শতফুল ফুটতে দাও
অবনতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক অনৈক্য

ছবি: সংগৃহীত
একটি পত্রিকার শিরোনাম-‘অপরাধীরা বেপরোয়া, আতঙ্কে মানুষ’। এ প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, দেশে বেপরোয়া হয়ে উঠছে অপরাধীরা। তারা মানুষকে জিম্মি করে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে অথবা ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে সর্বস্ব লুটে নিচ্ছে। এতে মানুষের মধ্যে তৈরি হয়েছে নিরাপত্তাহীনতাবোধ ও আতঙ্ক। সর্বশেষ রোববার রাতে রাজধানীর বনশ্রীতে বাসায় ফেরার সময় এক স্বর্ণ ব্যবসায়ীকে গুলি ও কুপিয়ে জখম করে স্বর্ণালংকার ছিনিয়ে নেওয়া হয়। এ ঘটনার ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। এতে আতঙ্ক তৈরি হয়।
শুধু বনশ্রীর ঘটনা নয়, বিগত কয়েক মাসে একের পর এক অপরাধের ঘটনা সামনে এসেছে। পুলিশের পরিসংখ্যান বলছে, সাম্প্রতিককালে ডাকাতি ও দস্যুতার (ছিনতাই) ঘটনায় মামলা বেড়েছে। জানুয়ারিতে দেশে ডাকাতি ও দস্যুতার ঘটনায় মামলা হয়েছে ২৪২টি, যা গত বছরের একই মাসের তুলনায় ৯৯টি বেশি (৬৯ শতাংশ)। ডাকাতি ও দস্যুতার ঘটনায় ডিসেম্বরে মামলা হয়েছে ২৩০টি, যা গত বছরের একই মাসের তুলনায় ৯৫টি (৭০ শতাংশ) বেশি। সব মিলিয়ে আগস্ট থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত ৬ মাসে ডাকাতি ও দস্যুতার ঘটনায় মামলা হয়েছে ১ হাজার ১৪৫টি, যা ২০২৩ সালের আগস্ট থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ের তুলনায় ৩৮২টি বেশি (৫০ শতাংশ)।
ন্যায়শাস্ত্র, রাজনৈতিক দর্শন, সামাজিক চুক্তি তত্ত্ব, ধর্ম এবং আন্তর্জাতিক আইনে স্টেইট অব ন্যাচার বলে একটি ধারণা ব্যবহৃত হয়। এ স্টেইট অব ন্যাচার হলো এমন একটি অবস্থা, যা সমাজ ও সভ্যতার অভ্যুদয়ের আগে বিরাজ করত। যেসব দার্শনিক স্টেইট অফ ন্যাচারের কথা বলেছেন, তাদের মতে সমাজ গঠিত হওয়ার আগে রাষ্ট্রহীন, আইনহীন একটা অবস্থা ছিল। প্রশ্ন ওঠে, নাগরিক সমাজের উদ্ভবের আগে মানুষের জীবন কেমন ছিল। প্রশ্ন ওঠে কীভাবে এ রকম আদিম অবস্থার মধ্যে সরকারব্যবস্থার সূচনা হলো। আরও প্রশ্ন, মানুষ কেন রাষ্ট্রের সমাজে প্রবেশ করল? এ রাষ্ট্রের সমাজে প্রবেশ করতে গিয়ে কী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে জাতিরাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটল?
স্টেইট অব ন্যাচারে সামাজিক শৃঙ্খলা বলতে কিছু ছিল না। মানুষ হানাহানি, মারামারি ও নানাবিধ সংঘাতে লিপ্ত ছিল। জীবন ছিল অত্যন্ত নিষ্ঠুরতাপূর্ণ। এমন পরিস্থিতিতে স্বাধীনতা ছিল, কিন্তু অধিকার ছিল না। স্বাধীনতা এ অর্থে যে, যে যা চাইত তাই করত, অর্থাৎ যথেচ্ছাচার। অধিকারের নিশ্চয়তা থাকলে অন্যের যথেচ্ছাচার থেকে রক্ষা পাওয়ার নিশ্চয়তা থাকে। অধিকার বলে দেয় মানুষের আচরণের সীমা রেখাগুলো কী হবে। হানাহানি, মারামারি, একে অপরের ওপর আক্রমণ করা থেকে সভ্য আচরণে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য মানুষ নিজেদের মধ্যে একটি সামাজিক চুক্তিতে উপনীত হয়। এ চুক্তি অনুযায়ী মানুষ রাষ্ট্র গঠন করে এবং রাষ্ট্রের কাছে তার স্বাধীনতা সমর্পণ করে, বিনিময়ে রাষ্ট্র তার অধিকার ভোগ করার নিশ্চয়তা সৃষ্টি করে। আইন, আচার ও ঐতিহ্যের শক্তিতে মানুষ যে স্বাভাবিক অধিকার ভোগ করত, তার ওপর একটি বাধা-নিষেধ আরোপ করা হয়। এক কথায় আমরা বলতে পারি, একটি সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র গঠিত হয় এবং রাষ্ট্রের কাজ হলো তার নাগরিকদের অন্যায়, আক্রমণ, হত্যা, দৈহিক জখম থেকে রক্ষা করা। রাষ্ট্রের আরও একটি দায়িত্ব হলো ব্যক্তির মালিকানার অধিকার রক্ষা করা, যাতে ন্যায্যভাবে অর্জিত ধন-সম্পদ অন্যের জবর দখলে কিংবা অধিকারে চলে না যায়।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে আইনশৃঙ্খলায় যে অবনতি ঘটেছে, তার পেছনে মূল কারণ হলো রাষ্ট্রশক্তির দুর্বলতা। রাষ্ট্র বলপ্রয়োগ করে সামাজিক বিশৃঙ্খলা দমন করে। রাষ্ট্র বলপ্রয়োগ করে বলেই খুন খারাবি, দাঙ্গা-হাঙ্গমা, জোর-দবরদস্তি, দখলবাজি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকে। রাষ্ট্র যে বলপ্রয়োগ করে, তা জনপ্রতিনিধি প্রণীত আইনের শক্তিতেই করে। রাষ্ট্রের বলপ্রয়োগের হাতিয়ারগুলো হলো সামরিক বাহিনী, পুলিশ বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা, আদালত ও কারাগার। রাষ্ট্রের কর্তৃত্বে যিনি থাকেন, তিনি যদি বলপ্রয়োগের এ হাতিয়ারগুলোকে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করেন, তাহলে তিনি স্বৈরাচারী, একনায়কত্ববাদী, এমনকি ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠতে পারেন। রাষ্ট্রের এ লাগামহীন বলপ্রয়োগ আমরা লক্ষ করেছি শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে। তার বাবাও একই পদ্ধতিতে শেষ পর্যন্ত একটি টোটালেটেরিয়ান রাজনৈতিক ব্যবস্থার গোড়াপত্তন করেছিলেন। তবে তিনি টিকে থাকতে পারেননি। তার শাসনের সাড়ে তিন বছরের মাথায় তাকে দুই কন্যা ব্যতিরেকে সপরিবারে মর্মান্তিকভাবে নিহত হতে হয়েছিল। রাষ্ট্র যখন বাড়াবাড়ি রকমের আচরণ করে, তখন সেই আচরণ রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর হয়ে ওঠে। ২০২৪-এর জুলাই গণ-অভ্যুত্থান হয়েছিল শেখ হাসিনার মতো একজন কর্তৃত্বপরায়ণ শাসকের রাষ্ট্রযন্ত্রকে সীমাহীন দমনপীড়নের কাজে ব্যবহার করার ফলে। যে রাষ্ট্রযন্ত্রটিকে মনে হয়েছিল দুর্ভেদ্য কিংবা অভেদ্য, সেই রাষ্ট্রযন্ত্র এক মাসেরও কিছু বেশি সময়ের অভ্যুত্থানে ধসে পড়ল। এ ধসে পড়ার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের বলপ্রয়োগের অন্যতম হাতিয়ার পুলিশ বাহিনী অন্তত তিন দিনের জন্য লাপাত্তা হয়ে গেল। ধীরে ধীরে এ বাহিনীর দুই লাখ সদস্য কাজে ফিরল বটে, কিন্তু তারা হয়ে পড়ল মনোবলহীন, সাহসহীন একটি বাহিনী। এ বাহিনীর অনেকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, অনেকে গ্রেফতার হয়েছেন এবং অনেকে চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়েছেন। অনেকে যারা চাকরিতে এখনো আছেন, তারা ভয়ভীতির মধ্যে রয়েছেন কখন মামলা-মোকদ্দমার কবলে পড়তে হয়।
এই পুলিশ বাহিনী আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে অনেকটাই অকার্যকর হয়ে পড়েছে। এ বাহিনীটির অনেক সদস্য শেখ হাসিনার আমলে শেখ হাসিনার সরকারকে নিরাপত্তা দেওয়ার নামে এতই বাড়াবাড়ি করেছিল যে, তাদের আচরণ আন্তর্জাতিক অঙ্গনের মানবাধিকারের চূড়ান্ত লঙ্ঘন হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। সাধারণভাবে পুলিশ সম্পর্কে জনগণের অভিযোগের অন্ত নেই। পুলিশের অনেক সদস্য ঘুস, দুর্নীতি, লুণ্ঠন ও তস্করবৃত্তিতে লিপ্ত হয়। এতদসত্ত্বেও পুলিশ বাহিনী তার অস্তিত্বের যৌক্তিকতা বজায় রাখতে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে এমন মাত্রায় ব্যবস্থা নেয়, যাতে করে সমাজে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি চরমভাবে অসহনীয় হয়ে না দাঁড়ায়। পুলিশের ঘুস, দুর্নীতি চলতে থাকে, পুলিশ অপরাধপ্রবণতার রাশ টেনে ধরে একটি মাত্রা পর্যন্ত, আর এভাবেই পুলিশের দুর্নীতি ও অপরাধের মাত্রার মধ্যে একটি ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়। নাগরিকরা অপরাধের মাত্রা নিয়ে এ অবস্থায় খুব একটা অভিযোগ করে না। তারা মনে করে, যেটুকু অপরাধের ঘটনা ঘটছে তা স্বাভাবিক মাত্রায় রয়েছে, শতভাগ অপরাধহীন সমাজের কথা ভাবা যায় না।
জুলাই অভ্যুত্থানের পর আইনশৃঙ্খলায় যে অবনতি হয়েছে, তার জন্য পুলিশ বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা কিংবা পালকে পানি না লাগানোর প্রবণতার কারণে হয়েছে। এ ছাড়া পুলিশ অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে বলপ্রয়োগ না করার এক ধরনের সাবধানতা অবলম্বন করছে। এমন পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলার যতটুকু অবনতি ঘটেছে, তা নাগরিকদের জন্য শঙ্কার কারণ হলেও বিদ্যমান পরিস্থিতিতে অপ্রত্যাশিত নয়। একদিকে পতিত ফ্যাসিস্টের দোসররা পরিস্থিতি ঘোলাটে করে তুলছে, অন্যদিকে ফ্যাসিবাদের কবল থেকে মুক্তি পাওয়া একশ্রেণির রাজনৈতিক কর্মী যথেচ্ছাচারকে ন্যায্য মনে করছে। সবকিছু মিলিয়ে পরিস্থিতি খারাপের দিকে গিয়েছে।
সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান শহিদ সেনা দিবসের এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘দেশে বর্তমানে যে কাদা ছোড়াছুড়ি এবং অন্যকে দোষারোপ করার যে সংস্কৃতির উদ্ভব ঘটেছে, তার ফলে অপরাধীদের বাড় বেড়েছে। আমাদের বিশ্লেষণ মোতাবেক, রাষ্ট্রযন্ত্রের দুর্বলতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সেনাপ্রধান কর্তৃক চিহ্নিত কাদা ছোড়াছুড়ির ঘটনাবলি। ৫ আগস্টে আমরা যে অভূতপূর্ব রাজনৈতিক ঐক্য দেখেছিলাম এবং এ ঐক্যের ফলে আমরা বলীয়ান হয়ে উঠেছিলাম, সেই ঐক্য বর্তমানে অনেকটাই শিথিল হয়ে পড়েছে। কিন্তু সহনশীলতা থাকলে এবং একে অপরের রাজনৈতিক অবস্থানগুলো বোঝার চেষ্টা করলে এভাবে অনৈক্যের সুর বেজে উঠত না। শেখ হাসিনা দেশ থেকে বিতাড়িত হলেও তার বিশাল দলের লোকজনের সিংহভাগ দেশেই রয়ে গেছে। এদের কেউ কেউ অন্য দলের ঝাণ্ডার নিচে আশ্রয় গ্রহণ করলেও বেশিরভাগ অনুতাপহীন আওয়ামী লীগারই রয়ে গেছে, শেখ হাসিনার নিজেরও কোনো সামান্যতম অনুতাপ নেই। তিনি নানা মাধ্যমে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য একের পর এক উসকানি দিয়ে চলেছেন। শেখ হাসিনার উসকানি শতভাগ নিষ্ফল এমনটি বলা যাবে না। বাংলাদেশের ভেতরে এখন দৈনন্দিন যেসব ক্ষোভ ও বিক্ষোভের ঘটনা ঘটছে তার পেছনে পতিত ফ্যাসিস্টদের ইন্ধন নেই এমনটি বলা যাবে না। বরং অনেক ঘটনাতেই আওয়ামী দোসরদের ইন্ধন রয়েছে বলে সন্দেহের উদ্রেক হয়েছে। শেখ হাসিনা নাকি ভারতে চলে যাওয়ার সময় তখনকার পুলিশপ্রধানকে বলেছিলেন, দেশে এমন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি করবেন, যাতে দেশ মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। অনেকেই জানেন শেখ হাসিনার রাজনৈতিক মিশন হলো অকৃতজ্ঞ বাংলাদেশবাসীর ওপর প্রতিশোধ গ্রহণ। বিবিসিখ্যাত প্রয়াত সাংবাদিক সিরাজুর রহমানকে এক সাক্ষাৎকারে তিনি এমন কথাই বলেছিলেন। এমন একজন ব্যক্তির মিত্র রাষ্ট্রটি হলো আধিপত্যবাদী ভারত। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর বলেছেন, বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে কী সম্পর্ক গড়তে চায়, তা বাংলাদেশকেই নির্ধারণ করতে হবে। সোজা কথায়, এই উক্তির অর্থ হলো ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক বৈরী হওয়ার জন্য ভারত দায়ী নয়, আসল দায়ী বাংলাদেশ। কে না জানে ক্ষুদ্র প্রতিবেশী বাংলাদেশের ওপর ভারত যেভাবে দাদাগিরি ফলায় এবং বাংলাদেশকে তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে চলছে, তাতে দায়টা ভারতেরই হওয়া উচিত। জাতির এ দুর্যোগময় অবস্থায় উচ্চস্বরে কাদা ছোড়াছুড়ি করে রাজনৈতিক দলগুলো মোটেও ভালো করছে না। দেশের এ নাজুক পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর এ আচরণ দায়িত্বশীল নয়। রাজনৈতিক দলগুলো যদি দায়িত্বশীল আচরণ না করে, তাহলে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়বে। অথচ শুধু রাজনৈতিক দলগুলোই পারে তাদের ঐক্য ও সংহতির মাধ্যমে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করে গণতন্ত্রের সুমহান পথে অগ্রসর হতে।
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ