Logo
Logo
×

দৃষ্টিপাত

মারুফ কামাল খান

মুজিবের নাকি হাসিনার অঘোষিত বাকশাল বেশি ভয়ঙ্কর?

Icon

যুগান্তর ডেস্ক

প্রকাশ: ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:৩১ পিএম

মুজিবের নাকি হাসিনার অঘোষিত বাকশাল বেশি ভয়ঙ্কর?

বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সাবেক প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান সোহেল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। এতে তিনি শেখ মুজিবের বাকশাল ও তার মেয়ে শেখ হাসিনার অঘোষিত বাকশাল নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা করেছেন।

শনিবার (২৫ জানুয়ারি) ফেসবুক অ্যাকাউন্টে দেওয়া মারুফ কামাল খান সোহেলের পুরো পোস্টটি হুবহু তুলে ধরা হলো—

২৫ জানুয়ারি বাকশাল প্রতিষ্ঠা দিবস। ১৯৭৫ সালের এই দিনে মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান দেশে একদলীয় বাকশাল শাসন-পদ্ধতি কায়েম করেন। সংসদে কোনো আলোচনা বা বিতর্কের সুযোগ না দিয়ে মাত্র ১১ মিনিটে একটি বিল পাশের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সংবিধানের মৌলিক রদবদল করা হয়। এটি চতুর্থ সংশোধনী নামে পরিচিত। শেখ সাহেবের নাম দিয়েছিলেন 'দ্বিতীয় বিপ্লব।' তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, এর মাধ্যমে বাংলাদেশে নিজস্ব ধাঁচের সমাজতন্ত্র বা শোষিতের গণতন্ত্র কায়েম হবে।

এই পরিবর্তনে দেশে একটি মাত্র দল বাকশাল ছাড়া সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হয়। এই বাকশালকে জাতীয় দল বলে উল্লেখ করা হয়। আওয়ামী লীগকে চালকের আসনে রেখে স্বদেশী ধারার সমাজতন্ত্র কায়েমের এই প্রকল্পে তখনকার সোভিয়েত রাশিয়াপন্থি সিপিবি ও ন্যাপ-মোজাফফরসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল শামিল হয়। তারা এই পরিবর্তিত ব্যবস্থাকে সমর্থন করেই এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়। অবশ্য এইসব দলের কাউকে নেতৃস্থানীয় কোনো ভূমিকা বা উল্লেখযোগ্য পদ-পদবি দেওয়া হয়নি।

তবে সাম্প্রতিকালে সিপিবি থেকে বলা হয়েছে, তাদের দলের বা তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষ থেকে একদল করায় প্রণোদনা দেওয়া হয়নি বরং তাদের দলীয় একটি টিম শেখ সাহেবের সঙ্গে দেখা করে একদল না করার পরামর্শ দিয়েছিল, তিনি শোনেননি। তাই সিপিবি বাকশালে যোগ দিলেও দলের একটি ক্ষুদ্র কাঠামোর অস্তিত্ব গোপনে রেখে দিয়েছিল। এতদসত্বেও বাকশালে যোগ দেয়াটা সিপিবির ভুল হয়েছিল বলে পরবর্তীকালে তাদের দলীয় মূল্যায়ন।

যাহোক, যে এমপিরা একদলীয় ব্যবস্থা প্রবর্তনের পর বাকশালে যোগ দেননি তারা সংসদ সদস্যপদ হারান। এই পরিবর্তনের সঙ্গে যুগপৎ ভাবে সংসদ ও সরকারের মেয়াদ ভোট ছাড়াই বাড়ানো হয়। নির্বাচন ছাড়াই শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত করে বলা হয়, তিনি রাষ্ট্রপতি পদে এমন ভাবে অধিষ্ঠিত হবেন, যেন তিনি নির্বাচিত।

বাকশাল ব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে প্রতিদ্বন্দিতাপূর্ণ অবাধ নির্বাচন ব্যবস্থা এবং নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের পদ্ধতিও বিলুপ্ত হয়ে যায়। মিলিটারি, পুলিশ, বিডিআর, আমলাতন্ত্রের লোকদেরও বাধ্যতামূলকভাবে বাকশাল সদস্য করা হয়। জেলায় জেলায় একদলীয় বাকশাল মনোনীত ব্যক্তিকে গভর্নর পদে বসিয়ে নতুন প্রশাসনিক ব্যবস্থা চালু হয়।

জনগণের নাগরিক স্বাধীনতা, মৌলিক অধিকার ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রহিত করা হয়। সব সংবাদপত্র নিষিদ্ধ করে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত কেবল চারটি মাত্র দৈনিক পত্রিকা প্রকাশের ব্যবস্থা করা হয়। বাকশাল-এ যোগ দিতে অস্বীকৃত সাংবাদিকদের চাকরি চলে যায়। যোগদানকারী সাংবাদিকদের যাদের চার পত্রিকায় চাকরি দেওয়া যায়নি তাদেরকে পেশাচ্যুত করে অন্য চাকরিতে পুনর্বাসন অথবা জীবিকাভাতা দেওয়া হয়।

স্বাধীনতার পর থেকেই আওয়ামী লীগের ধ্বনি ছিল: 'একনেতা একদেশ- বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ।' তারা শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক ভাবনা ও কর্মসূচিকে 'মুজিববাদ' নাম দিয়ে প্রচার চালাতে থাকে। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে বুদ্ধিজীবীদের দিয়ে বইপত্রও লেখানো হয়। মুজিববাদ-বিরোধী কোনো মতামত বাংলাদেশে চলতে দেওয়া হবে না বলে হুমকি আসতে থাকে। তারা দাবি তোলে, দেশে আইনের শাসন নয়, মুজিবের শাসন কায়েম করতে হবে। একনেতাকেন্দ্রিক এ ভাবনাই অনিবার্যভাবে আওয়ামী লীগকে একদলীয় চিন্তার দিকে ধাবিত করে।

আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি জাতীয় জনযুদ্ধ। মুষ্টিমেয় বিশ্বাসঘাতক ছাড়া দলমত নির্বিশেষে সারা দেশের লাখ লাখ সক্ষম মানুষ এতে অংশ নেয়। বাকিরা ছিলেন সহযোগী ও সমর্থক। কিন্তু স্বাধীনতার পর জাতীয় সরকার গঠনের দাবি প্রত্যাখ্যান করে আ.লীগ একাই রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্র পরিচালনায় তাদের সার্বিক ব্যর্থতায় দেশে শতাব্দির ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ নামে। অনাহারে, অপুষ্টিতে, অখাদ্য খেয়ে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। অর্থনীতি ধ্বসে পড়ে। চোরাচালান, মজুতদারি, দুর্নীতি, লুটপাট সর্বগ্রাসী রূপ ধারণ করে। আইন-শৃঙ্খলার গুরুতর অবনতি ঘটে। সাধারণ মানুষ সীমাহীন দুর্দশায় নিপতিত হয়। তারা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। এতে শাসক মহল সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। তারা সম্ভাব্য আন্দোলন দমাতে মরিয়া হয়ে ওঠে।

একদল কায়েমের আগে রক্ষীবাহিনী ও দলীয় নানান সন্ত্রাসী বাহিনীর মাধ্যমে বিরোধীদলের ওপর চরম নির্যাতন চালানো হয়। ভিন্নমতের নেতাকর্মী বিশেষ করে চীনঘেঁষা বামপন্থীরা ও বিদ্রোহী আওয়ামী তরুণদের সমন্বয়ে গড়া জাসদের লোকজন ব্যাপকভাবে গুম, খুন, হামলা, মামলা, শারিরীক নির্যাতন ও বন্দিত্বের শিকার হন। ভিন্নমতের সংবাদপত্রের প্রকাশনা নিষিদ্ধ ও সাংবাদিকদের গ্রেফতার করা হয়। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মতন বয়োবৃদ্ধ জননেতাকে গৃহবন্দি করা হয়। সশস্ত্রবিপ্লবী সিরাজ সিকদারকে বন্দি অবস্থায় বিনাবিচারে মেরে ফেলা হয়। সব শেষে চূড়ান্ত পদক্ষেপ নেওয়া হয় আনুষ্ঠানিকভাবে একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে মুজিববাদ পুরোপুরি কায়েম করে। স্বাধীনতার পর আওয়ামী সরকার ১৯৭৩ সালে জাতীয় সংসদের প্রথম নির্বাচন করলেও সেই নির্বাচনি ইশতেহারে একদলীয় পদ্ধতি প্রবর্তনের কোনো আভাস দেয়নি এবং এ ব্যাপারে জনগণের কোনো ম্যান্ডেট বা অনুমোদনও নেয়নি।

জনগণের সম্মতিহীন এই বাকশাল বা মুজিববাদ একবছরও টেকেনি। বাইরের কেউ নয়, বাকশালের অন্তর্ভুক্ত একটি নেতৃস্থানীয় অংশ সেনাবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা সদস্যদের একটি অংশের মাধ্যমে রক্তক্ষয়ী পরিবর্তন ঘটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে। এই পরিবর্তনে সংবিধান স্থগিত ও একদলীয় বাকশাল পদ্ধতি বাতিল ঘোষণা করা হয়। এর অনেক পরে মুজিবকন্যা হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় এসে কায়েম করেন অঘোষিত একদলীয় শাসনব্যবস্থা। হত্যা, রক্তপাত, গুম, অপহরণ, নির্যাতন, দখল, দলীয়করণ, দুর্নীতি, লুণ্ঠনে সারা দেশকে এক উপদ্রুত জনপদে পরিণত করা হয়। নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করে অঘোষিত বাকশাল-এর এই ফ্যাসিবাদী শাসন প্রলম্বিত হয় পনেরো বছরেরও বেশি সময় ধরে। পরে ছাত্রগণঅভ্যুত্থানে এর পতন ঘটে এবং হাসিনা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। ইতিহাসের নির্মোহ গবেষকদেরকে খুঁজে বের করতে হবে : মুজিবের ঘোষিত বাকশাল, নাকি তার কন্যার অঘোষিত বাকশাল বেশি ভয়ঙ্কর ছিল?

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম