Logo
Logo
×

আন্তর্জাতিক

বেওয়ারিশ লাশ সৎকার করে ছেলের মৃত্যুশোক ভোলেন শরিফ

Icon

যুগান্তর ডেস্ক

প্রকাশ: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১১:৩৮ এএম

বেওয়ারিশ লাশ সৎকার করে ছেলের মৃত্যুশোক ভোলেন শরিফ

ভারতের অযোধ্যায় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় অনেকেই স্বজন হারিয়ে মানসিক ট্রমা কাটিয়ে উঠতে পারেননি।

মোহাম্মদ শরিফও তাদের মধ্যে একজন। তিনি বলেন, আমার ছেলে যখন নিখোঁজ হয়ে গেল, তখন আমি তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম চারদিকে। এক মাস ধরে খুঁজেছি পাগলের মতো। খবর বিবিসির।

নিজের ছেলেকে হারিয়ে মোহাম্মদ শরিফ হয়ে যান এক অন্য মানুষ। নিজের ছেলের লাশ দাফন করতে না পারার বেদনা ভুলতে পেরেছেন অন্যদের লাশ সৎকার করে।

একজন আর দুজন নয়, ভারতীয় গণমাধ্যমে এই সংখ্যা ২৫ হাজার পর্যন্ত হতে পারে বলে বলা হচ্ছে।

মোহাম্মদ শরিফ জন্মের পরই তার মাকে হারিয়েছিলেন। বড় হয়েছেন দাদা-দাদির কাছে। তাকে স্কুলে পাঠানোর সাধ্য তাদের ছিল না।

খুব অল্প বয়সে তাকে কাজে নেমে পড়তে হয়। কীভাবে বাইসাইকেল মেরামত করতে হয়, সেই কাজ শিখেছিলেন।

কিন্তু নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া এক বিয়োগান্তক ঘটনার পর পঞ্চাশোর্ধ জীবনে এসে সমাজসেবকের কাজে জড়িয়ে যান।

মোহাম্মদ শরিফের এই অসাধারণ কাজের কথা প্রথম জানা যায় ভারতে তাকে একটি মর্যাদপূর্ণ রাষ্ট্রীয় সন্মাননা 'পদ্মশ্রী' দেয়ার পর।

'শরিফ চাচা'র জন্য এই সন্মাননা এলো এক দীর্ঘ কষ্টসাধ্য জীবনের শেষপ্রান্তে।

একদিন এক পুলিশ অফিসারকে নদীতে একটি লাশ ছুড়ে ফেলতে দেখে সাংঘাতিক বিচলিত হয়ে পড়েন মোহাম্মদ শরিফ।



সেদিনই তিনি প্রতিজ্ঞা করেন, আজ থেকে আমিই হব বেওয়ারিশ লাশের অভিভাবক। আমি বেওয়ারিশ লাশের সৎকার করব।

গত ২৮ বছর ধরে মোহাম্মদ শরিফ সেই প্রতিজ্ঞা রক্ষা করে চলেছেন। তার নিজের ছেলে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় নিহত হয়েছিলেন অযোধ্যায়। ছেলের লাশ কোনো দিন তিনি খুঁজে পাননি।

উত্তর ভারতের অযোধ্যা শহরে অশীতিপর মোহাম্মদ শরিফকে সবাই ডাকেন 'শরিফ চাচা' বলে। নিজের পরিবারের কারও লাশ হলে যেভাবে করতেন, সেভাবেই তিনি দাফন করেন বেওয়ারিশ লাশ।

এই জীবনে ঠিক কত বেওয়ারিশ লাশ তিনি দাফন করেছেন, কত শবদেহ চিতায় পুড়িয়েছেন, তার হিসাব নিজের কাছেই নেই। অযোধ্যা ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিলের প্রধান অনুজ কুমার ঝা জানিয়েছেন, তারা কত বেওয়ারিশ লাশ মোহাম্মদ শরিফের হাতে তুলে দেন, সেই তথ্য তাদের কাছেও নেই।

তিনি বলেন, আমাদের অনুমান হচ্ছে প্রায় আড়াই হাজার লাশ হয়তো আমরা তার হাতে তুলে দিয়েছি। মোহাম্মদ শরিফের পরিবারের ধারণা, তিনি হয়তো প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বেওয়ারিশ লাশের সৎকার করেছেন। কিন্তু ভারতীয় গণমাধ্যমে এই সংখ্যা ২৫ হাজার পর্যন্ত হতে পারে বলে বলা হচ্ছে।

নানা কারণে বেওয়ারিশ লাশের স্তূপ জমে ওঠে। কেউ হয়তো সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। কেউ রেল দুর্ঘটনায়। কেউ নিজের বাড়ি থেকে বহুদূরের কোনো জায়গায় মারা গেছেন।

তীর্থযাত্রী, অভিবাসী, সন্তান পরিত্যক্ত বৃদ্ধ– এ রকম নানা মানুষের লাশ। হাসপাতালে মারা যাওয়া দরিদ্র মানুষ, যাদের লাশ সৎকার করার কেউ নেই। হাজার হাজার বেওয়ারিশ লাশের জানাজা পড়েছেন তিনি।

কিন্তু এই কাজের জন্য ধন্যবাদ মেলে খুব কমই। মোহাম্মদ শরিফের এই অসাধারণ কাজের কথা প্রথম জানা যায় ভারতে তাকে একটি মর্যাদাপূর্ণ রাষ্ট্রীয় সন্মাননা 'পদ্মশ্রী' দেয়ার পর।



মোহাম্মদ শরিফের ছেলে মোহাম্মদ রইস ১৯৯২ সালের হিন্দু মুসলিম দাঙ্গায় নিহত হয়েছিলেন। পুলিশ বলেছিল, তার লাশ পচে গিয়েছিল। আমরা ওর লাশ দেখিনি। আমরা শুধু তার কাপড়-চোপড় পেয়েছিলাম।

ভারতে এখন যে দলটি ক্ষমতায়, সেই ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপির নেতৃত্বে হিন্দু মৌলবাদীরা ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে অযোধ্যায় ষোড়শ শতকে নির্মিত বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলে।

এ ঘটনার পর উত্তর ভারতজুড়ে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা শুরু হয়। শত শত নিরীহ মানুষ সেই দাঙ্গায় মারা যান।

মোহাম্মদ শরিফের স্ত্রী ছেলে হারানোর শোক সামলে উঠতে পারেননি আজ পর্যন্ত। মোহাম্মদ শরিফ আজও জানেন না, তার ছেলেকে কে কোথায় কীভাবে হত্যা করেছে।

শরিফ বলেন, আমার মনে হয়, অন্যদের লাশ যেভাবে নদীতে ছুড়ে ফেলা হয়েছে, আমার ছেলের লাশও হয়তো সেভাবে নদীতে ফেলে দেয়া হয়েছিল।

সেই সময় ভারতের অনেক জেলাতেই কোনো মর্গ ছিল না। কাজেই বেওয়ারিশ লাশ এভাবে ফেলে দেয়াটাই ছিল নিয়ম। এ রকম লাশ এমনিতে মাটিচাপা দেয়ার কথা। কিন্তু সময় ও খরচ বাঁচাতে উত্তর ভারতে নদীতে লাশ ফেলে দেয়ার প্রচলনই বেশি ছিল।

শেষে তারা ধারণা করলেন, হয়তো মোহাম্মদ রইসের মরদেহ ৫০ কিলোমিটার দূরের গোমতি নদীতে ফেলে দেয়া হয়েছে।

মোহাম্মদ রইসের অকাল মৃত্যু তার বাবা-মাকে সাংঘাতিক বিপর্যস্ত করে দিল। তার মা তীব্র বিষণ্নতায় আক্রান্ত হলেন। এ থেকে তিনি এখনও সেরে উঠতে পারেননি। ছেলের লাশকে যে ঠিকমতো দাফন পর্যন্ত করতে পারেননি, এটি তাদের জন্য আরও বেশি মনোবেদনার কারণ হয়ে দাঁড়াল।

কিন্তু এই মানসিক আঘাত মোহাম্মদ শরিফের জীবনে এক বড় বাঁক ঘুরিয়ে দিল। তিনি বেওয়ারিশ লাশ সন্মানজনকভাবে সৎকারের ব্যবস্থা করার অঙ্গীকার করলেন এবং সেই কাজে নেমে পড়লেন।

তিনি মনে মনে ঠিক করলেন, নিজের জেলায় কোনো বেওয়ারিশ লাশ তিনি নদীতে ছুড়ে ফেলতে দেবেন না। হিন্দুদের দেহ তাদের ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী দাহ করেন মোহাম্মদ শরিফ।

যে কাজ কেউ করতে রাজি নয়, তিনি সেই কাজটি করতে চান বলে জানালেন পুলিশকে। প্রথম যেদিন তাকে এই কাজে ডাকা হলো, তার বুক ধুকপুক করছিল। পোস্টমর্টেমের পর পুলিশ তাকে লাশ নিয়ে যেতে বলল। শরিফের পরিষ্কার মনে আছে, ওই লোকটির ঘাড় কাটা ছিল।

লাশ সৎকারের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন মোহাম্মদ শরিফ। তার কাজের চাপ বেড়ে গেল। লাশ বহনের জন্য তখন তিনি চার চাকার একটি ঠেলাগাড়ি কিনলেন।

বেওয়ারিশ লাশ সৎকার নিয়ে তার এই ঘোর পছন্দ করছিল না পরিবার, বন্ধুবান্ধব বা প্রতিবেশীরা। এটি নিয়ে কেউ খুশি ছিল না। সবাই বলত, আমি পাগল হয়ে গেছি।

শরিফ বলেন, কখনও লাশ দেখে তার ঘেন্না হয় না। কিন্তু অন্য মানুষের মতোই গলিত মৃতদেহ দেখে তার মনে আঘাত লাগে। লাশের পচা গন্ধ তার ওপরও প্রতিক্রিয়া তৈরি করে।

কোনো বিকৃত বা গলিত মৃতদেহ দেখার পর শরিফের ঘুমাতে কষ্ট হয়। তিনি দুঃস্বপ্ন দেখেন। তখন তাকে ঘুমের ট্যাবলেট খেতে হয়।

মোহাম্মদ শরিফের বয়স হয়েছে, কিন্তু এই কাজের ভার যে আর কারও কাছে ছেড়ে দেবেন, সে রকম কেউ নেই।

শরিফের কথা– যদি আমি না থাকি, পুলিশ আবার বেওয়ারিশ লাশ নদীতে ফেলে দেবে। এটি তিনি মেনে নিতে পারেন না। আমি আমার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত এই কাজ করে যেতে চাই।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম