
ভারতীয় মুসলিম ব্যবসায়ী শওকত আলী। ছবি; সংগৃহীত
ভোট শেষ। গণনাও শেষের পথে। বুথফেরত সমীক্ষার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে ভোটের গণনাও।
তাই আবারও ক্ষমতায় ফিরছেন নরেন্দ্র মোদি। আর মোদি ফের ক্ষমতায় ফিরলেই গ্রাম ছাড়বেন উত্তরপ্রদেশের নয়াবাসের কয়েকশ’ পরিবার। খবর ইন্ডিয়া টুডের।
গ্রামের মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা জানিয়েছেন, আগের মতো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ছবি আর গ্রামে নেই। আগে এখানে হিন্দু-মুসলমান ভাই ভাই হিসেবে একসঙ্গে বাস করতেন।
জন্ম হোক কিংবা মৃত্যু, বিয়ে হোক বা যেকোনো অনুষ্ঠান একে অন্যকে পাশে পেতেন সবাই। সর্বধর্ম সমন্বয়ের ঐতিহ্যকে আগলে বাঁচতেন এখানকার মানুষ। কিন্তু বর্তমানে সেই ছবি পুরোটাই বদলে গেছে।
এখন আর পথ চলতে দেখা হলেও কেউ কারও সঙ্গে কথা বলতে পারেন না। বিপদে কেউ কারও পাশেও থাকেন না। ধর্মের বেড়াজালই যেন এখন মূল ইস্যু। আর তাই এহেন সিদ্ধান্ত।
গ্রামেরই এক বাসিন্দা চা দোকানের মালিক গুলফাম আলি বলেন, ‘এর আগে জীবনের দুঃসময় এবং সুসময়ে হিন্দু-মুসলমান সবাই একসঙ্গে থাকতাম। যেকোনো অনুষ্ঠানে একসঙ্গে আনন্দ করেছি। তেমনই দুঃখের দিনে একে অপরের পাশে থেকেছি।
কিন্তু বর্তমানে আমাদের জীবনধারা কেমন যেন বদলে গেছে। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন। এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হন যোগী আদিত্যনাথ। দুই সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে বিভেদের অন্যতম ‘রূপকার’ও কিন্তু তারা দু’জনেই।’
তিনি আরও অভিযোগ করেন, ‘হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিভেদ তৈরি করাই মূল লক্ষ্য দুজনের। এভাবে এই এলাকায় বাস করা যায় না।’ কিন্তু বললেই তো আর বসতভিটে-ব্যবসা ছেড়ে চলে যাওয়া যায় না। তাই যেতে পারছেন না বলেও দাবি তার।
গ্রামের বেশিরভাগ বাসিন্দার বক্তব্য, আতঙ্কে দিন কাটছে তাদের। রমজান পালন করছেন সবাই। অনেকেই আবার বলছেন, রোজা পালন করতেও নাকি বারবার বাধা পাচ্ছেন তারা।
মাদ্রাসায় মাইকের ব্যবহার বন্ধ করতে নাকি চাপ দেয়া হচ্ছে তাদের। শান্তির জন্য অনেক মাদ্রাসা বাধ্য হয়ে মাইকের ব্যবহারও বন্ধ করে দিয়েছে।
আর তাই আবারও বিজেপি ক্ষমতায় এলে নয়াবাস ছাড়ার কথা ইতিমধ্যে ভেবে ফেলেছেন মুসলিম ধর্মাবলম্বী গ্রামবাসী।
এদিকে গত বৃহস্পতিবার বিবিসির এক প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে মুসলিমদের সেই ভয়।
লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দফার ভোটের কয়েক দিন পরেই একদল দুর্বৃত্তের রোষানলে পড়েন আসামের মুসলিম ব্যবসায়ী শওকত আলী।
ওই ব্যবসায়ীকে ঘিরে ধরেন কয়েকজন। তাকে কাদামাটির মধ্যে হাঁটু গেড়ে বসতে বাধ্য করা হয়। ভিড়ের ভেতর থেকেই একজন চিৎকার করে বলেন, তুমি কি বাংলাদেশি?
অন্য একজন তাকে ধাক্কা দিয়ে বলেন, এখানে গো-মাংস বিক্রি করছ কেন? আশপাশের লোকজন তাকে সাহায্য করার বদলে এ ঘটনা ক্যামেরাবন্দি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
ওই ঘটনার এক মাস পেরিয়ে গেলেও এখনও স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারেন না শওকত আলী। বিছানায় শুয়ে ওই ভয়াবহ ঘটনা মনে করতেই চোখে পানি চলে আসে ৪৮ বছর বয়সী এ ব্যবসায়ীর।
তিনি বলেন, তারা লাঠি দিয়ে আমাকে পিটিয়েছে। আমার মুখে লাথি মেরেছে। তিনি এবং তার বাবা কয়েক দশক ধরেই আসামে একটি ছোট খাবারের দোকান চালান। সেখানে অন্য খাবারের সঙ্গে গো-মাংসও থাকে। কিন্তু আগে কখনওই তাকে এজন্য এমন সমস্যার মুখে পড়তে হয়নি।
শওকত আলী বলেন, আমার আর বেঁচে থাকার কোনো মানেই নেই। তারা আমার ওপর নয়; বরং আমার ধর্মীয় বিশ্বাসের ওপর আক্রমণ করেছে।
এ ঘটনার পর মুসলিম সম্প্রদায়ের অনেকেই শওকত আলীর সঙ্গে দেখা করতে আসেন। তার মুখে সব শুনে অনেকেই কেঁদে ফেলেন। তাদের মধ্যে এখন একটাই আতঙ্ক বিরাজ করছে যে, সামনের দিনগুলোতে তাদেরও হয়তো এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে।
আসামে নাগরিকপঞ্জির ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে বিজেপি। যারা ভারতের নাগরিক নন তাদের বের করে দেয়ার হুমকি দেয়া হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে দেখা যাচ্ছে, এখানেও বেছে বেছে মুসলিমদের ওপরই ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বেশি।
ভারতে বর্তমানে ১৭ কোটি ২০ লাখ মুসলিম বাস করেন। বর্তমানে মোদির শাসনামলে গো-মাংস ক্রয়, বিক্রয়, সঙ্গে বহন করা বা খাওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে বহু মুসলিমকে হত্যা করা হয়েছে।
ফেব্রুয়ারিতে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানায়, ২০১৫ সালের মে থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারতের ১২ রাজ্যে অন্তত ৪৪ জনকে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩৬ জনই মুসলিম।