পাক সেনাবাহিনীর মেজর ছিলেন এই ভারতীয় গুপ্তচর
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ১৮ জুলাই ২০২০, ০৯:১৯ এএম
ছবি: আনন্দবাজার পত্রিকা
গুপ্তচরবৃত্তির জন্য ভারত তার প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানের সেনাবাহিনীতে এজেন্ট ঢুকিয়েছিল। ওই গুপ্তচর এক পর্যায়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর পর্যন্ত হয়ে যায়। তার আসল নাম রবীন্দ্র কৌশিক। তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে চাকরি নেন নবী আহমেদ শাকির নামে। কাজের সুবিধার্থে ও সন্দেহের উর্ধ্বে থাকতে তিনি রপ্ত করে নেন উর্দুর পাশাপাশি ইসলামিক সংস্কৃতির খুঁটিনাটি।
তার বীরত্বগাঁথা গল্প নিয়ে বিশেষ সচিত্র ফিচার প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম আনন্দবাজার পত্রিকা।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বিপক্ষের ঘাঁটিতে গিয়ে রবীন্দ্র কৌশিক (ছদ্মনাম নবী আহমেদ শাকির) যে পারদর্শীতা দেখিয়েছেন তার মতো কাজ আর কোনও ভারতীয় আন্ডারকভার এজেন্ট করতে পারেননি।
কে এই রবীন্দ্র কৌশিক?
১৯৫২ সালের ১১ এপ্রিল রাজস্থানের শ্রী গঙ্গানগরে জন্ম নেয়া রবীন্দ্র কৌশিক নিজের শহর থেকেই তিনি স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। লখনউয়ে জাতীয় স্তরের নাটক প্রতিযোগিতায় অভিনয় করেছিলেন তিনি। সেখানেই তাকে চোখে পড়ে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং বা ‘র’-এর কর্মকর্তাদের। তাকে তাদের পছন্দ হয়। এক পর্যায়ে রবীন্দ্রকে প্রস্তাব দেওয়া হয় পাকিস্তানে গিয়ে ‘র’-এর আন্ডারকভার এজেন্ট হয়ে কাজ করার। এর পর দু’বছর ধরে দিল্লিতে কঠোর অনুশীলন পর্ব চলে তার।
রাজস্থান-পঞ্জাব সীমান্ত শহর গঙ্গানগরের ছেলে রবীন্দ্র কৌশিক পাঞ্জাবিতে অভ্যস্ত ছিলেন। তাকে এমনভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, যাতে পাকিস্তানের জনজীবনে মিশে যেতে কোনও সমস্যা না হয়। উর্দুর পাশাপাশি রবীন্দ্রকে শেখানো হয় ইসলামিক সংস্কৃতির খুঁটিনাটি।
যেভাবে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীতে চাকরি পান রবীন্দ্র
১৯৭৫ সালে ২৩ বছরের তরুণ রবীন্দ্র দুবাই, আবুধাবি হয়ে পৌঁছান পাকিস্তানে। তার নতুন পরিচয় হয় নবি আহমেদ শাকির। নষ্ট করে ফেলা হয় তার ভারতীয় পরিচয়ের যাবতীয় নথি। পরবর্তীতে রবীন্দ্র কৌশিক ওরফে নবী আহমেদ শাকির করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন। কৃতিত্বের সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে নিযুক্ত হন কমিশন্ড অফিসার হিসেবে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনি মেজর পদে উন্নীত হয়েছিলেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক দরজির মেয়ে আমানতকে বিয়ে করেছিলেন রবীন্দ্র। তাদের একটি সন্তানও হয়েছিল।
যেভাবে রবীন্দ্র কৌশিকের আসল পরিচয় ফাঁস হয়ে যায়
১৯৭৯ থেকে ১৯৮৩ পর্যন্ত রবীন্দ্র কৌশিক বহু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ভারতে পাঠিয়েছিলেন। তার পাঠানো তথ্য দেশের প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
বলা হয়, ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় থেকে তার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ব্ল্যাক টাইগার’। এটাই ছিল তার সাংকেতিক নাম। কিন্তু আর এক ‘র’ এজেন্টের নির্বুদ্ধিতার মাশুল দিয়েছিলেন রবীন্দ্র।
আশির দশকের গোড়ায় ইনায়ৎ মসিহা নামে আর এক আন্ডারকভার এজেন্টকে পাঠিয়েছিল ‘র’। পরিকল্পনা ছিল, তিনি রবীন্দ্রর সঙ্গে যোগাযোগ করে তাকে কাজে সাহায্য করবেন। কিন্তু অভিযোগ, ইনায়তের নির্বুদ্ধিতায় সব গোপনীয়তার আবরণ খসে যায়। প্রথমে পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের কাছে ধরা পড়েন ইনায়ত। তার পর তিনি নাকি প্রকাশ করে দেন রবীন্দ্র কৌশিকের আসল পরিচয়।
পাকিস্তানে কী সাজা হয়েছিল রবীন্দ্র কৌশিকের?
শিয়ালকোটের এক ঘাঁটিতে দু’বছর জেরার নামে রবীন্দ্র কৌশিকের ওপর অকথ্য অত্যাচার করা হয়। ১৯৮৫ সালে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। পরে পাকিস্তান হাইকোর্টে তাঁর শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে পরিবর্তিত হয়। এরপর ১৬ বছর ধরে শিয়ালকোট, কোট লখপত, মিয়ানওয়ালিসহ পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরের কারাগারে ছিলেন বন্দি রবীন্দ্র।
রবীন্দ্র পরিবারের পরিবারের দাবি, কারাবন্দি অবস্থাতেও গোপনে চিঠি পাঠিয়েছিলেন তিনি। সেখানে লেখা ছিল, কী অকথ্য যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে তাকে যেতে হচ্ছে।
দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে নির্মম অত্যাচার সহ্য করার পরে ২০০১ সালে রবীন্দ্র কৌশিক মারা যান মুলতানের কেন্দ্রীয় কারাগারে। কিন্তু অধিকাংশ আন্ডারকভার এজেন্টদের মতো তাকেও সরকারিভাবে মেনে নেওয়া হয়নি।
ভারত সরকারের স্বীকৃতি চায় রবীন্দ্র পরিবার
যক্ষ্মাসহ একাধিক অসুখে আক্রান্ত ছিলেন তিনি। এর দু’ বছর পরে ভারতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তার বাবা। রবীন্দ্রর মা অমলাদেবী বেঁচে ছিলেন ২০০৬ অবধি। তত দিন পর্যন্ত ভারত সরকারের তরফে প্রতি মাসে সামান্য মাসোহারা পাঠানো হত। জানিয়েছেন তাঁর পরিজনরা।
তার পরিবারের দাবি, ভারত সরকারের তরফে কোনওরকম সাহায্য বা স্বীকৃতি পাওয়া যায়নি। ২০১২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত বলিউডের ছবি ‘এক থা টাইগার’ আসলে রবীন্দ্রর জীবনেরই কাহিনি, দাবি তার পরিবারের। কিন্তু তার জন্যেও কোনও স্বীকৃতি মেলেনি বলে, আক্ষেপ পরিজনদের।
ভারতীয় বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে তার ভাই আর এন কৌশিক বলেন, তাদের পরিবার অর্থ চায় না। তাদের দাবি, ভারত সরকার অন্তত ন্যূনতম স্বীকৃতিটুকু দিক। কারণ, এই গোপন এজেন্টরাই দেশের নিরাপত্তার মূল ভিত্তি।
ভারত সরকার যদি উর্দিধারী সেনানীদের সম্মান ও কুর্নিশ জানাতে পারে, তা হলে এজেন্টদের স্বীকৃতি দিতে এত দ্বিধা কেন? প্রশ্ন গুপ্তচর রবীন্দ্র কৌশিকের স্বজনদের।
সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা