
খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান
হাসিনার ফ্যাসিস্ট রেজিম খেদানো 'চব্বিশের ঐতিহাসিক ছাত্রগণঅভ্যুত্থানের নায়ক ছাত্র-তরুণেরা নতুন রাজনীতির লক্ষ্যে যেদিন ঢাকায় নয়া রাজনৈতিক দলের অভ্যুদয় ঘোষণা করছে, ঠিক তার আগের দিনে আওয়ামী শাসনে নির্যাতিত বৃহত্তম রাজননৈতিক দল বিএনপি মহাসমারোহে তাদের জাতীয় নির্বাহী কমিটির একদিনের বর্ধিত সভা করেছে। বিভিন্ন স্তরের কয়েক হাজার নেতা-কর্মীর অংশগ্রহনে অনুষ্ঠিত প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা এ কর্মসূচিকে দলীয় সভা না বলে সমাবেশ বললেই সঠিক হয়। এই কর্মসূচি যেন প্রতিষ্ঠিত ট্রাডিশনাল রাজনীতির তরফ থেকে তারুণ্যখচিত গঠনোন্মুখ দলের প্রতি এ বার্তাই দিয়েছে যে, 'তোমার হলো শুরু, আমার হলো সারা।' রবি ঠাকুরের এই সঙ্গীতের পরের লাইন 'তোমায় আমায় মিলে এমনি বহে ধারা।' এই বাণী আগামীর রাজনীতিতে সত্য হবে কিনা, পুরনো আর নতুন মিলে সমন্বিত অভিন্ন ধারায় বহমান থাকবে কিনা তার নিশ্চয়তা এখনই দেওয়া যাবে না।
এস্তোনীয় ইহুদী বংশোদ্ভূত আমেরিকান স্থপতি লুই ইসাডোর কানের স্থাপত্য নক্সায় পাকিস্তানে ফিল্ডমার্শাল আইউব খানের স্বৈরশাসনামলে ঢাকায় যে বিশ্ববিশ্রুত ইমারত নির্মিত হয়েছিল সেই সংসদ ভবন এখন বাংলাদেশে গণতন্ত্রের মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠেছে। একদিনের ব্যবধানে বিএনপির দলীয় সমাবেশ ও জাতীয় নাগরিক পার্টি নামের নয়া দলের অভ্যুদয় কর্মসূচির আয়োজন হয়েছে সেই অট্টালিকা ঘিরেই। এর মাধ্যমে দুই পক্ষই সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতি তাদের অঙ্গীকারের প্রমাণ দিতে চেয়েছে বলেই মনে হয়।
দীর্ঘ সাত বছর পর ফ্যাসিবাদমুক্ত পরিবেশে বিএনপির এবারের বর্ধিত সভাকে খুব সূক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে আমার কাছে শীর্ষ নেতৃত্বের ট্রাঞ্জিশন বা পালাবদলের উপলক্ষ বলেই মনে হয়েছে। প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমানের শাহাদাত বরণের পর বিচারপতি আব্দুস সাত্তার স্বল্পকালের জন্য এ দলের নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তার পক্ষে ভাঙন রোধ করে দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখা সম্ভব হয়নি। পরে হাল ধরেন বেগম খালেদা জিয়া। তিনি শুধু দলকে টিকিয়েই রাখেননি, আন্দোলন করে স্বৈরাচার তাড়িয়ে বিএনপিকে ক্ষমতায় এনেছেন। বহু চড়াই উৎরাই পেরিয়ে বিএনপিকে অপ্রতিরোধ্য রাজনৈতিক শক্তিতে উন্নীত করার প্রধান রূপকার আসলে বেগম জিয়াই। প্রবল জনমোহিনী শক্তির উৎস সেই নেত্রী আজ সময়ের প্রতিকূলতা, অসুস্থতা ও অন্যান্য বাস্তবতায় স্থবির। এখনো তিনি দেশপ্রেমিক, জাতীয়তাবাদী, গণতান্ত্রিক শক্তির প্রতীক ও প্রেরণা হলেও তার পক্ষে দল ও সরকারের নেতৃত্ব দেওয়া দৈহিক বাস্তবতার কারণেই প্রায় অসম্ভব। তাই অনিবার্যভাবেই নেতৃত্বের পালাবদল হয়ে উঠেছে অবশ্যম্ভাবী।
বিএনপির এবারের বর্ধিত সভায় অনানুষ্ঠানিকভাবে সবার কাছে সেই বার্তাই পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। বেগম জিয়া তার বন্দিত্ব ও অসুস্থতাকালে ছেলে তারেক রহমান ক্রান্তিকালে যেভাবে নেতৃত্ব দিয়ে দলকে অগ্রসর করেছেন সেই সাফল্যের প্রশংসা করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি এতোকাল শহীদ জিয়ার আদর্শের যে পতাকা তিনি নিজে বয়ে নিয়ে এসেছেন তা তাদের পুত্রের হাতে অর্পণের ব্যাপারে দলকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করেছেন বলেই আমার মনে হয়েছে। জিয়া, সাত্তার, খালেদা পর্ব পেরিয়ে বিএনপিতে এখন প্রকৃতই তারেক পর্বের সূত্রপাত হলো।
এই বর্ধিত সভায় ভার্চুয়াল মাধ্যমে যুক্ত হয়ে বেগম খালেদা জিয়া ভাষণ দেন। এর সাত বছর আগে অনুষ্ঠিত বর্ধিত সভায় ভাষণ দেওয়ার পরপরই হাসিনা রেজিম তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করেছিল। হাসিনা পতনের দু'দিন পর নয়াপল্টনে বিএনপি আয়োজিত সমাবেশে বেগম জিয়ার একটি ভিডিও বার্তা প্রচার করা হয়। তখন তিনি গুরুতর অসুস্থ। এরপর এই প্রথম তিনি ভার্চুয়াল নেটওয়ার্কে যুক্ত হয়ে দলীয় সমাবেশে বক্তব্য রাখলেন। তার ভাষণ ছিল সংক্ষিপ্ত, মার্জিত ও দিকনির্দেশনামূলক। তিনি ক্ষুদ্র সংকীর্ণতা ভুলে দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে কাজ করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, প্রতিহিংসা-প্রতিশোধ নয়, পারস্পরিক ভালোবাসা ও ভ্রাতৃত্বের মাধ্যমে আমরা সবাই মিলে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে সত্যিকার অর্থে একটি বাসযোগ্য উন্নত ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করি। তিনি বলেন, এখনো ফ্যাসিস্টদের দোসররা এবং বাংলাদেশের শত্রুরা গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রাপ্ত অর্জনকে নস্যাৎ করার জন্য গভীর চক্রান্তে লিপ্ত রয়েছে। ইস্পাত কঠিন ঐক্যের মাধ্যমে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এই চক্রান্তকে ব্যর্থ করে দিতে হবে। বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ বিশেষ করে তরুণসমাজ আজ এক ইতিবাচক গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। আপনাদের এবং ছাত্রদের সমন্বিত আন্দোলনের ফলে ফ্যাসিস্ট শাসকরা বিদায় নিয়েছে। একটা অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাদের কাছে জনগণের প্রত্যাশা- রাষ্ট্র মেরামতের ন্যূনতম সংস্কার দ্রুত সম্পন্ন করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার জন্য সবার কাছে একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্পন্ন করা।
বেগম জিয়া তার ভাষণে নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, আমার অবর্তমানে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সিনিয়র নেতৃবৃন্দ এবং আপনাদের সবাইকে নিয়ে নিরন্তর কাজ করে দলকে সুসংহত করেছেন। আমি বিশ্বাস করি, আপনারা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে আগামী নির্বাচনের জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবেন। এমন কোনো কাজ করবেন না যাতে আপনাদের এত দিনকার সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ বিফলে যায়। আমাদের সবসময় শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সেই উক্তি মনে রাখা দরকার- ‘ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ’।
বেগম জিয়ার এই আহ্বান দল কতোটা অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় হিসেবে বাস্তবে প্রয়োগ করতে পারবে তা' আগামী দিনে প্রমাণিত হবে। এখন দল যে-সব কার্যক্রম ও সিদ্ধান্তকে প্রাধান্য দিচ্ছে তাতে দেশের স্বার্থকে দলের স্বার্থের ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়া হচ্ছে কিনা তার গ্যারান্টিও এখনই দেওয়া সম্ভব নয়। দলের বর্ধিত সভায় সব চেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ঐক্যবদ্ধভাবে এর সার্বিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করার নির্দেশনাই এসেছে নেতৃত্বের পর্যায় থেকে। হাইব্রিড ও সুযোগসন্ধানীদের হটিয়ে দিয়ে ত্যাগীদের দলে গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান ছিল লক্ষ্যণীয়। আগামী নির্বাচনে গ্রহণযোগ্যদের মনোনয়ন দেওয়ার জন্যও অনেকে তারেক রহমানের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
সবার বক্তব্য থেকে একটা সত্যই উদ্ভাসিত হয়েছে যে- বিএনপি তার সাংগঠনিক প্রক্রিয়ার পুরনো ধারা থেকে বেরোবার কোনো সিদ্ধান্ত এখনো নেয়নি। অনেক দিন ধরেই পদবাণিজ্য ও মনোনয়ন বাণিজ্যের এন্তার অভিযোগ সত্ত্বেও তৃণমূল পর্যায়ের মতামতের প্রতিফলন ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক পন্থায় নেতৃত্ব নির্বাচন ও মনোনয়ন নির্ধারণের কোনো দাবি কেউ এ বর্ধিত সভায় তোলেনি। বরং ত্যাগীদের মূল্যায়ন ও সঠিক প্রার্থীকে মনোনয়ন দেওয়ার জন্য শীর্ষ নেতৃত্বের প্রতি আবেদনই ছিল সভার মূল সুর। সব মিলিয়ে এই বর্ধিত সভা বিএনপির রাজনীতি ও সাংগঠনিক কার্যক্রমের পুরনো ধারার প্রতি আনুগত্যেরই প্রমাণ দিয়েছে। শীর্ষ নেতৃত্বের পালাবদল ঘটলেও দলের রাজনীতি এবং সাংগঠনিক কাঠামো ও কার্যক্রমে কোনো রকমফের ঘটবে কিনা তার আভাস এ সভায় মেলেনি।
লেখক পরিচিতি : মারুফ কামাল খান : সিনিয়র সাংবাদিক ও লেখক
ই-মেইল : mrfshl@gmail.com