কাশ্মীরে বিচ্ছিন্নতাবাদে উচ্চ শিক্ষিতদের হার বাড়ছে
জোয়ান্না স্ল্যাটার
প্রকাশ: ৩০ মার্চ ২০১৯, ০৪:২৩ এএম
কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়। ছবি: ওয়াশিংটন পোস্ট
তিনি এমন একজন অধ্যাপক ছিলেন, শিক্ষার্থীরা যাকে মর্যাদার সঙ্গে দেখতেন, ভালোবাসতেন। শিক্ষার্থীদের পুস্তক উপহার দিতেন, ভালো পরামর্শ কিংবা অর্থ সহায়তাও করতেন তিনি। সমাজবিজ্ঞান বিভাগে তার সহকর্মীরা তাকে একজন নির্ভরযোগ্য ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী হিসেবে ভাবতেন।
ভোক্তা অধিকার নিয়ে তার গবেষণা দিয়ে ভারতের যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগে তিনি অনায়াসে যোগদান করতে পারতেন।
গত বছরের কোনো এক শুক্রবারে কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজের অনুষদের বৈঠকে দেখা যায়নি তাকে। তার চরিত্রের সঙ্গে যেটা একেবারে বেমানান। কিন্তু তিনি কোথায় আছেন, তা কেউ জানেন না। এমনকি তার পরিবারের কাছেও তার খোঁজ নেই।
ঠিক দুদিন পরে তার সহকর্মীরা টেলিভিশনের সংবাদ দেখতে বসলে আঁতকে উঠলেন। অধ্যাপক মোহাম্মদ রাফি ভাট নিহত। কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের একটি গোষ্ঠীতে তিনি সক্রিয় ছিলেন। ফলে নিরাপত্তা বাহিনী তাকে হত্যা করেছে।
একজন মেধাবী গবেষক থেকে তিনি বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। কাশ্মীরজুড়ে এই প্রবণতা এখন অহরহ।
সরকারি হিসাব বলছে, ২০১৮ সালে বিপুল সংখ্যক তরুণ কাশ্মীরে বিচ্ছিন্নতাবাদে যোগ দিয়েছেন। যেটা ক্রমাগত বাড়ছে।
এতে কাশ্মীরে ভারতবিরোধী বিদ্রোহী নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। গত কয়েক বছর আগে যেটা কমে গিয়েছিল।
রাফি ভাটের মতো উচ্চ শিক্ষিত ও মেধাবীরা সশস্ত্র বিদ্রোহে যোগ দিচ্ছেন। সম্ভাবনাময় ক্যারিয়ার উচ্চ বেতনের চাকরির হাতছানি ছেড়ে তারা ভারতীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে সরাসরি লড়াইয়ে নামছেন।
এছাড়া গ্রামীণ এলাকায় স্কুল থেকে ঝড়ে পড়া কিশোররা বিদ্রোহীদের সঙ্গে সঙ্ঘবদ্ধ হয়েছেন। কাশ্মীরের একটি অংশে তিন দশক ধরে ভারতবিরোধী লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ছেন তারা।
ভূস্বর্গ বলে পরিচিত এই হিমালায় অঞ্চলটি পরমাণু শক্তিধর দুই প্রতিবেশী ভারত-পাকিস্তান নিজেদের বলে দাবি করে আসছে।
বিদ্রোহে সর্বশেষ যুক্ত হওয়াদের একজন হলেন ১৯ বছরের কিশোর আদিল আহমেদ ধর। কাশ্মীরের পুলওয়ামায় ভারতের একটি আধাসামরিক বাহিনীর ওপর আত্মঘাতী হামলা চালিয়ে ৪৪ জওয়ানকে হত্যা করেন তিনি।
জইশ-ই-মোহাম্মদ এ হামলার দায় স্বীকার করলেও গত ১৪ ফেব্রুয়ারির এ ঘটনায় পাক-ভারতের মধ্যে এক পশলা আকাশযুদ্ধও হয়ে গেছে। যাতে ভারতীয় যুদ্ধবিমানের এক পাইলট আটক হওয়ার শান্তির নিদর্শন হিসেবে তাকে ফেরত দিয়েছে পাকিস্তান।
ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযোগ, পাকিস্তানের কর্তৃপক্ষ কাশ্মীরের বিদ্রোহীদের আশ্রয়, প্রশিক্ষণ, রসদ ও নির্দেশনা দিচ্ছেন। এসব অভিযোগ অস্বীকার করে পাকিস্তান সম্প্রতি সীমান্তে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ধরপাকড় চালিয়েছে।
তবুও পাকিস্তানের নিন্দা জানিয়ে আসছে ভারত। কিন্তু কাশ্মীরে স্থানীয় বিদ্রোহীদের বাড়বাড়ন্ত নিয়ে একেবারেই নীরব থাকছে দেশটি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা বলেন, গত বছর ১৯১ কাশ্মীরি তরুণ বিদ্রোহে যোগ দিয়েছেন। যেটা আগের বছরের তুলনায় ৫২ শতাংশ বেশি। ২০১৭ সালে ১২৬ তরুণ বিচ্ছিন্নতাবাদে শামিল হয়েছিলেন। কিন্তু ২০১৩ সালে এই সংখ্যা ছিল মাত্র ১৬।
কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি নিয়েছেন ৩১ বছর বয়সী ভাট। পরে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় যোগ দেন। শিক্ষার্থীরা বলছেন, তার নিহত হওয়ার খবর শুনে তারা ভেঙে পড়েছেন। তাদের প্রিয় শিক্ষক শহীদ হয়েছেন বলে তারা ব্যথিত।
২৪ বছর বয়সী মোহাম্মদ রইশ রফিকি বলেন, এটা ব্যক্তিগত পছন্দ। এক্ষেত্রে আপনি কাউকেই বাধা দিতে পারবেন না।
নয়াদিল্লিভিত্তিক ওয়েবসাইট সাউথ এশিয়ান টেররিজম পোর্টালের প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শান্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার ভারতীয় কলরবের পরেও বিদ্রোহের নতুন উচ্চতার দিকে ধাবিত হতে যাচ্ছে কাশ্মীর।
‘মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ উপত্যকাটিতে নিয়ন্ত্রিত শাসন ও অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে কৌশলগুলো এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে।’
সমালোচকরা বলছেন, কাশ্মীরের ক্ষোভ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করায় ভারতবিরোধী ক্ষোভ ও হতাশা বাড়ছে। কাশ্মীরিদের ভাষায়, তারা প্রতিনিয়ত অবমাননার শিকার হচ্ছেন। কখনো হালকা কখনো গুরুতর অমর্যাদাকর ব্যবহার করা হচ্ছে তাদের সঙ্গে।
পাশাপাশি সংঘাতে তাদের নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে। কাজেই রাতারাতি উন্নতির কোনো আলামত দেখা যাচ্ছে না।
২০১৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত জম্মু ও কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন মেহবুবা মুফতি। তিনি বলেন, আমরা কেবল বলতে পারি পাকিস্তান ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করছে।
কাশ্মীরি আত্মঘাতী বালক আদিল ধর দুই দেশকে যুদ্ধের মুখোমুখি করার পর মুফতি বলেন, কাশ্মীরের ওপর নিপীড়ন বন্ধ না হলে আরেকটি বোমার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
১৯৯০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত বিদ্রোহ চরম অবস্থায় গিয়ে পৌঁছেছিল। সেই তুলনায় এখনকার পরিস্থিতি কম গুরুতর।
ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী জানায়, কাশ্মীরে তিন থেকে চারশ বিদ্রোহী সক্রিয়। তাদের অধিকাংশই দক্ষিণ কাশ্মীর থেকে পরিচালিত হচ্ছে। তাদের কিছু স্থানীয়, বাকিরা পাকিস্তান সীমান্ত পার হয়ে এখানে কাজ করেন।
ভারতের এক সেনা কর্মকর্তা বলেন, হতাশা থেকেই স্থানীয় যুবকরা বিদ্রোহে শামিল হচ্ছেন। বন্দুকের সংস্কৃতির তীব্রতা বাড়িয়ে তুলতে বিদ্রোহীরা সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করছেন।
তিনি বলেন, এখন বিশ্বটা ছোট হয়ে গেছে। বিশ্বজুড়ে কিংবা ভারতের অন্যত্র যেসব ঘটনা ঘটেছে, কাশ্মীরের তার প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে। মুসলমানদের মধ্যে এমন ধারণা তৈরি হচ্ছে যে তারা হামলার শিকার।
কাশ্মীরের সবচেয়ে বড় শহর শ্রীনগরে সড়ক ও সেতুতে আধা সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তারা সক্রিয় রয়েছে। তাদের পেছনে তুষার ঢাকা পাহাড়গুলো দৃশ্যমান।
উপত্যকাটির দেয়ালগুলো এখনো ২০১৬ সালে নিহত বিদ্রোহী কমান্ডার বুরহানের নাম বহন করছে। তিনি নিহত হওয়ার পর সেখানে ব্যাপক সহিংস বিদ্রোহ শুরু হয়, যা দমনে প্রাণঘাতী শক্তি ব্যবহার করে ভারত।
নাঈম ফাজিলির তার ছেলে ঈসার কথা স্মরণ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন ঈসা। ২০১৬ সালের বিক্ষোভের সময় এ তরুণ প্রকৌশলীকে হত্যা করে ভারতীয় বাহিনী।
নাঈম বলেন, আপনারা বলছেন, কাশ্মীরিদের সহায়তার জন্য আমাদের ডিগ্রি অর্জন ও জ্ঞান দিয়ে শক্তিশালী হতে হবে। কিন্তু ডিগ্রি আমাদের কী দিতে পারবে?
একটি স্কুলের অধ্যক্ষ নাঈম ফাজিলি তার দুই সন্তানকে কাশ্মীরের সবচেয়ে অভিজাত স্কুলে পড়িয়েছেন। জম্মু শহরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন ঈসা। কিন্তু ২০১৭ সালের তার ফাইনাল পরীক্ষা চলার সময় তিনি নিখোঁজ হয়ে যান।
এরপর পাগলের মতো নিজের সন্তানকে খুঁজতে শুরু করেন নাঈম ফাজিলি। তিনি এক প্রতিবেশীর কাছ থেকে ফোন পান- ‘চাচা, আপনি কী জানেন কীভাবে ফেসবুক ব্যবহার করতে হয়?’ প্রতিবেশী তাকে একটি ফেসবুক পাতায় নিয়ে যান। সেখানে একে-৪৭ রাইফেল হাতে ঈসার একটি ছবি দেখা যায়।
নাঈম ফাজিলির কাছে যা ছিল বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো। পরে নিরাপত্তা বাহিনী জানিয়েছে, ২০১৮ সালের মার্চে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী তার ছেলেকে হত্যা করেছে।
পিএইচডি গবেষক ছিলেন উমায়ের গুল। কাশ্মীরের বিদ্রোহের ইতিহাস নিয়ে কাজ করেন তিনি।
উমায়ের বলেন, সম্প্রতি কাশ্মীরের বিদ্রোহীদের মধ্যে শিক্ষিতদের উপস্থিতিরে সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু সামাজিক মাধ্যমের কল্যাণে এটা আরও নতুন মাত্রা পেয়েছে। বিদ্রোহী সংগ্রহের উপায় হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে এসব মাধ্যম।
১৪ ফেব্রুয়ারিতে পুলওয়ামায় হামলার পর হিমালয় অঞ্চলটিতে কয়েক হাজার সেনা পাঠিয়েছে ভারত। একটি সামাজিক-ধর্মীয় সংগঠনকে অবৈধ ঘোষণা করে তাদের শত শত সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
সুপরিচিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বাড়িতে অভিযান চালাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। রাজ্যটির নির্বাচনও স্থগিত রেখেছে ভারতীয় সরকার।
কাজেই কাশ্মীরের গণতান্ত্রিক সংকট আরও চরম রূপ নিয়েছে। ২০১৮ সালে সেখানকার পার্লামেন্ট বিলুপ্তি ঘোষণা করা হয়েছে।
কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ে মাথায় ওড়না পরা নারী শিক্ষার্থীরা মৃদু পায়ে হেঁটে যাচ্ছেন। দুই পাশে উঁচু পনির গাছের শাখা ছায়া মেলে দিয়েছে। গাছের কাণ্ডে শীতের মলিন রোদ এসে পড়েছে। এমন একটি সুন্দর শুক্রবারে অধ্যাপক রাফি ভাট নিখোঁজ হয়ে যান।
তার শিক্ষার্থীরা তখন তার হদিস জানতেন না। ভাবতেন, তিনি বুঝি হায়দরাবাদে চাকরির সাক্ষাতকার দিতে গেছেন। কিন্তু যখন জানতে পারেন, নিরাপত্তা বাহিনী তাদের প্রাণপ্রিয় শিক্ষককে আটক করেছে, তখন দিনব্যাপী বিক্ষোভ করেন তারা। তার মুক্তি দাবি করে স্লোগান দিতে থাকেন।
রাফি ভাটের ৬৪ বছর বয়সী বাবা আবদুর রহিম একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবী। গত মে মাসে কোনো এক রোববার সকালে তিনি যখন ছেলের ফোন পান, তখন কান্নায় ভেঙে পড়েন।
ফোনে বাবাকে রাফি বলেন, তিনি নিরাপত্তা বাহিনীর বন্দুকযুদ্ধের ফাঁদে পড়েছেন এবং শহীদ হতে যাচ্ছেন। মৃত্যুর পর দেখা হবে জানিয়ে বাবাকে চিন্তা করতে না করেন এই অধ্যাপক।
রাফি ভাটকে যারাই চিনতেন, তারাই মর্মাহত হন। তার বিচ্ছিন্নতাবাদে যোগ দেয়ার খবর শুনে তারা ব্যথিত হলেও অবাক হননি।
কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান পিরজাদা এম আমিন বলেন, এখানে সব সম্ভব। এটা সংঘাতপূর্ণ অঞ্চল। যে কারও ওপর এর প্রভাব পড়তে পারে।
লেখক: জোয়ান্না স্ল্যাটার, ওয়াশিংটন পোস্টের ভারতীয় ব্যুরো প্রধান। এর আগে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের গ্লোব অ্যান্ড মেইলের পররাষ্ট্র প্রতিনিধি ছিলেন।