গাজায় যুদ্ধবিরতি দীর্ঘস্থায়ী হবে কি?
ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী
প্রকাশ: ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ইসরাইল সরকার ও হামাসের সঙ্গে হওয়া যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি মুক্তি চুক্তি সম্পাদনের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ ১৫ মাস ধরে ফিলিস্তিনে চলমান নৃশংস গণহত্যা বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। বহুল প্রতীক্ষিত এ যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পরপরই গাজাবাসীর মধ্যে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের আনন্দে বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস দেখা দিয়েছে। মিষ্টি বিতরণ, পটকা ফুটানোসহ নানা উল্লাসে তারা মেতে উঠেছে। ১৯ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হওয়া যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনুসারে, ছয় সপ্তাহের প্রথম ধাপেই হামাস ৩৩ ইসরাইলি জিম্মিকে মুক্তি দেবে। ইসরাইল এর বিনিময়ে ছেড়ে দেবে তাদের জেলে আটক কয়েকশ ফিলিস্তিনি বন্দিকে। একই সময়ের মধ্যে ইসরাইলি বাহিনীকে গাজার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা ছাড়তে হবে এবং বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিরা পাবে বাড়ি ফেরার অনুমতি। পাশাপাশি প্রতিদিন শত শত ত্রাণবাহী লরিকে গাজায় ঢোকারও সুযোগ দেবে ইসরাইল। চুক্তির দ্বিতীয় ধাপ নিয়ে আলোচনা শুরু হবে প্রথম ধাপের ১৬তম দিনে। তৃতীয় ও শেষ ধাপে হবে গাজার পুনর্গঠন, যা শেষ হতে লাগবে কয়েক বছর। গাজার ভেতর ৮০০ মিটারের একটি ‘বাফার জোন’ তৈরি করা হবে, যার নিয়ন্ত্রণ থাকবে ইসরাইলের হাতে।
চুক্তির অন্যতম মধ্যস্থতাকারী দেশ কাতারের দেওয়া তথ্যমতে, যুদ্ধবিরতি চুক্তির আওতায় প্রথম ছয় সপ্তাহে মোট ১ হাজার ৮৯০ জন ফিলিস্তিনি মুক্তি পাবে। ইসরাইলি বিচারবিষয়ক মন্ত্রণালয় এখন পর্যন্ত ৭৩৪ জন বন্দি ও আটক ব্যক্তির তালিকা প্রকাশ করেছে। পক্ষান্তরে ইসরাইলকে ৩৩ জন জিম্মির তালিকা দিয়েছে হামাস। প্রথম ধাপে মুক্তি পাওয়াদের মধ্যে রয়েছে নারী সেনা ও বেসামরিক নারী-শিশু-বয়স্ক ব্যক্তি, অসুস্থ ও আঘাতপ্রাপ্তরা। কায়রোভিত্তিক একটি সংস্থার মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়ন পর্যবেক্ষণ করবে কাতার, মিসর ও যুক্তরাষ্ট্র। গণমাধ্যম সূত্রমতে, প্রথম দফায় তিন জিম্মির বিনিময়ে ৯০ জন ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দিয়েছে ইসরাইল। ফিলিস্তিনি একাধিক সংস্থার পরিসংখ্যান অনুসারে, বর্তমানে দখলকৃত পশ্চিম তীরের ১০ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি ইসরাইলি কারাগারে বন্দি রয়েছেন। তবে গাজা যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত কত ফিলিস্তিনিকে আটক করা হয়েছে, তার সঠিক কোনো তথ্য-উপাত্ত কারও জানা নেই।
যুদ্ধবিরতি শুরুর কয়েক ঘণ্টা আগে এক টেলিভিশন ভাষণে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী সতর্ক করে বলেছেন, এ যুদ্ধবিরতি ‘অস্থায়ী’ এবং গাজায় আঘাত হানার অধিকার এখনো ইসরাইলের রয়েছে। যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপের আলোচনায় ব্যর্থ হলে তার দেশ হামাসের বিরুদ্ধে আবার যুদ্ধ শুরু করতে প্রস্তুত। ইসরাইল চুক্তির লঙ্ঘন সহ্য করবে না। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের কাছে, ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে গাজা যুদ্ধবিরতির কার্যকারিতা কতটুকু দৃশ্যমান হবে, তা নিয়ে নানান প্রশ্নের উদ্রেক হচ্ছে। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া গাজায় ফিলিস্তিনিদের ফিরে যেতে দেওয়া একটি নিষ্ঠুর পরিহাস ছাড়া আর কিছুই না। তাদের বাড়িঘর পুনর্নির্মাণের আগে আশ্রয়ের জন্য কি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে? এ পুরো প্রক্রিয়ায় ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে ন্যায্য আচরণ করা হবে কিনা, সেটি নিয়েও বিতর্ক হতে পারে। বিশেষত, যে কোনো ধরনের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ উসকানিতে গাজায় ইসরাইলের অস্বাভাবিক মাত্রার প্রতিশোধ নেওয়ার প্রবণতাও এসব ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর নিরলস সমর্থন দেওয়ার ইতিহাস আমাদের সে ইঙ্গিতই দিচ্ছে। যদিও এ যুদ্ধবিরতি পুরো বিশ্ব, বিশেষ করে ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য অত্যন্ত জরুরি ছিল।
আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান চ্যাথাম হাউজের বিশেষজ্ঞ ইয়োসি মেকেলবার্গের দাবি, যুদ্ধবিরতির প্রথম ছয় থেকে সাত সপ্তাহ কঠিন হবে। এ যুদ্ধ থামানোর কোনো ইচ্ছা নেই ইসরাইলের বর্তমান সরকারের। তাদের সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি এজেন্ডা রয়েছে। সেই এজেন্ডা হলো, গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের তাড়িয়ে দিয়ে দখল করা। দোহা ইনস্টিটিউট ফর গ্র্যাজুয়েট স্টাডিজের সহযোগী অধ্যাপক তামের কারমত গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘ফিলিস্তিনিদের ওপর এ নৃশংসতা বন্ধের একমাত্র উপায় দখলদারি বন্ধ করা। ইসরাইলিরা দাবি করতে পারে, তারা মধ্যপ্রাচ্যে বড় পরিবর্তন এনেছে, হিজবুল্লাহকে দুর্বল করেছে, সিরিয়ায় সরকার পতন করেছে। তবে ফিলিস্তিনে এখনো তারা দখলদারির নীতিতে আটকে আছে। এ দখলদারি যতদিন বন্ধ না হবে, ততদিন ফিলিস্তিনের এ সংঘাত থামবে না।’
যুদ্ধবিরতিতে অসন্তোষ প্রকাশ করে ইসরাইলে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে দেখা গেছে। তারা এটিকে পরাজয়ের শামিল বলে বিবেচনা করছে। ক্ষোভ দেখা দিয়েছে নেতানিয়াহুর মন্ত্রিসভায়ও। গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তির বিরোধিতা করে সরকার থেকে পদত্যাগ করেছে কট্টর ডানপন্থি নেতা জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন গাভির ও তার দল ওজমা ইয়েহুদিতের আরও দুই মন্ত্রী। বেন গাভিরের দলের পক্ষ থেকে জানানো হয়, মন্ত্রিসভায় থাকা তাদের দলের সদস্যরা পদত্যাগ করেছেন। গাজা যুদ্ধবিরতির বিরোধিতা করে তারা সরকার থেকে আলাদা হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কেবল যুদ্ধ শুরু হলেই তারা আবার ফিরে আসতে আগ্রহী। তারা এটিকে ‘কলঙ্কজনক’ যুদ্ধবিরতি চুক্তি বলেও অভিহিত করেছেন। তাছাড়া পদত্যাগ করার সম্ভাবনা রয়েছে যুদ্ধবিরতির তীব্র বিরোধিতাকারী কট্টর বেজালেলেরও। তিনি গাজায় হামাসের সঙ্গে চলমান যুদ্ধবিরতিকে ‘গুরুতর ভুল’ ও ‘হামাসের কাছে আত্মসমর্পণ’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। গাজা দখল না করলে তিনি সরকার পতনের হুমকিও দিয়েছেন।
দুঃখজনক হলেও সত্য, যুদ্ধবিরতির বিষয়ে ঐকমত্যের ঘোষণা আসার পরও ৩৩ শিশুসহ ১২২ ফিলিস্তিনি ইসরাইলি হামলায় নিহত হয়েছে। যুদ্ধবিরতি কার্যকরের আগমুহূর্তে হামাসের পক্ষ থেকে জিম্মিদের তালিকা না পাওয়ায় যুদ্ধবিরতি পিছিয়ে দেয় ইসরাইল। এ বিলম্বের মধ্যে ইসরাইল গাজায় বিমান হামলা চালিয়ে ১৯ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে। উল্লেখ্য, ৭ অক্টোবর ২০২৩ থেকে গাজায় শুরু হওয়া ইসরাইলি বাহিনীর বর্বর সামরিক অভিযানে প্রায় ৪৭ হাজারের মতো ফিলিস্তিনি নিহত এবং ১ লাখের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন। জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী, হতাহতদের মধ্যে ৭০ শতাংশের বেশি নারী ও শিশু। আহতদের ২৫ ভাগের জীবন স্থায়ীভাবে বদলে গেছে। ধ্বংস হয়েছে গাজার ৬৯ ভাগ অবকাঠামো। বিশ্বের কতিপয় ক্ষমতাধর কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রনায়কের প্রত্যক্ষ মদদ ও আধুনিক সামরিক সহযোগিতা অব্যাহত রেখে নারকীয় এ তাণ্ডব ছিল নজিরবিহীন। সমগ্র ধরিত্রী অবাক বিস্ময়ে এহেন বর্বর কর্মযজ্ঞ শুধু পর্যবেক্ষণই করেছে। ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকাজুড়ে নির্বিচারে বিমান-রকেট-বোমা হামলা অব্যাহত রেখেছিল দখলদার ইসরাইল বাহিনী। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গাজায় ‘মানবিক যুদ্ধবিরতি’ প্রস্তাব সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে পাশ হলেও বোমা হামলার মাত্রা আরও বাড়িয়েছিল ইসরাইল। বিশ্বনেতাদের যুদ্ধবিরতির জোরালো আহ্বানকে উপেক্ষা করে ‘জয়ী’ না হওয়া পর্যন্ত এমন হামলা চলতে থাকবে বলে ঘোষণা দেয় ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী। অবরুদ্ধ এ উপত্যকায় এমন কোনো স্থান নেই, যেখানে ইসরাইলি বাহিনী হামলা চালায়নি।
১৯৪৮ সাল থেকে নির্যাতিত-নিপীড়িত ফিলিস্তিনিরা যুগের পর যুগ চরম অবিচারের সম্মুখীন। দেশ থেকে জোরপূর্বক বিতাড়নের মাধ্যমে ইহুদিবাদী রাষ্ট্র ইসরাইল যে দখলদারত্ব শুরু করেছিল; তা রোধে আজ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ পরিলক্ষিত নয়। ধারাবাহিক এ সংঘাতে নিরীহ মানুষের প্রাণহানির সঠিক পরিসংখ্যান বের করা অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। একটি স্বাধীন-সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এ সমস্যার একমাত্র ন্যায়সংগত সমাধান হলেও ইসরাইলের স্বার্থরক্ষার্থে বা পক্ষপাতদুষ্ট আচরণের কারণে কিংবা নতুন নতুন সংকটে এ বিষয়ে তথাকথিত উন্নত-ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের নানা রকম উদ্যোগ-প্রতিশ্রুতি বারবার ব্যর্থই হয়েছে। জাতিসংঘ বা মুসলিম বিশ্বের ২২ সদস্যের আরব লীগও কোনো অর্থবহ ভূমিকা পালন করতে পারেনি। বিগত ২৫ বছর ধরেই শান্তি আলোচনা চলছে ধীরে ধীরে। স্বাধীনতার প্রশ্নে পৃথিবীর বিপুলসংখ্যক দেশ ফিলিস্তিনের পক্ষে থাকলেও কথিত পরাশক্তি হিসাবে খ্যাত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের কতিপয় রাষ্ট্রের সরাসরি সমর্থন ইসরাইলকে আরও বেশিমাত্রায় বেপরোয়া করেছে বলে অভিজ্ঞ মহলের ধারণা।
ইসরাইলি দখলদার বাহিনী বিমান হামলায় হাজার হাজার নিরীহ বেসামরিক নাগরিক বিশেষ করে নারী ও শিশু হত্যা করেছে। এ নির্মম হামলা আন্তর্জাতিক মানবিক আইন ও চুক্তির স্পষ্ট লঙ্ঘন, যা মানবতার বিরুদ্ধে একটি গুরুতর অপরাধ। তথাকথিত মানবাধিকার সুরক্ষার সবক প্রদানকারীদের কঠিন হৃদয় এত বিশালসংখ্যক শিশু-কিশোর-নারী হত্যায় মোটেও বিচলিত হয়নি। বরং যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে পুরো ফিলিস্তিনকে পরিপূর্ণ ধ্বংসের হীন উদ্যোগ জারি রাখে। হত্যা-গণহত্যার চিত্রপট এমন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে; যাতে শুধু ইসরাইল নয়, বিশ্বের সব সচেতন গোষ্ঠী মানসিক ট্রমায় প্রচণ্ড বিপদগ্রস্ত। অচিরেই ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর যুদ্ধ বন্ধের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ অতীব জরুরি হয়ে পড়েছিল। অন্যথায় পুরো বিশ্ব ভয়ংকর ভবিষ্যতের দিকে এগোনোর আশঙ্কা তীব্র হতো। ইতোমধ্যেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসাবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতা গ্রহণে বিশ্বব্যাপী নতুন অধ্যায় রচিত হওয়ার ধারণা উচ্চকিত হয়েছে। ট্রাম্প সরকারের নীতিমালা আমেরিকাসহ বিশ্বে কী প্রভাব ফেলবে, তা নিয়ে সব সচেতন মানুষের কাছে সন্দেহ-সংশয়ের অন্ত নেই। এ ধারাবাহিকতায় গাজাবাসী বা ফিলিস্তিনিদের ভবিষ্যৎ নিয়েও গভীর উৎকণ্ঠায় পুরো বিশ্ববাসী দিনাতিপাত করছে।
ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী : শিক্ষাবিদ, সমাজ-অপরাধবিজ্ঞানী