Logo
Logo
×

দৃষ্টিপাত

‘থ্যাংক ইউ স্টেফান, দিস ইজ মুশফিক, অন বাংলাদেশ’

Icon

সুফিয়ান ফারাবী

প্রকাশ: ০৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯:২৮ পিএম

‘থ্যাংক ইউ স্টেফান, দিস ইজ মুশফিক, অন বাংলাদেশ’

একটু পেছনে তাকাতে হয়। বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষ তখনও ‘বন্দি কারাগারে’। বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীরা আছেন জেলে। সাধারণ মানুষ কিছু শর্ত সমেত বৃহৎ কারাগারে ঘোরাফেরার অনুমতিতে ছিলেন। কোণঠাসা দেশের বুদ্ধিজীবী সমাজ। কলম হাতে নিয়ে লিখতে অন্তত দশবার ভাবেন সাংবাদিকরা। 

দেশের জনগণ দেখছে সব, কিন্তু বলার সাহস পাচ্ছে না। শিক্ষার্থীরা মিথ্যা ইতিহাস পড়ে বড় হচ্ছে। প্রশ্ন করার বা রাষ্ট্রের কাছে জানতে চাওয়া ইচ্ছেটা দমিয়ে দেওয়া হয়েছে। যে জন্মভূমিতে সে জন্মগ্রহণ করেছে, তার সঠিক ইতিহাসটাই জানার সুযোগ নেই। 

আমরা তখন চুপচাপ দেখছি। কী করা যায় ভাবছি। খুঁজছি মুক্তির উপায়। কখনো স্বপ্ন দেখছি, একদিন হবে ভোর। 

আমাদের সিনিয়র সাংবাদিকরা পালা করে শেখ হাসিনার রাজসভায় যোগ দিচ্ছেন। শেখ হাসিনার দর্শন পেতে ‘পিএম বিটের’ সাংবাদিকরা অধীর আগ্রহে বসে থাকতেন। 

জন্মগতভাবে মানুষ এই অধিকারে বড় হয়েছে। তাকে যে শাসন করবে তার জবাবদিহি সে চাইতে পারে। তাছাড়া বাংলাদেশের সংবিধানেও বিষয়টি সংযুক্ত আছে। 

আমাদের ঊর্ধ্বতনরা ভুলে গিয়েছিলেন তারা সাংবাদিক। তাদের অধিকাংশের একটাই চাওয়া ছিলো, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’কে তারা প্রশ্ন করবেন, শেখ হাসিনা সেই প্রশ্নটি লুফে নিয়ে বিরোধীদল বা বিরোধী মতের উপর দায় চাপাবেন। প্রশ্ন-উত্তর পর্বটি ভাইরাল হবে। এই সুযোগে সচিবালয়ের বিভিন্ন দপ্তরে কর্মকর্তাদের কাছে তদবির করবেন। বুঝাতে চাইবেন শেখ হাসিনা তাদেরকে কতটা গুরুত্ব দেন! 

মুক্ত মঞ্চে শেখ হাসিনা যখন যা খুশি বলছিলো, নিজের ইচ্ছেমতো সিদ্ধান্ত জনগণের উপর চাপিয়ে দিচ্ছিলো এবং অপশাসনের মাত্রা প্রবলভাবে বাড়ছিলো তখন আমাদের কানে হঠাৎ একদিন একটি প্রশ্ন ভেসে আসে, জনৈক সাংবাদিক দেশের সাংবাদিকতার অভাব পূরণ করতে মাঠে নেমেছেন। আন্তর্জাতিক মহলের কাছে শেখ হাসিনাকে জবাবদিহিতার আওতায় আনার অনুরোধ করছেন। 

বহুজাতিক সংস্থাগুলোর বাংলাদেশ বিষয়ে আরো মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। তার সেসব প্রশ্নগুলোর মাধ্যমেই শেখ হাসিনার গুম, খুন,বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গণতন্ত্রহীনতা মানুষের অধিকার কেড়ে নেয়ার বিষয়টি আন্তর্জাতিক মহলে উঠে আসছিলো। 

জাতিসংঘ সদর দপ্তর, হোয়াইট হাউস, পেন্টাগন, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, হাউজ অফ কমন্সসহ আন্তর্জাতিক টেবিলে শেখ হাসিনার কুকীর্তি তুলে ধরতে থাকেন। জঙ্গিবাদ দমনের আড়ালে শেখ হাসিনা যেভাবে মানুষের উপর নির্যাতন চালাচ্ছিলো, তা বিদেশিরা খুব বেশি জানতেন না । এসব বিষয়ে যথাযথ তথ্য দেওয়ার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মহলে শেখ হাসিনাকে একজন স্বৈরশাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারী। 

আমার বিশ্বাস বাংলাদেশের মানুষের রাজনৈতিক সচেতনতা তখন থেকে ভয়াবহভাবে বাড়তে থাকে। গণতান্ত্রিক বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর প্রতিক্রিয়া তাদেরকে আশাবাদী করে। ফ্যাসিবাদমুক্ত একটা দেশের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে ১৮ কোটি মানুষ। 

সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারী যখন জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিককে প্রশ্ন করে জানতে চাইতেন, ‘থ্যাংক ইয়ু স্টেফান অন বাংলাদেশ....’ তখন মনোযোগ দিয়ে শুনতাম আমাদের নিয়ে কী ভাবছে বিশ্ব? 

অন্যদিকে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর তথা স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রধান মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারীকে ডেকে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে তার প্রশ্ন জানতে চাইতেন। উত্তরে হাসিনার অপশাসনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র কী ধরণের পদক্ষেপ নিচ্ছে, তা জানতে চাইতেন। 

আমি বিশ্বাস করি বাংলাদেশের রাজনীতি সচেতন সকল নাগরিক সে সময় দুটি সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্যের জন্য অপেক্ষায় থাকতেন। অন্তত ২০২১ সালের পর থেকে হাসিনা পতনের আগ দিন পর্যন্ত কোটি মানুষের চোখ ছিল শুধুমাত্র এই দুটি ব্রিফিং রুমে। 

অন্যরা বিষয়টি কিভাবে দেখতেন জানিনা। প্রতিদিন ভরে ঘুম থেকে উঠে আমি এই দুটো ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে কোন প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছে কিনা তা জানতে সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারীর আইডিতে ঢুঁ দিতাম। দীর্ঘদিন এটাই ছিল আমার দৈনন্দিন রুটিন। 

একজন বাঙালি বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরছেন হাসিনাদের অপরাধের ফিরিস্তি। জানতে চাইছেন পদক্ষেপ। উত্তরে মিলছে মানুষের সঙ্গে থাকার প্রতিশ্রুতি, সেসব দিনগুলো সত্যিই ইতিহাসের পাতায় অমলিন হয়ে থাকবে। 

বাংলাদেশের ইতিহাসে আর কোনো সাংবাদিক জীবনের এতোটা ঝুঁকি নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলকে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে সম্পৃক্ত করতে পেরেছিলেন কিনা আমি জানিনা। তবে সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারীর দৃঢ় চিত্তে জানতে চাওয়া সেসব প্রশ্নগুলো আমাদের ইতিহাসে মোটাদাগে লেখা থাকবে। 

মুশফিকুল ফজল আনসারী সাংবাদিকতাকে বিদায় জানিয়েছেন। বেছে নিয়েছেন কূটনীতি। ১৮ কোটি মানুষের প্রতিনিধিত্ব করবেন অন্য একটি দেশে। আমার বিশ্বাস, যতদিন বাঁচবেন, লড়ে যাবেন মানুষের পক্ষে অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে। 

তবে সত্যি বলতে এখনো মনে পড়ে ওই দুটি কথা। ‘থ্যাংক ইয়ু ম্যাথ, থ্যাংক ইয়ু স্টেফান অন বাংলাদেশ’.....।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম