খণ্ডিত ও পূর্ণ আনিসুর রহমান এবং তার সময়
প্রকাশ: ০৬ জানুয়ারি ২০২৫, ০৬:০৫ পিএম
অর্থনীতিবিদ, শিক্ষক, লেখক এবং রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী ও গবেষক অধ্যাপক ডক্টর আনিসুর রহমান মারা গেছেন। তার বয়স হয়েছিল একানব্বই বৎসর। সে হিশেবে তার মৃত্যুকে অকালমৃত্যু বলা যাবে না৷ তা'ছাড়া ১৯৯১ সালে দেশে ফিরে আসার পর থেকে অনেক কাল ধরে তিনি নিশ্চুপ ছিলেন। তাকে প্রকাশ্য কোনো তৎপরতা চালাতে দেখা যায়নি। ফলে নতুন প্রজন্মের কাছে তিনি অনেকটাই অচেনা। অনেকে তার নামও শোনেনি। অথচ একসময়ে তিনি দারুণ তৎপর ছিলেন। নানান রকমের ভূমিকা পালন করেছেন এবং অবদান রেখেছেন।
এমন একজন যশস্বী মানুষ মারা গেলে তার স্মৃতি, ভূমিকা ও অবদান আলোচনা করতে হয় যাতে নতুন প্রজন্ম তার সম্পর্কে জেনে উদ্বুদ্ধ হতে পারে। তবে আমাদের দেশ এক গুরুতর ইতিহাস বিকৃতির দেশ, মতলববাজির দেশে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এদেশে যত ইতিহাসকে বিকৃত করে বিকলাঙ্গ করা হয়, দুনিয়ার আর কোথাও তা' হয় না। আনিসুর রহমানের ভূমিকাও একই ভাবে বিকৃত আকারেই তুলে ধরা হয়।
তার সম্পর্কে আমরা যা' জানি তা' হলো : ষাটের দশকে পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে ব্যাপক অর্থনৈতিক বৈষম্য তুলে ধরতে যে কয়েকজন অর্থনীতিবিদ কাজ করেন, তাদের একজন ছিলেন তিনি। ১৯৬৬ সালের ছয় দফা ঘোষণাপত্র তৈরিতেও হার্ভার্ড স্কলার আনিসুর রহমান অন্যদের সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানকে সহায়তা করেন।
আনিসুর রহমান এবং তার পরিবার ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণহত্যার সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে নিহত হওয়ার হাত থেকে অল্পের জন্য রক্ষা পান।তিনি বন্ধুদের সহায়তায় ভারতে পালিয়ে যান এবং অমর্ত্য সেনের কাছে আশ্রয় নেন। অমর্ত্য সেন স্কুলে তার সহপাঠী ছিলেন। ভারতে তিনি মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করতে অবদান রাখেন। পরে আমেরিকায় যান বাংলাদেশের পক্ষে লবিং করতে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানে বিশ্বব্যাংকের সহায়তা বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তিনি।
স্বাধীনতার পর অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে গঠিত বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনে আনিসুর রহমান প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় সদস্য নিযুক্ত হন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন। অংশীদারি গবেষণা এবং আত্মনির্ভর অংশীদারি উন্নয়ন-দর্শন ও পদ্ধতিগত প্রশ্নে তার অবদান বিশ্বস্বীকৃত।
শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ ও গবেষক আনিসুর রহমান সমাজতন্ত্রী ছিলেন। রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী হিসেবে সম্পৃক্ত ছিলেন ছায়ানটের সঙ্গে। গবেষণার জন্য ১৯৭৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন তিনি। ১৯৯১ সালে দেশে ফিরে আসেন তিনি। এরপর অনেকটা অন্তরালেই ছিলেন।
তবে, আমরা তার সম্পর্কে যা' জানিনা বা যা' এদেশে প্রচার করা হয় না তা' হলো: পরিকল্পনা কমিশনে যুক্ত হয়ে তিনি কৃচ্ছতাসাধনের নীতি গ্রহনের পক্ষে ছিলেন। ক্ষমতাসীনদের বাই সাইকেলে চলাচলের পরামর্শ দিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তার মতভেদ হয়েছিল এবং অনেক শক্ত শক্ত কথা বলে তিনি পদত্যাগ করে শিক্ষকতায় ফিরে গিয়েছিলেন এবং এক পর্যায়ে বিদেশেই চলে যান গবেষণা কাজে। অনেক স্বপ্ন ও সম্ভাবনার বাংলাদেশ কীভাবে দুর্বৃত্তদের হাতে চলে যায়, তা নিয়ে তিনি বই লিখেছিলেন 'অপহৃত বাংলাদেশ' শিরোনামে। এদেশে কত নরাধম কত সম্মানে ভূষিত হয়েছে, কিন্তু আনিসুর রহমান স্বাধীনতা পুরস্কার বা একুশে পদক কিছুই পান নি।
১৯৭৪ সালের ১১ অক্টোবর মুজিব শাসিত বাংলাদেশে জাতীয় প্রেসক্লাবে দেশের শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবী ও সামাজিক ও অরাজনৈতিক সংগঠনের প্রতিনিধিদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সে সভায় ১ নভেম্বর বিকেলে বায়তুল মোকাররমে একটি গণজমায়েত অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তাছাড়া সে সভায় ‘মন্বন্তর প্রতিরোধ আন্দোলন’ নামে একটি বিবৃতিমূলক প্রচারপত্র বিতরণ করা হয়।
তারা বিবৃতিমূলক প্রচারপত্রে বলেছিলেন: ‘বাংলাদেশ আজ ভয়াল মন্বন্তর, সর্বগ্রাসী আকাল ও মহামারী এবং চরম জাতীয় দুর্যোগের কবলে নিপতিত। এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে যে, বাংলাদেশে বর্তমান খাদ্যাভাব ও অর্থনৈতিক সংকট অতীতের সবচাইতে জরুরী সংকটকেও দ্রুতগতিতে ছাড়িয়ে যাচ্ছে এবং ১৯৪৩ সালের সর্বগ্রাসী মন্বন্তরের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। …বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী দেশের বর্তমান সংকটকে ‘সাময়িক’ বলে অভিহিত করেছেন এবং দুর্ভিক্ষে রাজনীতিতে লিপ্ত না হবার জন্য বিরোধী দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর এই উক্তিতে কোনরকম দূরদর্শিতা ও বাস্তববোধের পরিচয় আছে বলে মনে করি না।….আমরা স্পষ্টভাবে বলতে চাই যে বাংলাদেশের বর্তমান মন্বন্তর মনুষ্য সৃষ্ট এবং উৎপাদন যন্ত্রের সাথে সম্পর্কবিহীন একশ্রেণীর মজুতদার, চোরাচালানী ও রাজনৈতিক সমর্থনপুষ্ট ব্যবসায়ীরাই এই মারি ও মন্বন্তর এর জন্য দায়ী। এককথায় বর্তমান শাসকগোষ্ঠী এই শ্রেণীরই প্রতিনিধি ও স্বার্থ রক্ষায় নিয়োজিত।…. গত তিন বছর ধরে একশ্রেণীর মানুষ নামধারী রাজনৈতিক ক্ষমতাবান অমানুষের নির্লজ্জ শোষণ, তস্করবৃত্তি, সন্ত্রাসবাদ, চাটুকারিতা, প্রতারণা ও দুঃশাসনের যে প্রতিযোগিতা চলছে, তারই ফল বর্তমান মন্বন্তর। এক কথায় বাংলাদেশের বর্তমান দুর্ভিক্ষ ও অর্থনৈতিক সংকট গত তিন বছরের লুটেরা শাসন, শোষণ ও অর্থনৈতিক নিষ্পেষণেই ফল।…”
এই বিবৃতিমূলক প্রচারপত্রে ৮২ জন ব্যক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন সিকান্দার আবু জাফর, সভাপতি, নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ কমিটি, ড. আনিসুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, আইনজীবী মির্জা গোলাম হাফিজ, ভাষা সৈনিক গাজীউল হক, মহিলা সংসদ সদস্যা কামরুন্নাহার লাইলী, মহিউদ্দিন খান আলমগীর, সভাপতি বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, গিয়াস কামাল চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক বাংলাদেশ সাংবাদিক ইউনিয়ন, ব্যারিষ্টার মওদুদ আহমদ, সম্পাদক নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ কমিটি, আমেনা বেগম, মহিলা সংসদ সদস্যা, ওয়াহিদুল হক, সাংবাদিক, এনায়েত উল্লাহ খান, সভাপতি জাতীয় প্রেস ক্লাব, ড. সাঈদ উর রহমান বাংলাদেশ লেখক শিবির, ফয়েজ আহমদ, নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ কমিটি, অধ্যক্ষ এ.এম. মোঃ ইছহাক, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, আহমদ ছফা, বাংলাদেশ সংস্কৃতি শিবির, আবুল কাসেম ফজলুল হক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বিনোদ দাশগুপ্ত, সাংবাদিক, সৈয়দ জাহাঙ্গীর, চিত্রশিল্পী, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মিয়া, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, আনোয়ার জাহিদ, সাংবাদিক এবং বদরুদ্দীন ওমর, সম্পাদক সংস্কৃতি প্রমুখ।
এই ভূমিকার কথা বাদ দিয়ে আনিসুর রহমানের সময় এবং তার ভূমিকাকে বুঝা যাবে না। তার অবদান জানতে হলে সম্পূর্ণ আনিসুর রহমানকেই জানতে হবে, তাকে খণ্ডিত করে নয়।▪️
মারুফ কামাল খান : সিনিয়র সাংবাদিক ও লেখক
ই-মেইল: mrfshl@gmail.com