দুর্নীতিমুক্ত এক সম্প্রীতির বাংলাদেশ চায় নাগরিকরা

হাসান আল বান্না
প্রকাশ: ০৩ মার্চ ২০২৫, ১০:০৯ পিএম

একটি সফল গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে বেশ কিছু নতুন আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়। কারণ স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ঠিক যে (সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়ার সঙ্গে তুলনামূলক) পরিমাণ উন্নয়ন হওয়ার কথা ছিল তার ধারে কাছেও আমরা পৌঁছাতে পারিনি।
ফলে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার হঠানোর পর দেশের সব ধর্ম-বর্ণ ও শ্রেণী পেশার মানুষের মধ্যে ভিন্ন এক বাংলাদেশের স্বপ্ন জেগেছে। তারা এমন একটি বাংলাদেশ চায় যেখানে শ্রেণী-বৈষম্য থাকবে না। সন্ত্রাস-দুর্নীতি থাকবে না। রাজনীতিতে পারিবারিক প্রভাবের পরিবর্তে সততা ও যোগ্যতা প্রধান্য পাবে; কিন্তু স্বাধীনতার পাঁচ দশক পার হলেও খুব বেশি পরিচ্ছন্ন রাজনীতিক ও সততার সঙ্গে কর্মসম্পাদন করার মতো আমলা পাওয়া যায়নি। প্রতিবেশী অনেক দেশ আমাদের পরে প্রতিষ্ঠা লাভ করে উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে আমাদের চাইতে অনেক বেশি এগিয়ে রয়েছে। তাহলে আমরা কেন যাথাযথ অগ্রগতি লাভ করতে পারিনি?
কাঙ্ক্ষিত পরিমাণে উন্নতি না হওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। আমাদের সমাজে এখনো সৎলোক আছে ঠিকই কিন্তু তারা রাষ্ট্র পরিচালনার পলিসি মেকার নন, আর যারা রাষ্ট্র পরিচালনায় পলিসি মেকার হিসেবে নিয়োজিত রয়েছে তাদের মধ্যে দেশ প্রেম ও সততার ঘাটতি বহুবারই দৃশ্যমান হয়েছে। উচ্চপদস্থ আমলারা যখন কোনো প্রকল্প নির্ধারণ করেন তখন প্রকৃত ব্যয়ের চাইতে অনেক গুণ বাড়িয়ে মূল্য নির্ধারণ করেন।
এই বাড়তি মূল্য নির্ধারণের লক্ষ্য প্রকল্পের কাজ ভালোভাবে করা নয়, ওই বরাদ্দ থেকে কমিশনা সহ নানা উপায়ে লুটপাট করা। গণহারে সবাই অসৎ তা কিন্তু নয় সৎ অফিসারের সংখ্যাও কম নয়, কিন্তু দুর্নীতিবাজদের সংখ্যা বেশি হওয়ায় সৎ অফিসাররা অনেক ক্ষেত্রে কোণঠাসা হয়ে থাকতে হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার পরিবেশ অনেক ক্ষেত্রেই থাকে না, ছাত্র রাজনীতির নামে এক ধরনের বখাটেরা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সন্ত্রাসের আখড়া বানিয়ে রেখেছিল। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খুন এবং ধর্ষণের মতো ঘটনা অহরহ হয়ে দাঁড়ায়।
রাজনীতিও ফ্যাসিশক্তি প্রয়োগও নতুন কিছু নয়, স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন সময় সেটি লক্ষণীয় ছিল, কিন্তু গত সাড়ে ১৫ বছর এর মাত্রা অসহনীয় পর্যায়ে ছিল। বিরোধী মত মোটেই সহ্য করা হতো না। ফলে সব শ্রেণী-পেশার মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে পরেন। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর মানুষ দুর্নীতি ও সন্ত্রাসমুক্ত একটি বাংলাদেশ চাচ্ছেন। যেখানে সাম্য ও শান্তি বিরাজ করবে। সততা ও নৈতিকতার ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালিত হবে এমন স্বপ্ন দেখছেন সব শ্রেণী-পেশার মানুষ।
দেশে গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্বা দেওয়া ছাত্রনেতারা গত ২৮ ফেব্রুয়ারি নতুন রাজনৈতিক দল ঘোষণা দিয়েছেন। ওই দলটি একটি সম্প্রীতির বাংলাদেশ উপহার দেওয়ার অঙ্গীকারও করেছে। ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’ সংক্ষেপে এনসিপি নামের এই দলটির ওপরও জনগণের অনেক আশা। একইসঙ্গে বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলো যাতে জনআকাঙ্ক্ষা বিবেচনায় নিয়ে দেশ পরিচালনার পরিকল্পনা করেন এটাও নাগরিকদের প্রত্যাশা। কিন্তু মানুষের সেই প্রত্যাশা ঠিক কতোখানি পূরণ হবে সেটি নিয়ে নানা মহলে নানা প্রশ্ন রয়েছে।
নতুন দলটির প্রতিষ্ঠার দিনে বিপুলসংখ্যক মানুষের উপস্থিতি দেখা গেছে ঢাকার মানিক মিয়া এভিনিউতে। দুপুর থেকেই অনুষ্ঠানস্থলে জড়ো হতে থাকেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা। ঢাকার বাইরের জেলাগুলো থেকেও অনেক নেতাকর্মী আসেন। জুলাই-অগাস্ট আন্দোলনে নিহতদের পরিবার এবং আহতরাও সমবেত হন সেখানে। সাধারণত বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সভার মঞ্চে চেয়ার টেবিলের ব্যবস্থা থাকে। তবে নাগরিক পার্টির মঞ্চে সেসব রাখা হয়নি। নেতারা সবাই মঞ্চের মেঝেতেই বসেন। এটিকেও একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে বর্ণনা করেছেন কেউ কেউ।
নতুন রাজনৈতিক দলের সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে তরুণদের অনেককেই বলতে শোনা যায়, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতারা অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়ে শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটানোর মধ্য দিয়েই তাদের রাজনৈতিক যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছেন। ফলে তারা নতুন কিছু করতে পারবেন, এ ব্যাপারে আশ্বস্ত হওয়া যায়। বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদন বলছে, ছাত্রদের দল গঠন নিয়ে বিএনপি বেশ কিছুদিন ধরেই সন্দেহ-সংশয় প্রকাশ করলেও আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে এসে সাংবাদিকদের কাছে নতুন দলটির সাফল্য কামনা করার কথা বলেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
একজন সাবেক ছাত্রনেতা হিসেবে আমি (রিজভী) গৌরববোধ করছি, ছাত্ররা একটি জাতীয় পর্যায়ের সংগঠন করছে, যোগ করেন তিনি। তরুণদের ভাষা ও বোঝাপড়াকে ব্যতিক্রম বলে রুহুল কবির রিজভী উল্লেখ করেন। নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টিকে স্বাগত জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। দলটির সঙ্গে যে কোনো বিষয়ে আলাপ আলোচনার সুযোগ খোলা থাকবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার। অর্থাৎ বড় দুটি রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ নতুন এই দলটি স্বীকৃতি পেয়ে গেছে। এখন কাজ হলো তরুণরা দল গঠনের আগে যা বলেছিলেন এবং দল আত্মপ্রকাশের পর মানুষের স্বপ্ন পূরণ নিয়ে যা বলছেন তা বাস্তবে রূপ দেওয়া। দেশের নাগরিকরা যে যে দলের সমর্থন করেন না কেন, তারা উন্নয়ন-অগ্রগতি ও সম্প্রীতির ক্ষেত্রে শতভাগ এক ও অভিন্ন।
লেখক: হাসান আল বান্না, সাংবাদিক ও কলামিস্ট