১০০ বছরে তুরস্কের আনাদোলু এজেন্সি, প্রতিষ্ঠার গল্প
সারওয়ার আলম, চিফ রিপোর্টার, আনাদলু এজেন্সি, তুরস্ক
প্রকাশ: ০৬ এপ্রিল ২০২০, ০৯:৪১ এএম
সারওয়ার আলম, চিফ রিপোর্টার, আনাদলু এজেন্সি, তুরস্ক
১৯২০ সাল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ, বিশাল ওসমানী সম্রাজ্য ভেঙে খান খান। আনাতোলিয়ার (এশিয়া মাইনরের) অল্প একটু ভূখণ্ড আছে মাত্র তুর্কিদের হাত। শেষ ওসমানী সুলতান থাকতেও নেই, ইস্তানবুল দখল করে নিয়েছে ইউরোপীয়ও শক্তি।
কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে তুর্কিরা তাদের সর্বশেষ ভূখণ্ডটুকু রক্ষায় ব্যস্ত। আতাতুর্কের ডাকে বিভিন্ন এলাকা থেকে তুর্কিরা জড়ো হতে থাকে আংকারায় স্বাধীনতার সংগ্রামে যোগ দিতে। বর্তমান রাজধানী আংকারা তখন একটি শহর মাত্র। এই শহরটিই হয়ে উঠে যুদ্ধ পরিচালনার কেন্দ্রভূমি।
তখনকার ইস্তানবুলের এক সম্ভ্রান্ত বংশের মেয়ে নারীবাদী লেখক ও সাহিত্যিক হালীদে এদীপ আদিভের তুর্কিদের সংগ্রামে যোগদিতে আংকারার পথে রওনা দেন। পথে দেখা হয় সাংবাদিক ইউনুস নাদি আবালিওগ্লুর সঙ্গে। কথা হয় স্বাধীনতার যুদ্ধে রণাঙ্গনে যুদ্ধের পাশাপাশি কলমের যুদ্ধও চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে। আংকারায় পৌঁছে তারা কামাল আতাতুর্কের সঙ্গে দেখা করে স্বাধীনতা সংগ্রামে সংবাদ ও সংবাদপত্রের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেন তারা।
সেই দুর্দিনে আনাতোলিয়াতে তুর্কিদের সংগ্রমের খবর সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে উৎসাহ উদ্দীপনা জোগাতে আতাতুর্কের নির্দেশে প্রতিষ্ঠা হয় আনাদোলু এজেন্সী। ১৯২০ সালের ৬ এপ্রিল, নতুন সংসদের প্রথম অধিবেশনের মাত্র ১৭ দিন আগে।
তখন আংকারাতে কৃষি স্কুল (জিরাত ওকূল) এর একটা রুমে বসে খবর লেখা ও ছাপানোর কাজ শুরু হয়। কামাল আতাতুর্কের নির্দেশে আনাদোলু এজেন্সির বুলেটিনগুলো সব জায়গায় পৌঁছে দেয়ার জন্য দেশের মধ্যে সবধরনের যানবাহন ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়।
প্রথম বুলেটিন ছাপানো হয় প্রতিষ্ঠার ছয় দিন পরে ১২ এপ্রিল। তখন দিনে দুইবার প্রকাশ হতো আনাদোলু এজেন্সির বুলেটিন। এর ছয় দিন পর আতাতুর্ক ঘোষণা দেন যে আনাদোলু এজেন্সির কোনো বুলেটিন দেশের সর্বস্তরের জনগণের কাছে পৌঁছাতে বাধা দেয়া হলে তা দেশবিরোধী অপরাধ বলে গণ্য হবে।
এর দেড় বছর পরে আনুষ্ঠানিকভাবে আধুনিক তুরস্ক প্রতিষ্ঠা হয়।
সেই যে পথ চলা শুরু, আর বিরাম নেই। আজ ১০০ বছরে পদার্পণ এই এজেন্সির।
আনাতোলিয়ার ভয়েসকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দেওয়ার মিশনে সামনে নিয়ে তুরস্কের গ্র্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির (সংসদ) উদ্বোধনের ঠিক এক পাক্ষিক আগে প্রতিষ্ঠিত এই সংস্থাটি আজ এমন একটি স্থানে দাঁড়িয়েছে যেখানে থেকে সারা বিশ্বের ৬ হাজারেরও বেশি মিডিয়া আউটলেট প্রতিদিন শত শত সংবাদ, ছবি, ভিডিও এবং ইনফোগ্রাফিক্স নিয়ে পৌঁছে দিচ্ছে লক্ষ্য লক্ষ্য পাঠকের কাছে।
বিশ্বায়নের এই যুগে, নির্মম এবং নির্দয় প্রতিযোগিতায় যেখানে শক্তিমানরা সবসময় দুর্বলকে গ্রাস করতে ব্যস্ত, সেই সময়ে শুধু নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেই নয় বরং বিস্তৃতির ধারা অব্যাহত রেখে ১০০ বছরে পদার্পণ সাধারণ কোনো কীর্তি নয়।
এই একশো বছরে বিরামহীনভাবে সংবাদের এই অঞ্চলের সংবাদের প্রধান (সোর্স) সূত্রে পরিণত হয়েছে আনাদোলু এজেন্সী।
একশোরও বেশি দেশে বিস্তৃত তিন হাজারের অধিক সংবাদকর্মীর মাধ্যমে আনাদোলু এজেন্সী আন্তর্জাতিক বিষয়, রাজনীতি, অর্থনীতি, ব্যবসা, শক্তি, ক্রীড়া, প্রযুক্তি এবং অন্যান্য সব ঘটনা প্রবাহকে তাৎক্ষণিকভাবে ১৩টি ভাষায় প্রচার করছে।
এগুলো হল তুর্কি, ইংরেজি, আরবী, ফরাসী, স্পেনীয়, কুর্দি-কুরমানজি, কুর্দি-সোরানি, বসনিয়ান-ক্রোয়েশিয়ান-সার্বিয়ান, রাশিয়ান, আলবেনীয়, ফার্সি, ম্যাসেডোনীয় এবং ইন্দোনেশীয়।
তুরস্কের সংবাদপত্র, টেলিভিশন, অনলাইন সংবাদ পোর্টাল এবং রেডিওতে প্রতিদিন যত খবর, খবর সংক্রান্ত ভিডিও এবং ছবি প্রচার হয় তার ৮০ থেকে ৯০ ভাগই আনাদোলু এজেন্সির। এ সংবাদ সংস্থাটি এখন মধ্যপ্রাচের সবচেয়ে বড় এবং নির্ভরযোগ্য সংবাদ মাধ্যম।
এটি এখন বিশ্বের ১০টি প্রভাবশালী সংবাদ মাধ্যমের একটি হিসেবে ধরা হয়। মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে বড় সংবাদ মাধ্যম। আনাদোলু এজেন্সিটি মুসলিম দেশের একমাত্র বৈশ্বিক সংবাদ সংস্থা যা জি-২০ ফোরামের অংশ।
পশ্চিমা মিডিয়ার দাপটে যখন মুসলিম বিশ্বের মিডিয়ার আওয়াজ ম্লান হওয়ার উপক্রম। পশ্চিমা মিডিয়ার কাছে যখন মুসলিম বিশ্বের এবং অনুন্নত দেশের সংবাদ মানেই নেতিবাচক দিক। আনাদোলু এজেন্সী তখন ওই সব অঞ্চলের, স্বল্পোন্নত বা উন্নয়নশীল দেশের ইতিবাচক দিকগুলোকে তুলে ধরার অপার প্রয়াস চালিয়ে যাওয়ার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। শততম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে যুগান্তরের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পাঠকদের অন্তিম শুভেচ্ছা।