Logo
Logo
×

বাতায়ন

কোন নির্বাচন আগে : জাতীয় না স্থানীয়?

Icon

দিলীপ কুমার সরকার

প্রকাশ: ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

কোন নির্বাচন আগে : জাতীয় না স্থানীয়?

অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে যে ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে, এর মধ্যে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন অন্যতম। ৬ জানুয়ারি এ কমিশনের পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের সঙ্গে একটি মতবিনিময় সভা আয়োজন করা হয়। মতবিনিময়কালে বলা হয়, ‘জাতীয় পর্যায়ে সংসদ নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হলেও ঢাকার বাইরের মতামতে স্থানীয় নির্বাচন প্রাধান্য পাচ্ছে।’ পাশাপাশি ৮ জানুয়ারি এ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ইইউ ইনভেস্ট ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট নিকোলা বিয়ারের সঙ্গে আলোচনাকালে বলেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে।’

এ ধরনের বক্তব্যের পর বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, কোন নির্বাচন আগে হচ্ছে, জাতীয় নাকি স্থানীয় সরকার? এমনিতে রাজনৈতিক দলগুলো এবং জনগণের একাংশের মধ্যে আগে থেকেই এমন সন্দেহ-সংশয় রয়েছে-অন্তর্বর্তী সরকার দীর্ঘসময় ক্ষমতায় থাকতে চায়। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের প্রসঙ্গটি আসায় সেই সন্দেহ-সংশয় আরও পরিপুষ্ট হয়েছে। কেননা এ সরকারের উদ্যোগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করতে হলে তা জাতীয় নির্বাচনের আগেই করতে হবে। জাতীয় নির্বাচন হয়ে গেলে তখন আর তাদের হাতে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজনের সময় থাকবে না। কেননা তখন বিজয়ী দলের কাছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। সন্দেহের আরেকটি বড় কারণ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির উদ্যোগে রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা। জনমনে এমন একটা ধারণা আছে, প্রকাশ্যে না হলেও ছাত্র-তরুণরা দল গঠনের ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে। আর জাতীয় নির্বাচনের আগে দল গোছানোর জন্য এদের কিছুটা সময় প্রয়োজন। এসব কারণে জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত করার একটি প্রচেষ্টা থাকলেও থাকতে পারে বলে অনেকে মনে করছেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্বের মধ্যে যদি স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিষয়টি যুক্ত করা যায়, তবে জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত করা অনেকটা সহজ হয়ে যায় বলে তারা মনে করেন।

আমরা জানি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলসহ কিছু রাজনৈতিক দল চাচ্ছে দ্রুত নির্বাচন। অপরদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটিসহ কেউ কেউ দেরিতে নির্বাচন চায়। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের বক্তব্য ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংস্কারের যে উদ্যোগ নিয়েছে, তার প্রতি আমাদেরও সমর্থন রয়েছে। আমরা রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে ৩১ দফা রূপরেখা ঘোষণা করেছি; সরকার গঠনের সুযোগ পেলে আমরা তা বাস্তবায়ন করব।’ দলটি মনে করে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ইচ্ছা করলেই তো সব ধরনের সংস্কার করতে পারবে না। যেসব সংস্কারের ক্ষেত্রে সংবিধান সংশোধনের বিষয় জড়িত, তা পরবর্তী সংসদকে করতে হবে। তাই এ সরকারের পক্ষে যতটুকু সম্ভব, সেই সংস্কার করেই তাদের দ্রুততম সময়ে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা উচিত। দলটি এও মনে করে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একমাত্র দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা। অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি মনে করে, বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য ধীরে ধীরে স্থানীয় সরকার নির্বাচন এবং পরে জাতীয় নির্বাচন, এভাবে ধাপে ধাপে যাওয়া উচিত। তারা আরও মনে করেন, গণ-অভ্যুত্থানের সময় হত্যা ও অপরাধকর্মের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের পর এবং এ সরকারের নেতৃত্বেই সব ধরনের সংস্কারের পর জাতীয় নির্বাচনের উদ্যোগ নিতে হবে। তাদের দাবি, গণপরিষদ গঠন করে নতুন করে সংবিধান লিখতে হবে। অবস্থাদৃষ্টি মনে হচ্ছে, আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনের মাঠের ক্রিয়াশীল পক্ষগুলোর কারও কারও অবস্থান বিপরীত দুই মেরুতে। এদিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মনে করে, রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে ন্যূনতম সংস্কারের পর নির্বাচন করতে হলে তা হবে ২০২৫-এর ডিসেম্বরের মধ্যে; আর সংস্কারের আওতা যদি বিস্তৃত হয়, তবে ২০২৬-এর মাঝামাঝি সময়ে হবে এ নির্বাচন।

প্রেক্ষাপট যখন এমন, তখন নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই কি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ও জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব? জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন কি সব রাজনৈতিক দল মেনে নেবে? যদি না নেয়, তবে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচন চাওয়া পক্ষের সঙ্গে কি বিলম্বে নির্বাচন চাওয়া পক্ষের মধ্যে সাংঘর্ষিক পরিস্থির উদ্ভব হতে পারে? ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, দ্রুততম সময়ের মধ্যেই দুই ধরনের নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব। তবে তা নির্ভর করে কিছু ‘যদি’ ‘কিন্তু’র ওপর। প্রথমত, পূর্বনির্ধারিত সময়কে ঠিক রেখে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সংস্কার ও নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে এবং তা যথাযথভাবে বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করতে হবে। দ্বিতীয়ত, ফেব্রুয়ারিতে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন সুপারিশসংবলিত প্রতিবেদন পেশ করলে, সঙ্গে সঙ্গেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কর্তৃক গঠিত ‘জাতীয় ঐক্য গঠন কমিশন’কে রাজনৈতিক দলসহ অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সংস্কারের ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করতে হবে। তৃতীয়ত, স্থানীয় সরকারের নিুবর্ণিত সংস্কারগুলো করতে, ১. সব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে সংসদীয় পদ্ধতির নির্বাচনব্যবস্থা প্রবর্তন; ২. সব প্রতিষ্ঠানে নারীদের জন্য ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে আসন সংরক্ষণ; ৩. সব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানকে একীভূত আইনের আওতায় আনা; ৪. একই তফশিলে এবং একই সঙ্গে সব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন আয়োজন; ৫. জেলা পরিষদের নির্বাচন জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে আয়োজন; ৬. প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচনের জন্য জেলা ও উপজেলা পরিষদের মোট সদস্য সংখ্যা নির্ধারণ এবং ৭. মোট সদস্য সংখ্যার ভিত্তিতে জেলা ও উপজেলা পরিষদকে পৃথক পৃথকভাবে নির্বাচনি এলাকায় বিভক্তকরণ। চতুর্থত, সংস্কারের বিষয়গুলো চূড়ান্ত হলে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক অধ্যাদেশ জারি করে একটি একীভূত আইন প্রণয়ন করতে হবে। এক্ষেত্রে সংবিধান সংশোধনের কোনো প্রয়োজন না হওয়ায় দ্রুততার সঙ্গে কাজটি করা যাবে। পঞ্চমত, প্রণীত একীভূত আইনের আওতায় প্রথমে সব স্থানীয় সরকার নির্বাচন একসঙ্গে আয়োজন করতে হবে। ষষ্ঠত, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচনের পর জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করে বিজয়ী দল বা জোটের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।

স্থানীয় সরকারের ক্ষেত্রে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে যদি উল্লিখিত সংস্কারগুলো হয়, তখন সব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন দ্রুততম সময়ে একই সঙ্গে করা সম্ভব। কেননা তখন প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের জন্য ভোটাররা মাত্র একটি করে ভোট দেবেন। সব প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন একসঙ্গে হলে একজন ভোটারকে সর্বোচ্চ তিনটি ভোট দিতে হবে। বর্তমানে ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটাররা তিনটি করে ব্যালটে ভোট দিয়ে অভ্যস্ত। উপরিউক্ত বিষয়গুলো সন্নিবেশিত করে সংস্কার হলে ইউনিয়ন পরিষদের আওতাধীন ভোটাররা ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ এবং জেলা পরিষদ অর্থাৎ তিনটি প্রতিষ্ঠানের তিনটি ব্যালটে সদস্য পদের জন্য একটি করে তিনটি ভোট দেবেন; পৌরসভার একজন ভোটার পৌরসভা, উপজেলা পরিষদ এবং জেলা পরিষদ তিনটি ব্যালটে কাউন্সিলর ও সদস্য পদের জন্য একটি করে তিনটি ভোট দেবেন এবং সিটি করপোরেশনের ভোটাররা সিটি করপোরেশন ও জেলা পরিষদের জন্য দুটি ব্যালটে কাউন্সিলর ও সদস্য পদের জন্য একটি করে দুটি ভোট দেবেন। তবে বিদ্যমান নির্বাচনব্যবস্থা বহাল থাকলে, সেক্ষেত্রে একই দিনে সব প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন অয়োজন সম্ভব নয়। কেননা একদিনে ভোট হলে তখন ক্ষেত্রবিশেষে একজন ভোটারকে নয়টি ও ছয়টি করে ভোট দিতে হবে; যা কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। অপরদিকে একসঙ্গে নির্বাচন না হলে ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, উপজেলা পরিষদ, সিটি করপোরেশন ও জেলা পরিষদের পৃথক পৃথকভাবে নির্বাচন আয়োজন করতে হলে দীর্ঘ সময় লেগে যাবে। তখন জাতীয় নির্বাচন অনেক পিছিয়ে যাবে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যে ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে, তার মধ্যে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, সংবিধান সংস্কার কমিশন, দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশন ও পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশন ইতোমধ্যেই সরকারের কাছে প্রতিবেদন দাখিল করেছে। বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন প্রতিবেদন পেশ করবে ৩১ জানুয়ারির মধ্যে। স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিশন, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন, শ্রমিক অধিকারবিষয়ক সংস্কার কমিশন, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন এবং স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন প্রতিবেদন পেশ করবে ফেব্রুয়ারি ২০২৫-এর মধ্যে। যেহেতু সরকার ইতোমধ্যেই জাতীয় ঐকমত্য গঠন কমিশনের ঘোষণা দিয়েছে, তাই সংস্কার কমিশনগুলো প্রতিবেদন দাখিলের সঙ্গে সঙ্গেই অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করতে পারে। সংস্কারের বিষয়ে যেসব ক্ষেত্রে ঐকমত্য সৃষ্টি হবে, তাতে যদি সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন না থাকে, তবে তা দ্রুততার সঙ্গে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে করে ফেলতে হবে। যেসব বিষয়ে সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন হবে, সেই সংস্কারগুলোর উদ্যোগ নির্বাচিত সরকারকে গ্রহণ করতে হবে। তবে নির্বাচিত সরকার কর্তৃক যেসব সংস্কার করা হবে, সে বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি জাতীয় সনদ বা সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করানোর উদ্যোগ আগেই নিতে হবে জাতীয় ঐকমত্য গঠন কমিশনকে; যাতে যে দলই সরকার গঠন করুক না কেন, তারা যেন সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করতে এবং যে দলগুলো বিরোধীদলের আসনে বসবে, তারা যেন তাতে সমর্থন দিতে বাধ্য থাকে।

পরিশেষে, অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে তাদের দায়িত্ব পালনের মেয়াদ নিয়ে সরকার ও কোনো একটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পরের মধ্যেও মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। এক ধরনের সন্দেহ ও অবিশ্বাসও কাজ করছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন প্রসঙ্গ সেই সন্দেহকে আরও জোরালো করেছে। দ্রুত সংস্কার ও নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার মধ্য দিয়ে সেই সন্দেহ ও অবিশ্বাস কিছুটা প্রশমিত হতে পারে। আর সরকার যদি আন্তরিক হয়, তবে দ্রুততার সঙ্গে তাদের এখতিয়ারভুক্ত সংস্কারগুলো করে প্রথমে স্থানীয় এবং পরে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব বলে আমি মনে করি। সব অংশীজনের মধ্যে ঐকমত্যের ভিত্তিতে স্থানীয় সরকার নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনের আগে আয়োজন করতে পারলে, তা নিঃসন্দেহে নবগঠিত নির্বাচন কমিশনের জন্য অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ হিসাবে ভূমিকা রাখবে।

দিলীপ কুমার সরকার : রাজনৈতিক বিশ্লেষক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম