প্রতীকী ছবি
সন্তানের মনোজগৎ খুবই সূক্ষ্ম এবং জটিল। তার ছোট্ট হৃদয়ে নানা রঙের স্বপ্ন ভাসে, নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খায়। কিন্তু আমরা কি কখনও থেমে গিয়ে ভেবেছি, সন্তান আসলে কী চায়? সে কার সঙ্গে মিশতে চায়, কী দেখতে চায়, কী শুনতে চায়, কী পড়তে চায়? আমরা হয়তো তাকে স্কুলে পাঠাই, কোচিংয়ে ভর্তি করাই, বাড়িতে পড়াশোনার জন্য চাপ দেই। কিন্তু তার মনের কথা শোনার সময় কোথায়? আমরা কি কখনও তাকে জিজ্ঞাসা করেছি, 'তুমি কী চাও?' নাকি সবসময়ই আমরা নিজেদের ইচ্ছা, নিজেদের স্বপ্ন তার ওপর চাপিয়ে দিচ্ছি?
সন্তানকে নিয়ে হয়তো আমরা ঘুরতে যাই। কিন্তু সেখানে আমরা কি তার পছন্দের জায়গায় যাই, নাকি আমাদের পছন্দের জায়গায়? আমরা কি কখনও তাকে জিজ্ঞাসা করেছি, 'তোমার কোথায় যেতে ইচ্ছে করছে?' নাকি সবসময়ই আমরা নিজেদের পছন্দকে তার ওপর চাপিয়ে দিচ্ছি? সন্তানের ভালো লাগা, মন্দ লাগা, ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে উপেক্ষা করেই কি আমরা তাকে বড় করে তুলছি?
আমরা চাইলেও সন্তানকে ২৪ ঘণ্টা চোখের সামনে রাখতে পারব না। তাকে সবসময় নিজেদের ছায়ায় লুকিয়ে রাখারও কোনো উপায় নেই। সন্তান বড় হবে, নিজের পথ খুঁজবে, নিজের মতো করে জীবনকে বুঝবে। কিন্তু আমরা কি তাকে সেই স্বাধীনতা দিচ্ছি? নাকি সবসময়ই তাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছি? সন্তানের ভালো বা মন্দ হওয়ার পেছনে তার বেড়ে ওঠার পরিবেশ, তার চারপাশের মানুষ, সমাজ এবং সংস্কৃতি—সবকিছুই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কিন্তু আমরা কি সেই পরিবেশ তৈরি করতে পারছি, যেখানে সে নিজেকে নিরাপদ এবং স্বাধীন মনে করবে?
আজকের এই যুগে সন্তান লালন-পালন শুধু একটি দায়িত্ব নয়, এটি একটি যুদ্ধ। আমরা এমন এক সময়ে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে সেরা প্যারেন্টিং করেও সেরা সন্তান পাওয়ার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু কেন? কারণ, আমরা সন্তানকে শুধু বইয়ের জ্ঞান দিচ্ছি, কিন্তু জীবনবোধ দিচ্ছি না। আমরা তাকে শেখাচ্ছি কীভাবে ভালো রেজাল্ট করতে হয়, কিন্তু শেখাচ্ছি না কীভাবে ভালো মানুষ হতে হয়। আমরা তাকে শেখাচ্ছি কীভাবে প্রতিযোগিতায় জিততে হয়, কিন্তু শেখাচ্ছি না কীভাবে হেরে গেলে আবার উঠে দাঁড়াতে হয়।
আমরা সন্তানের একমাত্র শিক্ষক নই। তারা শেখে তাদের বন্ধুদের কাছ থেকে, বই থেকে, সিনেমা থেকে, সোশ্যাল মিডিয়া থেকে। তারা শেখে সমাজ থেকে, সংস্কৃতি থেকে। কিন্তু আমরা কি কখনও ভেবেছি, তারা কী শিখছে? আমরা কি তাদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করি? আমরা কি তাদের বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছি? নাকি সবসময়ই আমরা তাদের ওপর শাসন চালিয়ে যাচ্ছি?
শৈশব থেকে কৈশোর, কৈশোর থেকে যৌবন—সন্তানের বেড়ে ওঠার প্রতিটি ধাপে পরিবারই তার প্রথম এবং প্রধান আশ্রয়স্থল। কিন্তু আজকের দিনে অনেক সন্তানই বলে, 'বাসা ভালো লাগে না।' এই কথার পেছনে লুকিয়ে থাকে অনেক না বলা কষ্ট, অনেক অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা এবং অনেক অব্যক্ত আবেগ। কিন্তু আমরা কি কখনও গভীরভাবে ভেবেছি, কেন সন্তানের বাসা ভালো লাগে না? কেন সে বাড়িতে থাকতে চায় না? কেন তার চোখে বাড়ি শুধুই চার দেয়ালের একটি স্থান হয়ে দাঁড়ায়?
সন্তানের বাসা ভালো লাগে না, কারণ বাড়িতে সে নিজেকে নিরাপদ মনে করে না। বাড়িতে সে নিজেকে স্বাধীন মনে করে না। বাড়িতে সে নিজেকে বুঝতে পারে না। বাড়িতে সে শুধুই নিয়ম, শাসন এবং চাপের মধ্যে থাকে। কিন্তু বাড়ি তো শুধু চার দেয়ালের একটি স্থান নয়। বাড়ি হলো সেই জায়গা, যেখানে সন্তান নিজেকে সবচেয়ে বেশি নিরাপদ এবং প্রিয় মনে করবে। বাড়ি হলো সেই জায়গা, যেখানে সে তার সব কষ্ট, সব আনন্দ ভাগ করে নিতে পারবে। বাড়ি হলো সেই জায়গা, যেখানে সে নিজেকে খুঁজে পাবে।
সন্তানের বাসা ভালো লাগে না—এই কথার পেছনে লুকিয়ে থাকে অনেক না বলা কষ্ট। কিন্তু আমরা যদি চাই, তাহলে বাড়িকে সন্তানের জন্য একটি নিরাপদ এবং প্রিয় স্থানে পরিণত করতে পারি। সন্তানের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করুন। তার ইচ্ছা, তার স্বপ্ন, তার ভয়—সবকিছুকে গুরুত্ব দিন। তাকে শুধু বইয়ের জ্ঞান নয়, জীবনবোধ দিন। তাকে শুধু প্রতিযোগিতায় জিততে শেখান না, হেরে গেলে আবার উঠে দাঁড়াতে শেখান। বাড়িকে সন্তানের জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয়ে পরিণত করুন, যেখানে সে নিজেকে সবচেয়ে বেশি প্রিয় এবং নিরাপদ মনে করবে। কারণ, বাড়ি শুধু চার দেয়ালের একটি স্থান নয়, বাড়ি হলো সন্তানের প্রথম এবং প্রধান আশ্রয়স্থল।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী