বিশ্ব নারী দিবস আজ
বিজ্ঞান গবেষণায় নারীদের অংশগ্রহণে বাধা কোথায়?

ফাতিমা তুজ জোহরা মনি
প্রকাশ: ০৮ মার্চ ২০২৫, ১১:৩০ এএম

দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী বিজ্ঞানীরা প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। একদল ইচ্ছেমতো বৃষ্টি ঝরায়, অন্য দলটি সৌরশক্তি জমিয়ে রেখে আলো জ্বালায়। এমন রাজ্যের অস্তিত্ব হয়তো বাস্তবে ছিল না; ছিল নারী শিক্ষা ও জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের ‘সুলতানার স্বপ্নে’।
সেই স্বপ্নপূরণের পথে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশের নারী এবং
প্রায় সব কর্মক্ষেত্রেই এখন নারীদের পদচারণা।
তবে এটি দুর্ভাগ্যজনক যে, বর্তমানে নারীরা বিশ্বব্যাপী
মাত্র ১২ শতাংশ বিজ্ঞানী এবং প্রায় ৩০ শতাংশ গবেষকের প্রতিনিধিত্ব করছেন। শুধু আলাদাভাবে
যদি গবেষণায় নারীদের অংশগ্রহণের দিকে নজর দেওয়া যায়, তা
সত্যিই হতাশাময়।
ইউনেস্কোর ‘ইনস্টিটিউট অব স্ট্যাটিসটিকস’-এর তথ্য মতে
বিশ্বে গবেষণায় নারীর অংশগ্রহণ প্রতি তিনজনে মাত্র একজন।
ইউনেস্কোর ২০২১ বিজ্ঞান রিপোর্ট অনুসারে, সার্কভুক্ত দেশসমূহের মধ্যে বাংলাদেশে
গবেষণায় নারীদের অংশগ্রহণ কেবল ১৩.৯৬ শতাংশ ।
পরিসংখ্যানগত তারতম্য যাই থাকুক না কেন এটি প্রমাণিত যে, বাংলাদেশে অন্যান্য
পেশায় নারীদের অংশগ্রহণ সময়ের সঙ্গে যে হারে অগ্রসর হচ্ছে, গবেষণায় তার বিপরীত চিত্র দেখা মেলে। এক্ষেত্রে অবশ্যই মানসিকতা এবং
শিক্ষার পরিবেশের প্রতিবন্ধকতাগুলো মুল বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তবে আজ থেকে এক দশক আগেও
গবেষণায় নারীর অংশগ্রহণ ছিল খুবই যৎসামান্য। যদিও এর পেছনে ছিল কিছু বাস্তব ও প্রাগৈতিহাসিক
প্রেক্ষাপট; বিজ্ঞান শিক্ষার প্রতি নারীদের অনাগ্রহ,
পরিবার ও পেশাজীবনের মাঝে ধ্রুপদি দ্বন্দ্ব এবং কর্মসহায়ক
পরিবেশের অনুপস্থিতি, যা নারীদের গবেষণায় নিরুৎসাহিত করতে
মুখ্য ভূমিকা রেখেছিল।
বর্তমানে আন্তর্জাতিক উদ্যোগ ও সমন্বিত উন্নয়নের ধারণা প্রচলিত হওয়ার কারণে
প্রতিষ্ঠান সমূহে নারী বান্ধব কর্ম পরিবেশ; বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে নারীদের
আগ্রহ তৈরি; সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন; উচ্চতর শিক্ষার বিস্তৃত সুযোগ সৃষ্টি এবং বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের
নারী গবেষকদের সফলতার কারণে গবেষণা সংক্রান্ত পাঠ্যক্রমে তরুণ নারী গবেষকদের স্বতঃস্ফূর্ত
উপস্থিতি সত্যিই প্রেরণাদায়ক ।
খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে, খাদ্য সংরক্ষণে, সংক্রামক
ব্যাধি নিরাময়েও এগিয়ে যাচ্ছেন বর্তমানে বাংলাদেশের নারীরা। গবেষণা এবং
উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও এখন বেশ ভালো করছে বাংলাদেশের নারীরা । কেউ কেউ পেয়েছেন
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও। গবেষণার অপ্রতুল সুযোগ, সম্পদের
সীমাবদ্ধতা, সামাজিক বাধা ঠেলে এরকম অনেক ক্ষেত্রেই
যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন এদেশের কৃতী নারীরা।
এক্ষেত্রে পেশাগত জীবনে কৃষিবিজ্ঞান অধ্যয়নের একজন শিক্ষার্থী
হিসেবে সাম্প্রতিক সময়ে আমার অভিজ্ঞতা সত্যিই আশা জাগানিয়া।
বাংলাদেশে প্রচলিত ধ্যানধারণা প্রায়শই বলে দেয় যে
কিছু কিছু পেশা পুরুষদের জন্য নির্ধারিত, এবং কৃষি তেমন একটি ক্ষেত্র। মূলত কৃষি
আমাদের দেশের ঐতিহ্য ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির শেকড়ে রয়েছে,
তবুও নারীদের জন্য পেশাগত অগ্রগতির পথ এখানে সুগম নয়।
বাস্তবিকপক্ষে সমস্ত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও, বিশ্বের
বিভিন্ন প্রান্ত থেকে জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে এবং বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা
অর্জন করে, আজ আমি একজন গবেষক! আমার
লক্ষ্য, আগামী প্রজন্মের নারীদের কৃষিবিজ্ঞানের পথে
এগিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করা।
ঢাকায় অবস্থিত শের-ই-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে
পড়াশোনার মাধ্যমে আমি মূলত কৃষিবিজ্ঞানে স্নাতক এবং কীটতত্ত্বে স্নাতকোত্তর
সম্পন্ন করি। সুতরাং প্রথম ধাপেই আমি উপলব্ধি
করেছি যে, এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে হলে আমার
জ্ঞানের পরিধি আরও বিস্তৃত করতে হবে।
সে উদ্দেশ্যেই কঠোর অধ্যবসায় এবং নিষ্ঠার মাধ্যমে আমি জার্মানির শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয় টেকনিক্যাল
ইউনিভার্সিটি অফ মিউনিখে ভর্তি হওয়ার গৌরব অর্জন করি, যা
জার্মানিতে প্রথম এবং বিশ্বে ২১তম স্থানপ্রাপ্ত। সেখানে উদ্যানতত্ত্ব বিজ্ঞানে
আমার দ্বিতীয় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের মাধ্যমে এবং বিভিন্ন প্রজেক্টের কাজে গবেষণা
সহকারী হিসেবে নিয়োজিত হয়ে মলিকুলার বায়োলজি এবং এনালাইটিক্যাল কেমিস্ট্রি সম্বন্ধীয়
বিষয়বস্তুর উপর উচ্চতর দক্ষতা লাভ করি।
এই প্রয়োগিক অভিজ্ঞতা আমাকে বুঝতে
শিখিয়েছে যে, উদ্ভিদ-জীববিদ্যার
আণবিক স্তরের জ্ঞান কাজে লাগিয়ে খাদ্য উৎপাদনে উদ্ভাবন ও টেকসইতা অর্জন সম্ভব,
যা আমার বৈজ্ঞানিক গবেষণায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি অফ মিউনিখে অধ্যয়নকালে আমি
ইরাসমাস-প্লাস প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করেছি, যা ইউরোপীয়
প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে একাডেমিক মবিলিটি বৃদ্ধির জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন কর্তৃক
সমর্থিত একটি বৈজ্ঞানিক উদ্যোগ। এই প্রোগ্রাম আমাকে মিউনিখ থেকে উন্নত একাডেমিক ও
গবেষণামূলক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার পাশাপাশি হুমবোল্ট ইউনিভার্সিটি অফ বার্লিন এবং
হাঙ্গেরিয়ান ইউনিভার্সিটি অফ এগ্রিকালচার এন্ড লাইফ সাইন্সেস এর মতো ইউরোপের শীর্ষস্থানীয়
প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নের সুযোগ করে দেয়।
এই অভিজ্ঞতা আমাকে আন্তর্জাতিক একাডেমিক
পরিবেশে কাজ করার বাস্তবসম্মত জ্ঞান অর্জন করতে, আন্তঃবিভাগীয়
বৈজ্ঞানিক সহযোগিতায় সক্রিয়ভাবে যুক্ত হতে এবং পেশাগত নেটওয়ার্ককে
উল্লেখযোগ্যভাবে প্রসারিত করার মাধ্যমে আমাকে গবেষণা উদ্যোগে অবদান রাখতে সুযোগ
দিয়েছে, যার ফলে আমার বৈজ্ঞানিক দক্ষতা এবং বৈশ্বিক
দৃষ্টিভঙ্গি উভয়ই সুদৃঢ় হয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে এই অর্জিত বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও গবেষণা
দক্ষতাই আমাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় কৃষি গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়
ভার্জিনিয়া টেকে পিএইচডি করার পথে নতুন উদ্ভাবনী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করেছে,
যেখানে আমি আমার গবেষণার মাধ্যমে কৃষিবিজ্ঞানে সৃজনশীলতার নতুন
মাত্রা সংযোজন করতে আগ্রহী।
এখানে বর্তমানে আমি ট্রান্সলেশনাল প্ল্যান্ট
সায়েন্সেস-এ পিএইচডি করছি,
যেখানে আমার গবেষণা মূলত ফসলের সংক্রামক উদ্ভিদ-পরজীবী নেমাটোড
সনাক্তকরণ, তাদের বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ, এবং কার্যকর ব্যবস্থাপনার নতুন পথ উদ্ভাবনের দিকে নিবদ্ধ। আমি
বিশেষভাবে নেমাটোডের বিস্তার, তাদের আকার-আকৃতি ও জিনগত
বৈচিত্র্য বিশ্লেষণ করছি এবং কীভাবে প্রতিরোধী ও সংবেদনশীল ফসলের জাতগুলো
প্রাকৃতিকভাবে ফসলের গুণগত মান অক্ষুণ্ণ রেখে এবং গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান যোগ
করে এই পরজীবীর বিরুদ্ধে সেলুলার ও জিন এক্সপ্রেশন স্তরে প্রতিক্রিয়া জানায়,
তা গভীরভাবে অনুসন্ধান করছি।
আমার গবেষণার চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো, ফসলের পরজীবী আক্রমণের
ক্ষতি হ্রাস করে,
রোগ প্রতিরোধী ফসলের উন্নত জাত উদ্ভাবন করা এবং ফসলের
উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা।
এই সম্ভাবনা উদ্ঘাটনের জন্য, আমি
জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্জিত উদ্ভাবনী জ্ঞানকে ব্যবহার
করে বাংলাদেশের কৃষিতে নতুন বিপ্লব ঘটাতে চাই। আমার লক্ষ্য হলো উন্নত ও
পরিবেশ-বান্ধব কৃষি প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে ফসলের বিভিন্ন সমস্যার সৃজনশীল
সমাধান তৈরি করা এবং কৃষি ব্যবস্থায় পরিবেশ-বান্ধব পরিবর্তন ও স্থায়ী উন্নয়ন
আনয়ন করা। সমান্তরালভাবে আমি কৃষকদের আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচয়
করিয়ে দিতে চাই, যাতে তারা বৈজ্ঞানিকভাবে উন্নত ও নতুন কৌশল
শিখে কৃষি খাতে প্রগতিশীল ও স্থায়ী পরিবর্তন আনতে পারে। এর ফলে দেশের
উৎপাদনশীলতায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে, যা কৃষিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটাবে।
আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আমাদের সাফল্য
অর্জনের ক্ষমতা সীমাহীন, বিশেষত বিজ্ঞান ও কৃষিতে। খাদ্য নিরাপত্তা এবং টেকসই কৃষির ভবিষ্যত সেই
সাহসী চিন্তাবিদদের হাতে, যারা প্রচলিত চিন্তাধারার বাইরে
গিয়ে নতুন সৃষ্টির সম্ভাবনায় বিশ্বাসী! এই ভবিষ্যত গঠনে
নারীদের ভূমিকা অপরিসীম, কারণ তারা সৃজনশীলতা এবং
সৃষ্টিশীল চিন্তাশক্তি দিয়ে দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তনের নেতৃত্ব দিতে সক্ষম।
ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শত প্রতিকূলতাকে পেছনে ফেলে প্রগতিশীল
মনোভাবকে সামনে রেখে দুঃসাহসিক উদ্যোগ গ্রহণ করবে এবং আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নতুন
বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেবে।
লেখক: ফাতিমা তুজ জোহরা মনি
পিএইচডি গবেষক
ভার্জিনিয়া টেক ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র