Logo
Logo
×

আন্তর্জাতিক

ইউরোপের দেশ বুলগেরিয়ার গল্প

Icon

রাকিব হাসান, স্লোভেনিয়া থেকে

প্রকাশ: ০২ এপ্রিল ২০২০, ০৭:১৯ পিএম

ইউরোপের দেশ বুলগেরিয়ার গল্প

বুলগেরিয়ার একটি শহরের ছবি

আজকে এমন একটি দেশ সম্পর্কে এখানে আলোচনা করা হবে যেখানে ইউরোপ মহাদেশের পূর্ব এবং পশ্চিমভাগের সংস্কৃতির এক অপূর্ব মেলবন্ধন খুঁজে পাওয়া যায়। প্রায় ৪২,৮৫৫ বর্গমাইল জায়গা জুড়ে থাকা দেশটির নাম বুলগেরিয়া। ইউরোপ মহাদেশে অবস্থিত দেশগুলোর মধ্যে বুলগেরিয়া অন্যতম প্রাচীন একটি দেশ যেখানে সেই প্রস্তর যুগের সময় থেকেই মানব সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া গেছে।

বুলগেরিয়া বলকান পেনিসুলার পূর্ব পার্শ্বে ইউরোপ এবং এশিয়ার ঐতিহাসিক সঙ্গমস্থলে অবস্থিত। সোফিয়া বুলগেরিয়ার রাজধানী। গ্রীক পুরানে সোফিয়া হচ্ছেন জ্ঞানের দেবী। বুলগেরিয়ান লেভ দেশটির জাতীয় মুদ্রা হিসেবে পরিচিত। ১ বুলগেরিয়ান লেভ = ০.৫১ ইউরো যা আমাদের বাংলাদেশী টাকায় ৫২.৩১ টাকার সমতুল্য। দেশটির সরকার ব্যবস্থা ইউনিটারি পার্লামেন্টারি রিপাবলিক, যেখানে প্রধানমন্ত্রী সরকার ব্যবস্থার সবচেয়ে প্রধান ব্যক্তিত্ব। বুলগেরিয়া তার উত্তরভাগে রোমানিয়া, পশ্চিমে সার্বিয়া এবং রিপাবলিক অব মেসিডোনিয়া, দক্ষিণে গ্রিস এবং তুরস্ক ও পূর্বে ব্ল্যাক-সি তথা কৃষ্ণসাগর দ্বারা পরিবেষ্টিত।

বুলগেরিয়া পাহাড়-পর্বত, নদ-নদী ও সমভূমির দেশ। উত্তর বুলগেরিয়ার পূর্ব-পশ্চিম বরাবর বলকান পর্বতমালা প্রসারিত। বলকান পর্বতমালার নামেই অঞ্চলটির নাম হয়েছে বলকান। তবে বুলগেরিয়ার সাধারণ মানুষ এ সকল পর্বতকে "স্টারা প্লানিয়া" বা প্রাচীন পর্বতমালা নামে ডাকে। ইউরোপের দ্বিতীয় দীর্ঘতম নদী ড্যানিয়ুব বুলগেরিয়ার উত্তর সীমান্ত গঠন করেছে।

দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপে অবস্থিত এ দেশটিতে সেই প্রাচীনকাল থেকেই মানব সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া গেছে। এ প্রাচীন মানব সভ্যতার মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য সংস্কৃতি ছিল। যেমন: হামাঙ্গিয়া, ভিনকা, ভারনা ইত্যাদি। কিছু কিছু ঐতিহাসিকগণের মতে এ ভারনা সংস্কৃতির মানুষদের মাঝে সোনার তৈরি বিভিন্ন অস্ত্র, ধাতব মুদ্রা এবং অলঙ্কারের ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে। সোনার তৈরি এ সকল অলংকারের বয়স প্রায় ছয় হাজার বছরের মত। যা পৃথিবীর সর্বপ্রথম তৈরি সোনার অলংকারের মধ্যে পড়ে।

বুলগেরিয়া নামটি এসেছে "বুলগার" শব্দ থেকে, যা প্রোটো-তার্কিক বংশোদ্ভূত লুপ্তপ্রায় কোনও একটি উপজাতি জনগোষ্ঠী। বুলগেরিয়ার ইতিহাস সম্পর্কে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে যে সেই লৌহ যুগ থেকে আরম্ভ করে অটোমান শাসকদের থেকে স্বাধীনতা লাভ করার আগ পর্যন্ত দেশটি থ্রাসিয়ান, পার্সিয়ান, রোমানসহ বিভিন্ন সাম্রাজ্যের অধীনে শাসনকাল অতিক্রম করে এসেছে। তারপর প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অতিক্রম করার পর ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত প্রায় দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছরের কমিউনিস্ট শাসনের পতন ঘটার পর ১৯৯০ সালের ১৫ নভেম্বর গণতান্ত্রিক এবং সাংবিধানিক আধুনিক বুলগেরিয়া রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠিত হয়। স্লাভরা বুলগেরিয়ার সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

ডেমোক্র্যাটিক এবং মুক্তবাজার অর্থনীতির পথে রূপান্তর বুলগেরিয়ার জন্য প্রথম দিকে সুখপ্রদ হয়নি। কমিউনিস্ট সরকারের পতন এবং সোভিয়েত বাজারে বুলগেরিয়ান পণ্যের বিলোপ ঘটায় দেশটির অর্থনীতির প্রবল সংকোচন ঘটে। মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্বের ঊর্ধ্বগতি, অবারিত দুর্নীতি এবং সমাজকল্যাণ ব্যবস্থার বিপর্যয় ঘটায় জীবনযাত্রার মানের চরম পতন ঘটে। অনেক বুলগেরিয়ান দেশ ছেড়ে চলে যান। তবে দেশটির সরকার কর্তৃক নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে গৃহীত সংস্কারগুলোর ব্যাপারে অটল থাকলে ধীরে ধীরে বৃহত্তর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জিত হয়।

২০০১ সাল থেকে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক-সকল দিক থেকে বুলগেরিয়া উন্নতি লাভ করতে শুরু করে। বর্তমানে তাই আন্তর্জাতিক মানব উন্নয়ন সূচকে বুলগেরিয়ার অবস্থান ৫৬তম। বুলগেরিয়া বর্তমানে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং ন্যাটোর মতো প্রতিপত্তিশালী সংস্থা তথা পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত দেশসমূহের গোষ্ঠীর সদস্য দেশ যেখানে জার্মানি, ফ্রান্স, রিপাবলিক অব আয়ারল্যান্ড, স্পেন, ইতালি এর মতো দেশ রয়েছে সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে। আগামী ২০২২ সালের মধ্যে রোমানিয়া ও ক্রোয়েশিয়ার সঙ্গে বুলগেরিয়াও সেনজেনভুক্ত দেশগুলোর তালিকায় সংযুক্তি লাভ করবে।

ইউরোপ মহাদেশে বুলগেরিয়া এমন একটি দেশ যেটি প্রতিষ্ঠাকাল থেকে আজ পর্যন্ত একই নাম ধারণ করে আছে। বুলগেরিয়ার বর্তমান জনসংখ্যা ৭.১ মিলিয়নের কিছু বেশি যা এর আগে ২০১১ সালে করা আদমশুমারি অনুযায়ী কিছুটা কম। বুলগেরিয়ার জনসংখ্যার বেশির ভাগ মানুষই বুলগেরিয়ান নামক এথনিক গোষ্ঠীর অংশ। সাংবিধানিক ভাষা বুলগেরিয়ান যা সিরিলিক স্ক্রিপ্টে লেখা হয়। সিরিলিক স্ক্রিপ্টের উৎপত্তি বুলগেরিয়া থেকেই এবং পরবর্তীতে যা রাশিয়া, মেসিডোনিয়া, সার্বিয়া, বেলারুশ, ইউক্রেন, মন্টিনিগ্রোসহ ইউরোপ এবং এশিয়ার বেশ কিছু স্থানে বিশেষত অর্থোডক্স খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা লাভ করে।

এ সকল অঞ্চলে ব্যবহৃত ভাষার বর্ণমালা হিসেবে পরবর্তীতে গৃহীত হয়। বুলগেরিয়ার জনসংখ্যার শতকরা ৭৮ ভাগ জনগোষ্ঠী খ্রিস্টান (মূলত: অর্থোডক্স খ্রিস্টান) এবং শতকরা ১৮ ভাগ জনগোষ্ঠী ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী। এছাড়াও অন্যান্য ধর্মের এবং কোন ধর্মে বিশ্বাস করে না এমন জনগোষ্ঠী রয়েছে সে দেশে। তবে সাংবিধানিকভাবে বুলগেরিয়া একটি সেক্যুলার অর্থাৎ ধর্ম-নিরপেক্ষ একটি রাষ্ট্র। জাতিগতভাবে বুলগেরিয়ানরা দক্ষিণ-পূর্ব স্লাভিক জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্গত।

ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতো বুলগেরিয়াতে ছেলে এবং মেয়ে উভয়ের জন্য উন্নতমানের শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতো বর্তমানে বুলগেরিয়ার সরকার দেশটির শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর জন্য সরকার বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করছে। দেশটির সাক্ষরতার হার শতকরা ৯৮.৬ ভাগ। দেশের প্রাচীন ইতিহাসের কারণে সাম্প্রতিক সময়ে দেশটির প্রায় নয়টি স্থান ইউনেস্কোর "World Heritage Site" হিসেবে ঘোষিত হয়েছে।

এ সকল স্থানের মধ্যে পিরিন ন্যাশনাল পার্ক, ঐতিহাসিক শহর নেসেবার এবং মাদারা নদী উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও প্রাচীনকালে বিভিন্ন স্থানে পুঁতে রাখা সোনার ভাণ্ডার পাওয়া গেছে। বর্তমানে যাকে সবচেয়ে পুরাতন সোনার ভাণ্ডারগুলোর মধ্যে অন্যতম মনে করা হচ্ছে। ভারনা নামক স্থানে অবস্থিত মিউজিয়ামগুলোতে এর কিছু নিদর্শন পাওয়া যায়। কিছু লোককথা অনুযায়ী আগুনের প্রভাব সে দেশের প্রাচীন সংস্কৃতিতে দেখা যায় যেখানে বলা হচ্ছে যে আগুনের প্রভাবে না কি দুষ্ট আত্মা এবং অশুভ প্রভাব থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। 

বহু প্রাচীনকালে এ সকল জিনিসের পরিচিতি ছিল যা বর্তমানে কুকেরি নামক কিছু আচার-অনুষ্ঠানে দেখা যায়। বুলগেরিয়ার বেশির ভাগ লোকসঙ্গীতে পূর্ব এবং পশ্চিম ইউরোপ এমনকি তুরস্ক ও গ্রীসের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু তা স্বত্বেও তারা তাদের গান, নৃত্য, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য-সব কিছুতেই কিছু অনন্যতা বজায় রেখে চলে যা ইউরোপ কিংবা এশিয়ার অন্য কোনও স্থানে খুঁজে পাওয়া যায় না। বহু শতাব্দী ধরে তারা এ স্বকীয়তা বজায় রেখে চলছে। ব্যাগপাইপ বুলগেরিয়ার জাতীয় বাদ্যযন্ত্র যা দেশটির স্থানীয় ভাষায় গাইদা নামে পরিচিত। 

আলবেনিয়া, সার্বিয়া, গ্রীস, মেসিডোনিয়া এ সকল দেশে এক সময় এ ব্যাগপাইপের প্রচলন ছিল তবে এখন তা হারিয়ে যেতে শুরু করেছে। বর্তমানে ইউরোপ মহাদেশের মাত্র তিনটি দেশে এ ব্যাগপাইপের প্রচলন রয়েছে। এ তিনটি দেশ হলও বুলগেরিয়া, স্কটল্যান্ড এবং আয়ারল্যান্ড। প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী এ দেশটির রন্ধন শিল্পে তুরস্ক এবং গ্রীসে দুই দেশের সংস্কৃতির প্রভাব পাওয়া যায়। কিছু খাবার যেমন: ইয়োগার্টের জন্ম বুলগেরিয়া থেকেই বলে মনে করা হয়।

আঙুর চাষের জন্য বুলগেরিয়ার বেশ নাম-ডাক রয়েছে। ইউরোপসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পানীয় তৈরিতে বুলগেরিয়ার আঙুরের বেশ কদর রয়েছে। গোলাপ ফুল চাষের জন্য দেশটি বেশ জনপ্রিয়। পশ্চিমে সোফিয়া এবং পূর্বে কৃষ্ণ সাগর পর্যন্ত নিম্নভূমিটি গোলাপের উপত্যকা নামে পরিচিত। তিন শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে এখানকার কৃষকেরা কাজানলাক নামক বিশেষ প্রজাতির গোলাপের চাষ করে আসছেন। এই গোলাপের তেল থেকে তৈরি এক ধরণের অত্যন্ত দুর্লভ নির্যাস বুলগেরিয়ার অন্যতম প্রধান রপ্তানি পণ্য।

ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যস্থলে অবস্থিত হওয়ায় বুলগেরিয়াকে নিয়ে বহু শক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে। বহু শতাব্দী ধরে বুলগেরিয়া একটি স্বাধীন রাজ্য ছিল। মধ্যযুগে এসে দীর্ঘ সময় ধরে একটি প্রধান শক্তি ছিল। প্রথম বুলগেরীয় সাম্রাজ্যের সময় (আনুমানিক ৬৩২ কিংবা ৬৮১ সাল থেকে ১০১৮ সাল পর্যন্ত) এখানকার শাসকেরা বলকান উপদ্বীপের অধিকাংশ এলাকা শাসন করেছেন। ১৩৯৩ সালে বুলগেরিয়া অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে আসে। প্রায় ৫০০ বছর উসমানীয় সাম্রাজ্যের অধীনে শাসিত হবার পর ১৮৭৮ সালে সান স্টেফানোর চুক্তির মাধ্যমে বুলগেরিয়া একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। 

১৯১২ এবং ১৯১৩ সালে সংগঠিত প্রথম বলকান যুদ্ধে জয়ী হলেও দ্বিতীয় বলকান যুদ্ধে দেশটি হেরে যায় এবং গ্রিস, সার্বিয়া ও রোমানিয়ার কাছে অনেক এলাকা হারায়। অতীতকাল থেকে চাষাবাদের ওপর নির্ভরশীল এ দেশটি ক্রমেই হয়ে উঠছে আধুনিক শিল্পসমৃদ্ধ এবং উন্নত প্রযুক্তিগত অর্থনৈতিক অবস্থাসম্পন্ন রাষ্ট্র। যেখানে প্রতিনিয়ত বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে আরম্ভ করে যন্ত্রপাতি নির্মাণ শিল্প, খনিজ তেল শোধনের মতো বৃহৎ শিল্পে দেশের একটি বিরাট অংশ নিযুক্ত আছে। এ ধরণের উৎকর্ষতার দরুন দেশটি বর্তমানে সুপার কম্পিউটার নির্মাণ এবং মহাকাশ বিজ্ঞানে সাহায্যকারী প্রযুক্তির দিকে যথেষ্ট এগিয়ে রয়েছে। 

উন্নত প্রযুক্তিসম্পন্ন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার এ দেশটিতে ২০০৭ সাল থেকে পর্যটন খাত ব্যাপক প্রসার লাভ করছে। বুলগেরিয়ার পূর্বে কৃষ্ণ সাগরের উপকূল উত্তরে খাড়া পার্বত্য ঢাল থেকে দক্ষিণে বালুকাময় সৈকতে নেমে এসেছে। এখানকার পর্যটন কেন্দ্রগুলো সারা বিশ্ব থেকে লোক বেড়াতে আসে। উত্তরের পর্বতমালাতে শীতকালে ঘন তুষারে ঢেকে যায়। ফলে শীতকালে এখানে স্কি কিংবা আইস হকির মতো উইন্টার স্পোর্টসের জমজমাট আসর বসে। গ্রেট ব্রিটেন, জার্মানি, হাঙ্গেরি, অস্ট্রিয়া, রাশিয়াসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের কাছে গ্রীষ্মকালীন অবকাশ উপভোগ করার জন্য কৃষ্ণ সাগরের নান্দনিক সমুদ্র সৈকত এবং বোরোভেটসের মতো রিপোর্ট খুবই জনপ্রিয়।

এছাড়া দেশটির রাজধানী সোফিয়া, প্রাচীন শহর ভেলিকো টার্নোভো, রিলা মনাস্টেরি ভ্রমণ করতে প্রতি বছর দেশটিতে অসংখ্য পর্যটক পাড়ি জমান বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে। এছাড়াও প্লোভদিভ নামক শহরটিতে রোমানদের তৈরি থিয়েটারটি বিশেষভাবে পর্যটকদের আকর্ষণ করে। এ থিয়েটারটি এখনও বিভিন্ন উৎসবের সময় নানা ধরণের অনুষ্ঠানের আয়োজনে ব্যবহার করা হয়। পাহাড় এবং লেক দ্বারা আচ্ছাদিত সেভেন রিলা লেকের এর মনোরম সৌন্দর্য যে কাউকে হাতছানি দেয়। এছাড়া বুলগেরিয়ার অন্যান্য ট্যুরিস্ট স্পটগুলোর মধ্যে রয়েছে রুজে এবং গ্যাব্রোভো। 

হাস্যরসাত্মক এবং লেজকাটা বিড়ালের শহর হিসেবে গ্যাব্রেভোর কথা আমরা ষষ্ঠ শ্রেণীতে অধ্যয়নকালীন সময় বাংলা বইতে জানতে পেরেছি ডঃ মুহম্মদ এনামুল হকের লেখা এক প্রবন্ধ থেকে। আলেকজান্ডার নেভস্কি ক্যাথেড্রাল বুলগেরিয়ার রাজধানী সোফিয়াতে অবস্থিত একটি বিখ্যাত অর্থোডক্স চার্চ। বুলগেরিয়ার বেশীর মানুষই অর্থোডক্স খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী হওয়ায় তাদের ব্যক্তিগত জীবনে এ চার্চটির প্রভাব বিশেষ ভাবে গুরুত্বপূর্ণ; আর বুলগেরিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে ক্যাথেড্রালটি বিশেষভাবে জড়িত।

১৮৭৯-সালে যখন বুলগেরিয়া যখন তুরস্কের অটোমান শাসকদের এর কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে তখন বুলগেরিয়ার পক্ষ থেকে অটোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য তেমন কোনও সুসংগঠিত মিলিটারি ফোর্স ছিল না। এ সময় রাশিয়া বলকান অঞ্চলে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে আরম্ভ করে এবং এরই জেরে রাশিয়া সে সময় বুলগেরিয়াকে সামরিক শক্তি দিয়ে সাহায্য করে অটোমানদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য। স্টেফানোর চুক্তির মাধ্যমে বুলগেরিয়া পরবর্তীতে স্বাধীনতা অর্জন করলে রাশিয়ানদের প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ এবং বুলগেরিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহতদের স্মরণে এ ক্যাথেড্রালটি নির্মাণ করে। সম্পূর্ণ ক্যাথেড্রালটি নির্মাণ করতে প্রায় ৩০ বছরের মতো সময় লাগে এবং ১৯২৪ সালে এটি সকল জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। 

নভোগডের রাজকুমার এবং বিখ্যাত ধর্মযাজক আলেকজান্ডার নেভস্কির নাম অনুসারে এ ক্যাথেড্রালটির নাম রাখা হয় আলেকজান্ডার নেভস্কি ক্যাথেড্রাল। আলেকজান্ডার নেভস্কি ক্যাথেড্রাল বর্তমান পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় অর্থোডক্স চার্চগুলোর মধ্যে একটি। অসাধারণ স্থাপত্যশৈলীর এ নিদর্শন প্রত্যেক বছর আকর্ষণ করে অসংখ্য পর্যটককে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। বর্তমানে যেখানে গাড়ির ইন্ধন এবং মানুষের বৈদ্যুতিক ও জ্বালানির চাহিদা মেটাতে বিকল্প কোনও উৎসের অনুসন্ধানে ব্যস্ত সেখানে বুলগেরিয়া এখন নিউক্লিয়ার পাওয়ার স্টেশনের সঙ্গে সঙ্গে বায়ু এবং সৌরশক্তি দ্বারা উৎপন্ন শক্তিকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের শক্তির চাহিদা পূরণ করতে বিশেষ সাফল্য লাভ করছে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে।

বলকান পেনিসুলার অন্তর্গত দেশ বুলগেরিয়ার যাত্রা শেষ করার আগে দেশটির সম্পর্কে কিছু অবাক করা তথ্য এখানে তুলে ধরা হলো। বুলগেরিয়ার সাধারণ মানুষ হাত দিয়ে ইশারা করার পরিবর্তে মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যা কিংবা না বলার অভ্যাসটা বেশি প্রদর্শন করে থাকে। বলা হয়ে থাকে যে বুলগেরিয়ার সেনাবাহিনী না কি তাদের দেশে সংগঠিত হওয়া বর্তমান কিংবা প্রাচীন কালের কোন যুদ্ধ নেই যেখানে তারা নিজেদের পতাকাটিকে হারিয়ে ফেলেছে অথবা যুদ্ধক্ষেত্রে ফেলে চলে এসেছে। বুলগেরিয়ান এয়ার ফোর্সের পাইলট রায়না কাসাবোভা বিশ্বের প্রথম কোন মহিলা ছিলেন যিনি মিলিটারি ফ্লাইটে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ১৯৭৬ সালে আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউনেস্কোর দ্বারা প্রাচীন বুলগেরিয়ানদের হাতে করা ক্যালেন্ডারটিকে সঠিক ক্যালেন্ডার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। 

বিশ্বের অন্যতম সেরা কিছু অ্যাথলেটদের মধ্যে বুলগেরিয়ার বেশ কিছু অ্যাথলেট রয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় স্পোর্টস ফুটবল দেশটির সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা। ১৯৯৪ সালে অনুষ্ঠিত ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপ টুর্নামেন্টে বুলগেরিয়া কোয়ার্টার ফাইনালে লোথার ম্যাথিউস এবং ইয়ুর্গেন ক্লিন্সম্যানকে নিয়ে গড়া শক্তিশালী জার্মানির মতো প্রতিপক্ষকে হারিয়ে সেমি-ফাইনালে উঠার গৌরব অর্জন করেছিল এবং সে বছর ফিফার সর্বোচ্চ সম্মাননা ব্যালন ডি'অর জেতা ফুটবলার হ্রিস্ট্রো স্টোইচকোভ ছিলেন একজন বুলগেরিয়ান। বুলগেরিয়ান লেভ পূর্ব ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে স্থিতিশীল মুদ্রা এবং বুলগেরিয়ার অর্থনীতি বর্তমানে ইউরোপ তথা সারা বিশ্বে দ্রুত অগ্রসর হওয়া অর্থনীতিগুলোর মধ্যে একটি।

রাকিব হাসান, শিক্ষার্থী, দ্বিতীয় বর্ষ, ব্যাচেলর অব সায়েন্স ইন ফিজিক্স অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া থেকে

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম