Logo
Logo
×

আন্তর্জাতিক

শিয়াদের মুলা ঝুলিয়ে লাঠি দেখাচ্ছে সৌদি

Icon

যুগান্তর ডেস্ক

প্রকাশ: ২০ জানুয়ারি ২০১৯, ০১:৫৪ পিএম

শিয়াদের মুলা ঝুলিয়ে লাঠি দেখাচ্ছে সৌদি

ছবি: রয়টার্স

সৌদি আরবের তেল উৎপাদক পশ্চিম উপকূলের একটি শহরের পুরনো কোয়ার্টার আওয়ামিয়া বছরখানেক আগে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। একসময় এটি শিয়া বিক্ষোভের মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল। 

ইরানের সঙ্গে যোগসাজশের অভিযোগে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা অভিযান চালায় সৌদি কর্তৃপক্ষ। তখনই গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছিল এ কোয়ার্টার।

তবে জেলায় গোলকধাঁধার মতো ইটের বাড়ি ও সরু গলিপথগুলো এখন বিপণিবিতান, মিলনায়তন ও প্লাজায় ভরে গেছে। আর এসব সাজানো হয়েছে সুদৃশ্য পামগাছ দিয়ে। পুলিশের বিরুদ্ধে হামলা চালাতে বন্দুকধারীরা এসব গলিপথ ব্যবহার করতেন।

সুন্নি ইসলামের কঠোর বিধিনিষেধের অনুগামী রিয়াদ সরকার শিয়াদের বিপথগামী হিসেবে বিবেচনা করে। কিন্তু এখন সৌদি ভাবছে, কয়েক দশকের উপেক্ষার পর কাতিফের সীমান্ত এলাকায় ব্যাপক বিনিয়োগের মাধ্যমে সহিংসতার অবসান ঘটানো সম্ভব হবে।

সৌদি সিংহাসনের উত্তরসূরি মোহাম্মদ বিন সালমানের রাষ্ট্রীয় নীতির পরীক্ষা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে এসব উদ্যোগকে। এখন সংখ্যালঘু শিয়াদের নিয়ে আপসের সুরে কথা বলছেন যুবরাজ। তিনি এমন একসময় এ সুর নরম করেছেন, যখন মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাব বিস্তার নিয়ে চিরবৈরী ইরানের সঙ্গে দেশটির উত্তেজনা বাড়ছে।

শিয়ারা বহু বছর ধরে বৈষম্যের অভিযোগ করে আসছেন। সৌদি সরকারের বড় বড় পদে তাদের নিয়োগ দেয়া হয় না। যেসব অঞ্চলে শিয়ারা বসবাস করেন, সেখানে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ কমিয়ে দেয়া হয়েছে। এতে তাদের এবাদতের কেন্দ্রগুলো বন্ধ হওয়ার পথে।

ছবি: রয়টার্স

বারবার কাতিফের গণবিক্ষোভ দমন করতে হয়েছে সৌদি নিরাপত্তা বাহিনীকে। ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লবের বছর এ বিদ্রোহ শুরু হয়। একই বছর আওয়ামিয়া কোয়ার্টার গুঁড়িয়ে দেয়া হয়। পরে সেটি গাড়ি পার্কিংয়ের স্থানে পরিণত হয়েছিল।

২০১১ সালে আরব বসন্ত শুরু হলে সৌদি আরবে শিয়াদের বিদ্রোহও বেড়ে যায়। ইরানের সঙ্গে সৌদি আরবের আঞ্চলিক দ্বন্দ্বের ভেতরে ঢুকে যায় কাতিফ ইস্যু। এতে আল মুসাওয়ারা নামে পরিচিত আওয়ামিয়া কোয়ার্টারকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হয়।

পাঁচ একর জমিতে আওয়ামিয়াকে নতুন করে গড়ে তুলতে ছয় কোটি ডলার খরচ করেছে সৌদি সরকার। কয়েকশ বাড়িঘর ধ্বংস করে দেয়ার ক্ষতিপূরণ হিসেবে স্থানীয়দের ২৩ কোটি ডলার দেয়া হয়।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, শপিংমল, সৈকত, মাছের বাজার ও ঐতিহাসিক পুরনো দুর্গ গড়ে তুলতে সেখানে নতুন করে অর্থ ঢালা হচ্ছে।

দেশটিতে সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচি নেয়ায় পশ্চিমা বিশ্বে বেশ তারিফ কুড়িয়েছেন এমবিএস নামে পরিচিত মোহাম্মদ বিন সালমান। এতে তিনি ওহাবি মতাদর্শের বাইরে গিয়ে ইসলামের আরও উদারপন্থা মেনে চলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যা উগ্র ইসলামপন্থা হিসেবে এতদিন বিশ্বব্যাপী সমালোচিত হয়ে আসছে।

তবে যুবরাজ এ সংস্কার কর্মসূচির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিরোধী মতের ওপর ব্যাপক ধরপাকড় ও শুদ্ধি অভিযানও চালাচ্ছেন। এতে দেশটির বহু প্রিন্স ও ধনকুবের দুর্নীতির অভিযোগে ধরা খেয়েছেন।

যুবরাজ যখন সৌদি আরবে সত্যিকার অর্থে একটি বড় পরিবর্তন আনার কথা বলে বেড়াচ্ছেন, তখন ঘটল আরেক বিপত্তি। তুরস্কের ইস্তানবুলে সৌদি কনস্যুলেটে বিয়ের কাগজপত্র আনতে গিয়ে নারকীয় হত্যাকাণ্ডের শিকার হন ওয়াশিংটন পোস্টের সাংবাদিক জামাল খাশোগি। এতে তার পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে নতুন করে সন্দেহ জেগে ওঠে।

ছবি: রয়টার্স

পশ্চিমা বিশ্লেষক ও কূটনীতিকরা বলেন, কয়েক দশকের নিপীড়নের পর গোষ্ঠীগত সম্পর্কের উন্নয়নের যে কোনো চেষ্টা বাস্তবায়নে একটু সময় লাগার কথা। কাজেই শিয়াদের মধ্যেও নতুন প্রকল্পগুলো নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট অ্যান্থনি কলেজের মধ্যপ্রাচ্যের আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক গবেষক টবি ম্যাথিসেন বলেন, যদি সৌদি সরকার খাশোগি ও ব্যবসায়ীদের ধরপাকড়ের ঘটনার মতো নির্মম উপায়ে মানুষের পিছু লাগে, তবে একটু কল্পনা করে দেখুন- সংকট তৈরিকারী শিয়াদের সঙ্গে তারা কী আচরণ করবে?

প্রভাব বিস্তারে আঞ্চলিক বৈরিতা

২০১৫ সালে প্রতিরক্ষামন্ত্রী হওয়ার পর এমবিএস তেহরানের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে যান। ইয়েমেনে ইরানঘেঁষা হুতিদের বিরুদ্ধে বিমান হামলা এবং ইরানের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখায় কাতারের বিরুদ্ধে আকাশ, নৌ ও স্থলপথে অবরোধ আরোপ করেন।

তবে এসব কিছুকে ঘরোয়া অস্থিরতা থেকে দূরে রাখতে চান তিনি। গত বছর একটি আমেরিকান সাময়িকীতে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে যুবরাজ এমনটিই জানান।

তিনি বলেন, ইরান সরকারের মতাদর্শের বিরুদ্ধে রিয়াদের অবস্থান। শিয়া সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে না। কিন্তু সমালোচকরা বলছেন, সরকারের কঠোর হস্তে দমনের কৌশলে কোনো পরিবর্তন আসেনি।

সম্প্রতি কাতিফের এক নারীসহ পাঁচ মানবাধিকার কর্মীকে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি দেয়ার নিন্দা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো।

ছবি: রয়টার্স

হতাশা ও শ্রান্তি

আল মুসাওয়ারার শেষ প্রান্তে একটি সাঁজোয়াযান মোতায়েন করা। যা বর্তমানে নতুন নামকরণ করা হয়েছে ওয়াসাত (কেন্দ্রীয়) আওয়ামিয়া। ভবনগুলোতে এখনও বুলেটের গর্তের চিহ্ন রয়েছে। একসময় সড়কে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ের ঘটনাগুলোই মনে করিয়ে দিচ্ছে এসব।

গত সপ্তাহে গণমাধ্যমকর্মীরা ওই কোয়ার্টারে পরিদর্শনে যান। তার একদিন আগে কাতিফের অন্য অংশে নিরাপত্তা বাহিনীর এক অভিযানে ছয় ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। এতে একটি এলাকায় বিদ্রোহ প্রশমিত হলেও অন্যত্র জেগে ওঠা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।

পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদশের মেয়র ফাহাদ জুবায়ের বলেন, তার আত্মবিশ্বাস, স্থানীয়রা সরকারি পদক্ষেপগুলো ভালোভাবে নেবেন। আমি আশা করছি, সেখানে জাদুকরী পরিবর্তন আসবে। অঞ্চলটি সন্ত্রাসীদের আস্তানা থেকে পরিবর্তন হয়ে সভ্যতার আলো ছড়াবে।

সহিংসতার সব আলামত অচিরেই অদৃশ্য হয়ে যাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

একজন প্রকল্প ব্যবস্থাপক বলেন, ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর নতুন করে হুবহু তৈরি করতে স্থানীয়দের সঙ্গে পরামর্শ করছেন স্থপতিরা। এ অঞ্চলে শতবছরের ভবনগুলো গুঁড়িয়ে দেয়া নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে এসব প্রকল্প নেয়া হয়েছে। কারণ ধ্বংস অভিযানের ভেতর ঐতিহ্যবাহী স্থপনাগুলো খুবই কম সংরক্ষিত হয়েছে।

উপসাগরীয় দেশগুলো গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব নিয়ে গবেষণা করা ম্যাথিসেন বলেন, সরকারের প্রকল্পে স্থানীয়রা অসন্তুষ্ট হলেও তাদের কিছু করার নেই। ভয়াবহ নিপীড়নের মধ্যে তাদের প্রতিরোধ শক্তি হারিয়ে গেছে।

তিনি বলেন, কাজেই এতে সব কিছু ভালো হয়ে যাবে কিংবা শিয়াদের মনোভাবে পরিবর্তন আনতে পারবে বলে বলা যাচ্ছে না। কারণ সেখানে অধিবাসীদের মধ্যে একদিকে হতাশা, অন্যদিকে শ্রান্তি ভর করছে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম