঞ্চি কিলার ড্রোনের মাধ্যমে ড্রোন প্রযুক্তিতে নিঃসন্দেহে বিশ্বের প্রথম সারির দেশের মধ্যে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করলো তুরস্ক।
হস্তান্তর অনুষ্ঠানে তুরস্কের রাষ্ট্রপতি এরদোগান বলেন, নতুন প্রযুক্তির এই ড্রোনের মাধ্যমে তুরস্ক ড্রোন প্রযুক্তিতে বিশ্বের প্রধান তিনটি দেশের মধ্যে নিজের স্থান করে নিয়েছে। তার মতে এই প্রযুক্তি শুধুমাত্র আর দুটি দেশে আছে।
আকিঞ্জ ড্রোন প্রস্তুতকারক কোম্পানি বাইকার মাকিনার প্রধান প্রকৌশলী সেলচুক বায়রাক্তার তাদের এই ড্রোনে শতভাগ দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে বলে জানান। কারণ, এর আগে তাদের টিবি-২ নামক ড্রোনে কানাডার তৈরি ক্যামেরা ব্যাবহার করলে, নাগরনো কারাবাখ যুদ্ধের পরে কানাডা তুরস্কে এই ক্যামেরা বিক্রি এবং ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
এক্ষেত্রে আমেরিকা এবং ইসরাইলের পরেই তাদের অবস্থান!
তুরস্কের এই বিস্ময়কর অগ্রটির পেছনে আছে তাদের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা এবং অব্যাহত গবেষণা ও উন্নয়ন।
সাম্প্রতিককালে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন সংঘাতে তাদের এ ড্রোন প্রযুক্তির উৎকর্ষতা এবং কার্যকরীতা সম্পর্কে জানতে পারে সারা বিশ্ব।
তুরস্কের বায়রাক্তার টিবি-২ এবং আনকা ড্রোন গেইম চেইঞ্জারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় সিরিয়া, লিবিয়া এবং নাগরনো-কারাবাখে। তখন একে অনেকেই ‘গেইম অব ড্রোন’ বলেও অভিহিত করে।
বায়রাক্তার টিবি-২ প্রস্তুতকারক কোম্পানি বাইকার মাকিনা এবার নিয়ে আসে তার নতুন দানব ড্রোন আকিঞ্চি।
কেউ বলে উড়ন্ত দানব, কেউ বা বলে উড়ন্ত তিমি।আমি বলি উচ্চ টেকনোলজি সম্পন্ন এই আকিঞ্চি ড্রোন হলো সামরকি শক্তিতে তুরস্কের নতুন আধায়ের সূচনা ।
দেখতে তিমির মত আকৃতি হওয়ায় এই ড্রোনটিকে উড়ন্ত তিমি নামে ডাকা হয়। আর এর কার্যক্ষমতার কারণে একে উড়ন্ত দানব বলা হয়। বাইরাক্তারের টিবি -২ হচ্ছে ছোট ভাই, আকিঞ্চি হচ্ছে মেঝ ভাই আর ২০২৩ সালে MIUS নামক যে মানবহীন যুদ্ধ বিমানটি আসবে সেটি হবে এই সিরিজের বড় ভাই।
আকিঞ্চির ইতিহাস
আকিঞ্চি ড্রোন তৈরির কথা প্রথম শোনা যায় ২০১৮ সালে। এটি প্রথম আত্মপ্রকাশ করে ২০১৯ সালে। সেবছর তুরস্কের টেকনফেস্ট নামক মহাকাশ, বিমান এবং টেকনোলজি ফেস্টিভ্যালে প্রথম প্রদর্শন করা হয় এই ড্রোন। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যিপ এরদোগান সেখানে আকিঞ্চির গায়ে প্রথম স্বাক্ষর করেন। সে বছর ডিসেম্বর মাসে এটি প্রথম পরীক্ষামূলক উড্ডয়ন সম্পন্ন করে।
তুরস্কের এই মানবহীন যুদ্ধ ড্রোনটি তার ২০ মিটারের চওড়া ডানায় ভর করে উড়ার সময় ১৩৫০ কিলোগ্রাম স্মার্ট গোলাবারুদ বহন করতে পারে। আকিঞ্চি হচ্ছে ৪০ হাজার ফুট উচ্চতায় এয়ার টু এয়ার আট্যাক করার ক্ষমতাসম্পন্ন তুরস্কের প্রথম কোনো ড্রোন।
২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রথম পরীক্ষামূলক উড্ডয়ন সম্পন্ন করে এটি। এর পর তার দ্বিতীয় এবং তৃতীয় প্রোটোটাইপ বহুবার বিভিন্ন পর্যায়ে উড্ডয়ন সম্পন্ন করে।
তখন থেকে ধাপে ধাপে বিকশিত হতে থাকে আকিঞ্চি। সফটওয়্যার থেকে ইলেকট্রনিক্স, এভিওনিক্স থেকে অস্ত্র সিস্টেম পর্যন্ত প্রতিনিয়তই বাড়তে থাকে এর কার্যক্ষমতা। অবিশ্বাস্য উচ্চতায় উড্ডয়ন এবং টার্গেটে নিখুঁতভাবে আঘাত করাসহ নতুন নতুন রেকর্ড করে এগিয়ে চলতে থাকে আকিঞ্চির বিকাশ।
২২ এপ্রিল ২০২১। আকিঞ্চি কিলার ড্রোন সেদিন তুরস্কের রকেটসান কোম্পানির তৈরি MAM-C, MAM-L, MAM-T নামক তিনটি স্মার্ট মিনি গোলাবারুদ নিয়ে উড়াল দেয়। উদ্দেশ্য, তার টার্গেট আঘাতের সক্ষমতার পরীক্ষা। তিনটি গোলাবারুদই সেদিন তিনটি টার্গেটে নিখুঁতভাবে আঘাত করে আকিঞ্চির আগ্রগতি আরও একধাপ এগিয়ে নেয়।
ওয়ারহেড দিয়ে সফল পরীক্ষা
২০২১ সালের ৫ জুলাই পরিচালিত ফায়ারিং পরীক্ষায় প্রথমবারের মতো ওয়ারহেড গোলাবারুদ ব্যবহার করা হয়। লাইভ গোলাবারুদ সহ এই শুটিং পরীক্ষায়, AKINCI থেকে ছোড়া গোলাবারুদ আবারো নিখুঁত ভাবে লক্ষ্যমাত্রায় আঘাত করে সেটাকে ধ্বংস করে।
উচ্চতার রেকর্ড ভঙ্গ
৭ জুলাই ২০২১। এদিন আকিঞ্চি ড্রোনটি তুরস্কের বিমান চলাচলের ইতিহাসে উচ্চতার রেকর্ড ভঙ্গ করে। ৩৮,০৩৯ ফুট বা ১১,৫৯৪ মিটার অর্থৎ সাড়ে ১১ কিলোমিটার উচ্চতায় উড়তে সক্ষম হয় সেদিন। এর মাধ্যমে তুরস্কের নিজস্ব তৈরি কোনো আকাশযান এই প্রথমবারের মত এতো বিশাল উচ্চতায় উড্ডয়ন করে সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ করে।
এর দুই দিন পরে আকিঞ্চি ১,৩৬০ কিলোগ্রাম পেলোড নিয়ে উড়াল দেয়। এভাবে একে একে সব পরীক্ষা সফলভাবে সম্পন্ন করে তুরস্কের আকাশ রক্ষায় আকিঞ্চি নিজেকে পুরোপুরি প্রস্তুত করে।
এর পর আসে সে স্মরণীয় দিনটি ২৯ আগস্ট ২০২১। আকিঞ্চি এদিন জাঁকজমকপূর্ণ এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে যোগ দেয় তুরস্কের সামরিক বাহিনীতে। এভাবে মাত্র তিন বছরেরও কম সময় তুরস্কের বায়কার কোম্পানি তার সর্বশেষ প্রযুক্তির এই দানব ড্রোনটি হস্তান্তর করে তুরস্কের সামরিক বাহিনীতে। আর বিশ্ব অবাক বিস্ময়ে আরও একবার দেখে তুর্কিদের অগ্রগতি। হয়তো ফাতিহ সুলতান মেহমেত খানের পর বর্তমানেই তুর্কিরা সমরাস্ত্র প্রযুক্তিতে এত এডভান্সড টেকনোলজি বা উচ্চতর প্রযুক্তি ব্যবহার করতে সক্ষম হচ্ছে।
তুরস্ক, এই ড্রোন প্রযুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের পর বিশ্বের তৃতীয় দেশ হিসেবে নিজের স্থান করে নিলো নতুন আরেক উচ্চতায়।
এই ড্রোনটি কেন অন্যদের থেকে আলাদা
আকিঞ্চি ড্রোনটি তুরস্কের হাতে এখনো পর্যন্ত যত ধরণের ড্রোন আছে তাদের মধ্যে সবচেয়ে উন্নত টেকনোলজি দিয়ে সজ্জিত। দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থের দিক দিয়ে আকিঞ্চি ড্রোন বাইরাক্তার টিবি ২ এর চেয়ে অনেক বড়। ১২ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ৪ মিটার উচ্চতার এই ড্রোনটির দুই দিকের ডানার প্রস্থ ২০ মিটার করে। প্রায় ১০০টা কম্পিউটার সিস্টেম একত্রে কাজ করে এই রোবট বিমানে। ৪৫০ এইচপি এবং ৭৫০ এইচপি ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি টার্বোপ্রপ ইঞ্জিন দ্বারা চালিত হয় এই ড্রোনটি। এর আছে ৬ টোন পেলোড বহন করার ক্ষমতা। ড্রোনটি ৪০০ কেজি অভ্যন্তরীণ এবং ৯৫০ কেজি বহিরাগত ওজন সহ মোট ১৩৫০ কেজি দরকারি লোড যেমন গোলাবারুদ, রকেট, মিসাইল ইত্যাদি বহন করতে পারে।
এই মানবহীন এয়ারক্রাফট প্ল্যাটফর্মে আছে সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় ফ্লাইট কন্ট্রোল সিস্টেম এবং ৩ টি অতিরিক্ত অটোপাইলট সিস্টেম। যা ড্রোনটিকে দেয় উড্ডয়নের সময় সরবোচ্চ নিরাপত্তা।
এর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল এটিই হল প্রথম কোন ড্রোন যা এয়ার লঞ্চড ক্রুজ মিসাইল বা ALCM নিক্ষেপ করতে সক্ষম। বাইরাকতার আকিঞ্চি তুরস্কের নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি অনেক প্রকারের গোলাবারুদ এবং মিসাইল বহন করতে পারে। এদের মধ্যে আছে TUBITAK এবং Roketsan এর তৈরি মিনি গোলাবারুদ MAM-T, MAM-L, MAM-C, লেজার গাইডেড মিসাইল CİRİT, লেজার গাইডেড লং রেঞ্জ এন্টি ট্যাঙ্ক মিসাইল সিস্টেম L-UMTAS, লেজার নির্দেশিত মিনি ক্ষেপণাস্ত্র BOZOK, MK-81, MK-82, MK-83 নামক বোমা, এছাড়াও GÖKDOĞAN, BOZDOĞAN, NEB এবং SOM মিসাইল বহন এবং ছুড়তে পার এই ড্রোন।
ড্রোনটি সজ্জিত হয়েছে, ইলেকট্রনিক সাপোর্ট এবং কাউন্টারমেজার সিস্টেম, ডুয়েল স্যাটেলাইট কমিউনিকেশন সিস্টেম, এয়ার-টু-এয়ার রাডার, সংঘর্ষ এড়ানো রাডার এবং তুরস্কের নিজস্ব তৈরি সিন্থেটিক অ্যাপারচার রাডার দিয়ে।
এটি পরিচালিত হবে অতি উন্নত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে। উপরন্তু, বিমানের সেন্সর এবং ক্যামেরা থেকে প্রাপ্ত তথ্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংগ্রহ, রেকর্ড এবং বিশ্লেষণ করতে পারবে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে। এই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সিস্টেম, কোনো বাহ্যিক সেন্সর বা গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেমের বা জিপিএস এর সাহায্য ছাড়ই প্রয়োজনী লোকেশন এবং পজিশন শনাক্ত করতে সক্ষম। উন্নত আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সিস্টেমের প্রাপ্ত ডেটা প্রসেস করে নিজেরই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা রাখে এই ড্রোনটি।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবস্থার মাধ্যমে ভূমিতে থাকা লক্ষ্যবস্তু, যা মানুষের চোখ দ্বারা শনাক্ত করা যায় না এমন লক্ষ্যবস্তুগুলকেও শনাক্ত করতে পারে।
যুদ্ধবিমানের ওপর চাপ কমাবে এ ড্রোন
Bayraktar AKINCI তুরস্কের F-16 যুদ্ধ বিমান দ্বারা সঞ্চালিত কিছু কাজ ও সম্পন্ন করতে পারবে। যেমন এই ড্রোন যুদ্ধবিমানের মতই এয়ার টু এয়ার গোলাবারু বা ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করতে সক্ষম। সিন্থেটিক অ্যাপারচার রাডার (এসএআর) এর সাহায্যে, এটি খারাপ আবহাওয়াও হাজার হাজার ফুট উপর থেকে নিখুঁত ছবি তুলতে এবং ব্যবহারকারীর কাছে স্থানান্তর করতে পারে। এই মানবহীন আকাশ যানে আরও থাকবে দুটি আবহাওয়া রাডার যা এই শ্রেণির অন্য কোনো ড্রোনে নেই। এছাড়াও এই ড্রোনে যে ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়েছে তা তুরস্কের উৎপাদিত।
২০১৯ সালের ৬ ডিসেম্বর প্রথম পরীক্ষামূলক উড্ডয়নের পর থেকে, এই মানবহীন আকাশ যান পরীক্ষা কার্যক্রম এবং প্রশিক্ষণার্থীদের ট্রেনিংয়ের আওতায় ১১০০ এরও বেশি সোর্টি করেছে।
তুরস্কের পুরোপুরি শতভাগ নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি এই ড্রোনটি গত ২৯সে আগস্ট যোগ দেয় দেশটির সামরিক বাহিনীতে। এ বছরের শেষ নাগাদ মোট ৭ টি আকিঞ্চি ড্রোন যুক্ত হবে তুরস্কের সামরিক বাহিনীতে। বিদেশি ক্রেতারাও আকিঞ্চির প্রতি তাদের আগ্রহ দেখাবে বলে বিশ্বাস প্রস্তুতকারক কোম্পানিটির।