Logo
Logo
×

দৃষ্টিপাত

ধনকুবেরের ক্ষমতার দাপট ও ক্ষুধিত চোখ

মারুফ কামাল খান

মারুফ কামাল খান

প্রকাশ: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৬:০৮ পিএম

ধনকুবেরের ক্ষমতার দাপট ও ক্ষুধিত চোখ

সাবের হোসেন চৌধুরী। ফাইল ছবি

তখন জেনারেল এরশাদের জামানা। আমি কাজ করি অধুনালুপ্ত দৈনিক দেশ পত্রিকায়। আমাদের তরুণ সহকর্মী মোস্তফা ফিরোজ দীপু একদিন আমাকে বললেন, 'আবাহনী' নামে একটা খেলার কাগজ বেরুচ্ছে। দীপু ওটা চালাবার দায়িত্ব নিচ্ছেন। ফাইন্যান্স করবেন তরুণ ব্যবসায়ী সাবের হোসেন চৌধুরী। খুব ভদ্রলোক। অমায়িক ব্যবহার। ভেরি গুড পে-মাস্টার তিনি। আবাহনী স্পোর্টিং ক্লাবের মুখপত্র হিসেবে বেরুবে পত্রিকাটি। দীপু ওই কাগজে আমাকে লিখবার আমন্ত্রণ জানালেন। 

খেলা নিয়ে আমি কখনো লিখিনি। ওই বিষয়ে আমার আগ্রহও খুব বেশি নেই। তাই আবাহনীতে আর লেখা হয়ে ওঠেনি আমার। তবে দীপুর কাছ থেকে সাবের চৌধুরীর যে বিবরণ প্রথম শুনেছিলাম, সেটা বোধহয় নিজের অজান্তেই আমার মনে ছাপ ফেলেছিল। তাই কখনো তার সঙ্গে মেলামেশা না হলেও সাবের চৌধুরীকে আমি ভালো মানুষ ভাবতাম। তার একটা ভালো ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছিল আমার ভেতরে।

পরে সাবের রাজনীতিতে জড়ালেন। আওয়ামী লীগে যোগ দিলেন। এমপি ও উপমন্ত্রী হলেন। ক্রীড়াঙ্গনে সরকারের অন্যতম নিয়ন্ত্রক হলেন। তবে আওয়ামী ঘরানার লোকদের স্বভাবজাত উগ্রতার কোনো প্রকাশ দেখিনি তার মাঝে। সেই সময় ক্রিকেটে জাতীয় টিম বিদেশে কোনো একটা সাফল্য অর্জন করে। সাবের পুরো টিম নিয়ে আসেন মিন্টো রোডে তখনকার বিরোধী দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার জন্য বরাদ্দ সরকারি বাসায়। শামিয়ানা টাঙিয়ে সেখানে সংবর্ধনা সভা হয়। সাবেরের মার্জিত বক্তৃতা ও বিনয় আমার ভালো লেগেছিল।

২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এলে সাবের চৌধুরীকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করাটা আমার পছন্দ হয়নি। তখন আমি প্রধানমন্ত্রী অফিসে কাজ করি। একদিন আমার অফিস কক্ষে এলেন শিমুল বিশ্বাস। তিনি তখন রাজনৈতিক বিবেচনায় চুক্তিভিত্তিতে বিআইডব্লিউটিসি চেয়ারম্যান পদে নিয়োজিত। শিমুল বললেন, ওই সংস্থার একটা ফেরিতে করে সাবের চৌধুরী নদী পার হয়েছেন। তার সঙ্গে ছিল ছাত্রলীগ-যুবলীগের একদল উচ্ছৃঙ্খল তরুণ। কোনো এক ছুতায় ওরা ফেরির স্টাফদের ওপর চড়াও হয়। সাবের চৌধুরী কেবিন থেকে এসে নিবৃত্ত করার আগেই তারা খাবার ঘরের প্লেট, ডিশ, গ্লাস, পেয়ালাসহ মূল্যবাস সব বাসনকোসন আছড়ে, ছুড়ে ফেলে ভেঙে চুরমার করে। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে এক প্রভাবশালী ক্ষমতাধর ব্যক্তি শিমুল বিশ্বাসকে ডেকে এনে সাবের চৌধুরীকে আসামি করে তৈজসপত্র ভাঙচুর ও খোয়া যাওয়া এবং কর্মচারীদের মারধর করার অভিযোগে মামলা দায়েরের নির্দেশ দেন। শিমুলের পক্ষে ওই নির্দেশ উপেক্ষা করা সম্ভব হয়নি।

এর কিছুদিন পর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রনেড হামলার ঘটনা ঘটে। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তখন হাসিনার সঙ্গে সশরীরে দেখা করতে উদগ্রীব। কিন্তু এই সাক্ষাতের উদ্যোগের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ তখন নানারকম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছিল। এ অবস্থায় সাক্ষাতের ব্যাপারে সহযোগিতা চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী ফোন করলেন শেখ হাসিনার রাজনৈতিক সচিব সাবের হোসেন চৌধুরীকে। সময় নিলেন সাবের। দুই-তিন ঘণ্টা পর ফিরতি ফোনে তিনি বললেন, এই সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দিতে পারলে তিনি সবচেয়ে খুশি হতেন; কিন্তু হাসিনাকে মোটেও রাজি করানো যায়নি। কাজেই দুঃখিত তিনি।

এক-এগারো সরকারের সময় সাবের সম্ভবত নিজেকে আওয়ামী সংস্কারপন্থিদের কাতারভুক্ত করেছিলেন। সেই কারণে ২০০৯ সালে ক্ষমতাসীন হাসিনার 'ফরগিভ, বাট নট ফরগেট' পলিসির আওতায় সাবের গুরুত্ব হারান। ২০১৪ সালে আমার এক সিনিয়র বন্ধু সাবেবের সঙ্গে বিদেশ সফর করেন। তিনি আমাকে বলেছিলেন, হাসিনা রেজিমের বিরুদ্ধে 'কিছু একটা' করতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছেন সাবের। তার সে গুপ্ত চেষ্টা সম্পর্কে আমি আর কখনো কিছু জানতে পারিনি। তবে ধীরে ধীরে সাবের তার হারানো গুরুত্ব ফিরে পান। ২০২৩ সালে হাসিনা তাকে মন্ত্রীর মর্যাদায় 'বিশেষ দূত' এবং ২০২৪ সালে পূর্ণমন্ত্রী করেন। সাবের চৌধুরী দেশে-বিদেশে হাসিনা রেজিমের পক্ষে দৃশ্যমান তৎপরতা শুরু করেন।

চব্বিশের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে হাসিনার পতন ও পালানোর পর সাবের গ্রেফতার হন। তবে সবার আগে হাসিনা রেজিমের যে দুই মন্ত্রী দ্রুত জামিনে মুক্ত হন তার একজন সাবের, অপরজন 'কচুরিপানা' খ্যাত প্রাক্তন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান। এই দুজনের জামিন নিয়ে নানারকম গুজব এখনো রঙ ছড়াচ্ছে। গুজবের সত্যাসত্য জানি না, তবে গুজবের আড়ালের একটা ঘটনা আমার জানা। পুলিশের মাঝ পর্যায়ের এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা সাবের চৌধুরীকে গ্রেফতার করেন। ওই বিএনপিপন্থি কর্মকর্তাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। এই গ্রেফতারের 'অপরাধে' ওই কর্মকর্তাকে শাস্তিস্বরূপ দ্রুত অগুরুত্বপূর্ণ স্থানে বদলি করে দেওয়া হয়। ঢাকার পুলিশ কমিশনার তাকে ডেকে বলেন, আমেরিকার অতি উঁচু পর্যায়ে সাবের চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে। তুমি তাকে এভাবে গ্রেফতার করে আমাদের সবাইকে বিব্রত করেছ।

সাবের চৌধুরীর এত উচ্চক্ষমতার প্রমাণ হাতেনাতে পেয়ে আমি তো টাস্কি খেয়ে গেলাম। আবার এমনও শুনছি যে, সামনে হাসিনাবিরোধী পরিমার্জিত আওয়ামী লীগ দাঁড় করাবার ক্ষেত্রেও সাবের ভূমিকা পালন করতে পারেন। আবার জামিন পেয়ে এ সরকারের আমলে সাবের তার মালিকানাধীন দৈনিক ভোরের কাগজ পত্রিকা বন্ধ করে সাংবাদিক-কর্মচারীদের রাস্তায় ঠেলে দিয়েও তার প্রকাণ্ড ক্ষমতার আরেক দফা প্রমাণ দিয়েছেন। এক্ষেত্রে আইন-কানুন, ইনসাফ, মানবতা কোনো কিছুর তোয়াক্কাই তিনি করেননি।

দেশের এক অভিজাত ধনকুবের সাবের। এক সময়কার সেনাপ্রধান জেনারেল নাসিম ছিলেন তার আত্মীয়। সেনা গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান থাকতেই নাসিম উচ্চাভিলাষী হয়ে ওঠেন। তিনি আর্মির রিপ্যাট্রিয়েটেড সব অফিসারকে কোণঠাসা করে শুধু মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের কমান্ড পজিশনে বসাবার উপযোগী করে গোয়েন্দা রিপোর্ট দিতে থাকেন সরকার প্রধানকে। এ লক্ষ্য অর্জনের সহায়ক রূপে নাঈমুল ইসলাম খানকে দিয়ে আজকের কাগজ পত্রিকা বের করানো হয়। সেটির অর্থায়ন করেন কাজী শাহেদ। নাঈমুলের সঙ্গে বিরোধ হলে কাজী শাহেদ তাদের সদলবলে বের করে দেন। তাদের পুনর্বাসন করতেই সাবেরের অর্থায়নে ভোরের কাগজ বের করা হয়। এই কাগজের সঙ্গে যুক্ত হয় সাবের চৌধুরীর মালিকানাধীন স্যাটেলাইট টেলিভিশনও। সাবেক আমলা ও বিএনপির এমপি মুশফিকুর রহমান দেশ টিভির লাইসেন্স নিয়েছিলেন খালেদা জিয়ার কাছ থেকে। এই টিভির মেজর শেয়ার কিনে মালিক হন সাবের চৌধুরী। এটি তিনি চালাতেন আসাদুজ্জামান নূরকে দিয়ে। আর ভোরের কাগজ তারিক সুজাতের নেতৃত্বে কতিপয় তরুণ আওয়ামী ইন্টেলেকচুয়ালদের দিয়ে চালাতেন সাবের। হাসিনার এক বশংবদ সাংবাদিক শ্যামল দত্তকে ভোরের কাগজের সম্পাদক বানানো হয়েছিল। সেই শ্যামল এখন কারাগারে। আর কারামুক্ত হয়েই সাবের তালা ঝুলিয়ে দিয়েছেন ভোরের কাগজ অফিসে।

রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাচ্যুত হয়েও অন্য কোনো এক ক্ষমতার দাপটে ধনকুবের সাবের লাথি মেরেছেন দরিদ্র সাংবাদিক-কর্মচারীদের পেটে। এই উচ্চমূল্যের বাজারে তাদের সন্তানদের ক্ষুধার গল্প আমি জানি। তাদের ক্ষুধার্ত চোখ অন্ধকারে আমার দিকে জ্বলজ্বল করে চেয়ে থাকে। আমি ঘুমাতে পারি না। ধনকুবের সাবের ঘুমান কী করে? 

আমি শুনেছি, ওই অফিসে এক নয়া বখতিয়ার খিলজির আবির্ভাব ঘটেছে। শ্যামলের কারারুদ্ধতার সুযোগে সেই ইখতিয়ার উদ্দিন ওরফে বখতিয়ার খিলজি নাকি সম্পাদক হতে চায়।

সাংবাদিক-কর্মচারীরা তাকে নয়, চায় সম্পাদক হিসেবে যোগ্যতর কাউকে। ওই লোকটিই নাকি সবার বিরুদ্ধে কান ভাঙানি দিয়ে সাবেরকে দিয়ে এসব করাচ্ছে! সে নাকি বলেছে, সাংবাদিক-কর্মচারীরা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পত্রিকার মালিকানা দখলের চক্রান্ত এঁটেছে। এই মিথ্যায় বশীভূত হয়ে সাবের যদি এমন অমানবিক ও বেআইনি সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন তাহলে তার বিবেচনার ওপর ভরসা রাখা যায় না। তাকে ভালো মানুষ ভাবাটাও হোঁচট খাচ্ছে আজ।

অফিস বন্ধ করে, সাংবাদিক-কর্মচারীদের দায়িত্ব পালন করতে না দিয়ে অন্য গুপ্ত ঠিকানা থেকে  ভোরের কাগজের অনলাইন এডিশন বের করা আইনসিদ্ধ কাজ নয়। সাবের চৌধুরীর উচিত, কারো কান কথা না শুনে সরাসরি আলোচনায় বসে সাংবাদিক-কর্মচারীদের অভিযোগ ও দাবি শুনে তার যৌক্তিক সমাধান করা। দ্রুত কাগজ চালু করা। চাকরিচ্যুতির পথে না হাঁটা। একান্তই কাউকে ছাঁটাই করতে হলে বকেয়াসহ তার সব ন্যায্য পাওনা অবিলম্বে পরিশোধ করা দরকার। সাবের চৌধুরী এর অন্যথা করলে তথ্য মন্ত্রণালয়ের উচিত দ্রুত হস্তক্ষেপ করা এবং উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া। সাংবাদিক সংগঠনগুলোই বা এখনো কেন ঘুমিয়ে আছে?

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম