Logo
Logo
×

দৃষ্টিপাত

কার নিন্দা করো, তুমি মাথা করো নত

মারুফ কামাল খান

মারুফ কামাল খান

প্রকাশ: ১৩ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯:২৫ এএম

কার নিন্দা করো, তুমি মাথা করো নত

ফাইল ছবি

শেখ হাসিনা তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ খালেদা জিয়াকে এক সময় ‘জেনারেল বেগম’ হিসেবে উল্লেখ করতেন। খ্যাতনামা সাংবাদিক-রাজনীতিক এজেডএম এনায়েতুল্লাহ্ খান তার জীবদ্দশায় একবার বেগম জিয়া সম্পর্কে ইংরেজিতে বলেছিলেন : ‘She is the only male in the political arena of Bangladesh full of cowards.’ এর মানে হচ্ছে, কাপুরুষে ভরা বাংলাদেশের রাজনীতির অঙ্গনে তিনিই একমাত্র পুরুষ।

জেনারেল এইচএম এরশাদের স্বৈরশাসনবিরোধী সংগ্রামে একটানা অটল ভূমিকার কারণে তার সমর্থক নেতাকর্মীরা ও গণমাধ্যম বেগম খালেদা জিয়াকে ‘আপসহীন নেত্রী’ অভিধায় ভূষিত করেছিল।

দীর্ঘ একটা সময়জুড়ে তার সান্নিধ্যে যাওয়ার দুর্লভ সুযোগ আমি পেয়েছিলাম। আমি যখন তার সঙ্গে কাজ করতে যাই তখনই অনুভব করতে পারি তার ব্যক্তিত্বের প্রখর কিরণচ্ছটা। আমি বুঝতে পারি, তার ছড়ানো ব্যক্তিত্বের যে দীপ্তি তাকে সব সময় ঘিরে রাখে, সেটাই তাকে দিয়েছে অনন্যতা। সবার মাঝখানে থেকেও তিনি নিজস্ব বৈশিষ্ট্য, স্বাতন্ত্র্য ও দূরত্ব বজায় রাখতে পারেন। সাহস ও দৃঢ়তার এক অনন্য নজির তিনি। তার মধ্যে কাঠিন্য নয়, অন্যরকম এমন কিছু বিশেষত্ব আছে যা সবাইকে তার প্রতি পরম শ্রদ্ধা ও মর্যাদাবোধে আকীর্ণ করে।

বেগম খালেদা জিয়া একজন নিবিষ্ট শ্রোতা। তিনি সবার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন বেশি। নিজে বলেন অনেক কম। তার অসামান্য সৌজন্যবোধ, বিনয় ও ভদ্রতায় মুগ্ধ হতে হয়। তবে বৈঠকি আড্ডা বা অহেতুক গল্পগুজব তিনি এড়িয়ে চলেন। বাহুল্য কথা তার একদম অপছন্দের।

কুৎসিত মনের নষ্ট মানুষদের কীভাবে উপেক্ষা করতে হয়, কীভাবে নোংরা ঊনমানুষদের জঘন্য উক্তিকে গ্রাহ্য না করে তাদের অস্তিত্বহীন করে দিতে হয়, সেটা আমি তার কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করেছি। ব্যক্তিগত আক্রমণকারীদের প্রতি তার নিরাসক্ত ঔদাসীন্যে কষ্ট পেয়েছি কিন্তু যারা তার দিকে ময়লা আবর্জনা ছুড়েছে দিনশেষে দেখেছি তাদেরই কর্দমাক্ত অবয়ব। অবশেষে দেদীপ্যমান সুন্দরের প্রতীক হয়ে ম্যাডাম জিয়াকেই দেখেছি বিজয়িনীবেশে।

এক-এগারোর পর ফখরুদ্দীন-মঈনউদ্দিনদের জরুরি অবস্থার জমানায় বেগম খালেদা জিয়া ও তার দুই পুত্রসন্তানকে বন্দি করা হয়। ম্যাডাম জিয়াকে রাখা হয় সংসদ ভবন এলাকায় সলিটারি কনফাইনমেন্ট বা নির্জন কারাবাসে। আর তারেক রহমান ও আরাফাত রহমানকে রাখা হয় আলাদা জেলখানায়। পিনো ও কোকো পারিবারিক নামে পরিচিত ম্যাডাম জিয়ার দুই সন্তানই কারাগারে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। অভিযোগ, বন্দি অবস্থায় রিমান্ডে নিয়ে তাদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। মুক্তির পর দুজনকেই উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠাতে হয়।

স্মৃতিচারণের ব্যাপারে ম্যাডাম জিয়া বরাবরই অতিসংযমী। নিজের বন্দিজীবন নিয়েও তেমন একটা গালগল্প করতেন না কখনো। তবে আমাদের কৌতূহল ছিল প্রবল। এ নিয়ে আমরা তার কাছে জানতে চাইলে তিনি খুব অল্প কথায় কিছু কিছু বিবরণ দিতেন। তার একটা কথা এখনো আমার মনে খুব দাগ কেটে আছে। তিনি যখন তার বন্দি সন্তানদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ সম্পর্কে জানতে পারেন তার পর থেকে কারাগারে খবরের কাগজ পড়া এবং টেলিভিশনে সংবাদ দেখা ছেড়ে দেন। কারণ হিসেবে বলেন, আমি তো মা। সন্তানের ওপর নির্যাতনের খবর আমাকে হয়তো দুর্বল করে ফেলত এবং সেই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ক্ষমতাসীনরা আমাকে ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করত। জেনারেল মঈনের নির্দেশে সেনা গোয়েন্দা সংস্থার লোকরা মৌখিক ও লিখিত নানা প্রস্তাব নিয়ে আমার কাছে আসত। আমি ওদের কথা শুনতাম না, পড়েও দেখতাম না। আমি বলতাম, বন্দি অবস্থায় আমি কোনো আলোচনাই করব না। আমি সতর্ক থাকতাম ছেলেদের ব্যাপার নিয়েও, যেন আমি দুর্বল হয়ে না পড়ি এবং ওরা যেন আমাকে ব্ল্যাকমেইল করার কোনো সুযোগ না পায়।

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা একবার গণভবনে প্রেস কনফারেন্স করছিলেন। তার মোসাহেব সাংবাদিকের পাল প্রশ্ন করার ছলে হরেকরকম তোষামোদী কথা বলে শেখ হাসিনাকে উসকে দিচ্ছিলেন খালেদা জিয়া সম্পর্কে আজেবাজে উক্তি করতে। তিনিও রসিয়ে রসিয়ে আদিরসাত্মক সব কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করে যাচ্ছিলেন একের পর এক। আমি দ্রুত ম্যাডাম জিয়ার অফিস রুমে গিয়ে তার সামনের টিভি সেটটা অন করলাম। তিনি সপ্রশ্নক চোখে তাকালেন। বললাম, ‘প্রেস কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী আপনার সম্পর্কে বিভিন্ন কথা বলছেন।’ ম্যাডাম জিয়া একটু তীক্ষè কণ্ঠে বললেন, ‘বন্ধ করে দেন। তার এসব নোংরা কথা শোনার মোটেও কোনো ইচ্ছে আমার নেই। ওসব আমি শুনি না। খামাখা মেজাজ খারাপ হবে। জবাব দেওয়ার ইচ্ছে করবে। কী দরকার? তার ওইসব নিচুমানের কথার জবাব দিতেও আমার রুচিতে বাধে।’

উদাহরণ বাড়াব না। বেগম খালেদা জিয়ার সান্নিধ্যে থেকে তার এ বৈশিষ্ট্যগুলো পর্যবেক্ষণ করেছি আমি। আমি তার মহানুভবতা, নির্লোভ, নিরাসক্ততা, ব্যক্তিত্ব, ঔদার্যবোধ, সংযম, ধৈর্য ও আচরণের শিষ্টতায় বিস্মিত হয়েছি। মনে হয়েছে, এ দেশের গড়পরতা মানুষদের থেকে তিনি আলাদা, বেশ উঁচুতে তার অবস্থান। কেমন করে তিনি এত সব মানবিক মহৎ গুণাবলি অর্জন করলেন?

প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষা তিনি গ্রহণ করতে পারেননি। দিনাজপুর শহরের সুরেন্দ্রনাথ কলেজে আইএ ক্লাসে পড়ার সময় তার বিয়ে হয়ে যায় এবং স্বামীর কর্মস্থল তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানে যেতে হয় লেখাপড়ায় ইতি টেনে। জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতের অভিজ্ঞতালব্ধ শিক্ষায় একজন স্বশিক্ষিত মানুষ তিনি। তার ভেতরকার মানবিক মূল্যবোধগুলো সহজাত এবং নানা বিষয়ের জ্ঞান ও প্রজ্ঞা তিনি নিজস্ব অধ্যয়ন ও প্রয়াসে অর্জন করেছেন। এমন মানুষ আমাদের সমাজে বিরল এবং সব সময় আমি তাকে একজন ‘বিস্ময় মানবী’ বলেই মনে করি।

শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দায়ের করেন, যার প্রায় সবই মিথ্যা এবং আনীত অভিযোগ বানোয়াট। প্রচলিত আদালতে নয়, শেখ হাসিনা আলাদা আদালত বসান খালেদা জিয়ার জন্য বকশীবাজারে আলিয়া মাদরাসায়। ঘন ঘন তারিখ ফেলে সেসব মামলায় বেগম জিয়াকে প্রতি তারিখেই হাজিরা দিতে বাধ্য করা হয় শুধু হয়রানি ও হেনস্তা করার জন্য। অথচ খালেদা জিয়ার শাসনামলে শেখ হাসিনাকে কোনো মামলায় একদিনের জন্যও কোর্টে হাজিরা দিতে হয়নি। ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত না হয়ে আইনজীবীর মাধ্যমে হাজিরা দেওয়ার সুযোগ হাসিনা পেলেও খালেদা জিয়াকে সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়।

শেখ হাসিনা তার শাসনামলে ভয়ভীতি ও লোভেটোপে বিচার বিভাগকে প্রায় সম্পূর্ণ বশীভূত করেছিলেন। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধের মামলাগুলো যাতে শেখ হাসিনার ইচ্ছায় চলে এবং তার মর্জিমাফিক রায় হয়, তার জন্য তিনি এসব মামলার বিচারকাজে নিযুক্ত বিচারকদের পদোন্নতিসহ নানা প্রাপ্তির ইশারা দিয়ে সাজা নিশ্চিত করেন। আপিল বিভাগে মামলা বিচারাধীন থাকা অবস্থায় চূড়ান্ত রায়ের আগেই শেখ হাসিনা নিম্ন আদালতের রায় কার্যকর করান। অবিচারের চূড়ান্ত নজির স্থাপন করে এ অবস্থায় জামিন না দিয়ে বেগম জিয়াকে জেলে ঢোকানো হয়।

বেগম জিয়া দুই বছর জেলে ছিলেন। এ সময় তার পছন্দের কোনো হাসপাতালে বা চিকিৎসকের কাছে তাকে চিকিৎসা নিতে দেওয়া হয়নি। পিজি হাসপাতালের সরকার নিয়োজিত ডাক্তারদের কাছে তাকে চিকিৎসা নিতে বাধ্য করা হয়। সেই ডাক্তাররা বারবার বলতে থাকেন, তেমন কোনো রোগই নেই বেগম জিয়ার। কিন্তু তার স্বাস্থ্যের গুরুতর অবনতি ঘটতে থাকলে শেখ হাসিনা নির্বাহী আদেশে তাকে বাসায় গৃহবন্দি থেকে পছন্দের হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণের ব্যবস্থা করেন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা লিভার সিরোসিসসহ তার বিভিন্ন গুরুতর জটিল রোগ শনাক্ত করেন। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষাধীন থাকা একজন ভিআইপির এসব রোগ থাকলে কারাগারে যাওয়ার আগেই তার আলামত পাওয়া যেত। কিন্তু এসবের কোনো কিছুই ছিল না। জেলে যাওয়ার পর হুট করে বেগম জিয়ার লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হওয়া এক গভীর রহস্য ও সন্দেহজনক ঘটনা। একজন বন্দি হিসেবে তিনি সরকারের জিম্মায় ছিলেন। এ অবস্থায় কোনো অবহেলা কিংবা ভুল ওষুধ বা বিষপ্রয়োগ যদি এই গুরুতর রোগের কারণ হয়ে থাকে তবে সরকারপ্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা এর দায় থেকে মুক্ত নন।

এতকিছুর পরও শেখ হাসিনার সব বৈরী আচরণের ব্যাপারে ম্যাডাম জিয়া কখনো অসংযত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেননি। হিজাব-নেকাব না পরলেও এবং ব্যক্তিগতভাবে প্রবল অসাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন হওয়া সত্ত্বেও খালেদা জিয়াকে আমি স্বধর্মের প্রতি গভীর অনুরাগী মানুষ হিসেবেই দেখেছি। নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত আদায়ে তিনি দারুণ পাবন্দ। আল্লাহ্তে তার পূর্ণ ইমান ও আস্থা। তিনি আন্তরিক বিশ্বাসের সঙ্গে বারবার একটি কথা উচ্চারণ করেন : ‘আল্লাহ্ সবকিছু দেখেন এবং তিনি ন্যায়বিচারক।’ শেখ হাসিনার ব্যাপারেও তার কাছ থেকে একই কথা শুনেছি : ‘আল্লাহ্ বিচার করবেন।’ আমি নিজেও একজন আস্তিক মানুষ। ঘটনার এত ঘনঘটনার মধ্য দিয়ে পুরো পরিস্থিতি উল্টে গেল। প্রবল পরাক্রম চোখের পলকে হয়ে গেল এক করুণ এপিসোড। দোর্দণ্ডপ্রতাপ পৈশাচিক শাসনের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা ও কর্ত্রীদের প্রাণভয়ে সন্ত্রস্ত ইঁদুরের মতো দেশ ছেড়ে পালাতে হলো। সারা দুনিয়া শেখ হাসিনার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল। ভারত ছাড়া দুনিয়ার কোনো দেশে মাথা গেঁাঁজার ঠাঁই মিলল না তার। ভারতকে যা দিয়েছেন তা তাদের কেয়ামত পর্যন্ত মনে রাখতে হবে বলে শেখ হাসিনা নিজেই জানান দিয়েছিলেন। হায়, কোথায় গেল আজ তার সব তাকাব্বরি, দম্ভ, অহংকার?

আর খালেদা জিয়া? আল্লাহ্র ওপর ভরসা করে, তার ওপর বিচারের ভার দিয়ে যিনি নীরবে সব সয়েছেন তিনি আজ মর্যাদার শীর্ষে। শাসক থেকে শুরু করে দীনহীন সাধারণ মানুষ পর্যন্ত আজ তার নামে শ্রদ্ধাবনত। তার জন্য সারাদেশ প্রার্থনায় নিবেদিত। তার চিকিৎসা-ভ্রমণের জন্য কাতারের মতো ধনাঢ্য দেশের আমির পাঠান বিশেষ উড়ো-অ্যাম্বুলেন্স। ব্রিটেন দেয় ভিআইপি প্রটোকল। এত হেনস্তা ও অপমানের অধ্যায়কে উল্টে দিয়ে খালেদা জিয়াকে এত বিপুল সম্মান ও অপরিমেয় মর্যাদায় অভিষিক্ত করার ঘটনাকে আমি অলৌকিক ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারি না।

সব দেখেশুনে কোরআনুল কারিম থেকে মহাপ্রভুর সমীপে পাঠ করি সেই অমোঘ বাণী : ‘আল্লাহুম্মা মালিকাল মুলকি তুতিল মুলকা মানতাশাউ ওয়া তানজিউল মুলকা মিম্মানতাশাউ ওয়া তুইজ্যু মানতাশাউ ওয়া তুজিল্লু মানতাশাউ বিইয়াদিকাল খাইর। ইন্নাকা আলা কুল্লি শাইয়িন ক্বাদির।’ হে আল্লাহ! তুমিই সার্বভৌম শক্তির অধিকারী। তুমি যাকে ইচ্ছা সাম্রাজ্য দান করো এবং যার কাছ থেকে ইচ্ছা রাজত্ব ছিনিয়ে নাও। তুমি যাকে ইচ্ছা সম্মান দান করো আর যাকে ইচ্ছা অপমানে লাঞ্ছিত করো। তোমারই হাতে রয়েছে যাবতীয় কল্যাণ। নিশ্চয়ই তুমি সর্ববিষয়ে পরাক্রমশালী।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম