Logo
Logo
×

দৃষ্টিপাত

শিশুর শৈশব সুন্দর করতে আমাদের করণীয়

Icon

ডা. আহমাদ হাবিবুর রহিম

প্রকাশ: ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৬:২০ পিএম

শিশুর শৈশব সুন্দর করতে আমাদের করণীয়

শিশুর শৈশব তার জীবনের সবচেয়ে রঙিন এবং গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। এটি এমন সময়, যখন চারপাশের পৃথিবীকে জানার এবং শেখার আগ্রহ শিশুদের মাঝে তুঙ্গে থাকে। কিন্তু আধুনিক জীবনের জটিলতা, প্রযুক্তির প্রসার এবং পারিবারিক কাঠামোর পরিবর্তনের কারণে সেই শৈশব আজ ভার্চুয়াল জগতে বন্দি হয়ে পড়েছে। মা-বাবার কর্মব্যস্ততা, যৌথ পরিবারের অভাব এবং বয়স্ক অভিভাবকদের সীমিত সক্ষমতার জন্য অধিকাংশ শিশুর শৈশব কাটছে মোবাইল স্ক্রিনের পেছনে, যা তাদের মানসিক এবং সামাজিক বিকাশের ক্ষেত্রে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

যুগের প্রয়োজন মেটাতে আজ বেশিরভাগ পরিবার নিউক্লিয়ার কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ। বাবা-মা দুজনেই চাকরি করলে সন্তান দিনের দীর্ঘ সময় একা বা গৃহপরিচারিকার তত্ত্বাবধানে থাকতে বাধ্য হয়। অনেক ক্ষেত্রে দাদা-দাদি কিংবা নানা-নানী শিশুর যত্ন নেন, তবে তাদের শারীরিক এবং মানসিক সামর্থ্য সবসময় শিশুর এনার্জি সামলানোর উপযুক্ত হয় না। এই পরিস্থিতিতে, স্বস্তির সহজ সমাধান হিসেবে শিশুর হাতে মোবাইল ফোন তুলে দেওয়া হয়। কার্টুন দেখা আর গেম খেলা হয়ে ওঠে শিশুর একমাত্র বিনোদন।

শিশুরা যখন ঘরের মধ্যে চার দেয়ালের ভেতর বন্দি হয়ে বড় হতে থাকে, তখন তারা বাস্তব জগতের কৌতূহল হারাতে শুরু করে। একসময়ের প্রাণোচ্ছল খেলা, গল্প বলার আসর, বা বাড়ির উঠোনে ছুটোছুটির জায়গা এখন দখল করেছে ডিজিটাল ডিভাইস। ফলে, শিশুর সামাজিক যোগাযোগ, সৃজনশীলতা, এবং মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইমের কারণে অনেক শিশুর ক্ষেত্রে স্থূলতা, মনোযোগের ঘাটতি, ঘুমের সমস্যা, এবং মানসিক অবসাদ দেখা দেয়। অনেক সময় নতুন মানুষের সঙ্গে খুব বেশি যোগাযোগ বা মিথষ্ক্রিয়ার অভাবে শিশুরা পরবর্তী জীবনেও ঘরকুনো বা নিজের চারপাশে শক্ত এক অদৃশ্য দেয়াল তৈরি করে ফেলে।

সমস্যাগুলোর সমাধান অনেকাংশেই সম্ভব, যদি আমরা সচেতন হই এবং সময়মতো প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করি। আমাদের এ বাস্তবতা স্বীকার করতেই হবে যে পুরোটুকু আমরা করতে পারবো না। সব কিছু ছবির মতো সুন্দর করে সমাধান হয়ে যাবে না। নতুন পরিবার ব্যবস্থা, সভ্যতার নতুন ধারা আমরা চাইলেই হঠাৎ করে বদলে দিতে পারবো না। তবে সাধ্যের মধ্যে যেই কাজগুলো সেগুলো যদি আমরা সচেতনভাবে অনুসরণ করি এবং সক্রিয়ভাবে এ কাজে লেগে থাকি তাহলে এটি অনেকটাই উপকারী হবে যথাযথভাবে শিশু লালন পালনে।

প্রথমত, শিশুদের জন্য একটি নির্দিষ্ট ডিজিটাল ডিটক্স রুটিন তৈরি করা জরুরি। এটি হতে পারে একটি সময়সূচি যেখানে মোবাইল ব্যবহারের সময় নির্দিষ্ট করে দেওয়া হবে। সপ্তাহে নির্দিষ্ট কিছুদিন বা নির্দিষ্ট ঘন্টা শিশুদের স্ক্রিন থেকে দূরে রাখা যেতে পারে। বিকল্প বিনোদন হিসেবে বই পড়া, ছবি আঁকা, মিউজিক শেখা, বা নতুন কোনো শখ চর্চার সুযোগ করে দিতে হবে।

শিশুর বিকাশে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে পারিবারিক সংযোগ। কর্মব্যস্ততার কারণে মা-বাবা যত কম সময়ই পান না কেন, সেই সময়টুকু পুরোপুরি সন্তানের জন্য উৎসর্গ করতে হবে। একসঙ্গে গল্প পড়া, ঘরের কাজ শেখানো, ঘর সাজানো বা একসঙ্গে রান্না করা হতে পারে সৃজনশীল এবং আনন্দদায়ক কার্যক্রম। এতে শিশুর মধ্যে দায়িত্ববোধ, সৃজনশীলতা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ গড়ে ওঠে।

সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলো হতে পারে পরিবারের জন্য বিশেষ দিন। পরিবারের সবাই মিলে কোনো পার্কে বেড়াতে যাওয়া, প্রকৃতির মাঝে কিছু সময় কাটানো, নদীর পাড়ে পিকনিক করা বা গ্রামের বাড়িতে ঘুরতে যাওয়া শিশুর মনে স্থায়ী স্মৃতি তৈরি করবে। বাস্তব জীবনের এই অভিজ্ঞতাগুলো ভার্চুয়াল জগতের কল্পনার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী এবং দীর্ঘস্থায়ী।

একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আমরা প্রায়শই ভুলে যাই শিশুরা যা দেখে, তাই শিখে। তাই অভিভাবকদের নিজেদেরকেও মোবাইল ফোন ব্যবহারে সংযমী হতে হবে। শিশুর সামনে যতটা সম্ভব মোবাইল ব্যবহার এড়িয়ে গঠনমূলক কর্মকাণ্ডে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে হবে। এতে শিশু সহজেই ইতিবাচক অভ্যাস গড়ে তুলবে।

শিশুর মানসিক, সামাজিক এবং শারীরিক বিকাশের জন্য সময় এবং মনোযোগের বিকল্প নেই। প্রযুক্তি যেমন আমাদের জীবনের অপরিহার্য অংশ, ঠিক তেমনই মানবিক যোগাযোগ, পারিবারিক ভালোবাসা এবং বাস্তবিক অভিজ্ঞতা শিশুর জন্য সবচেয়ে জরুরি। দায়িত্বশীল অভিভাবক হিসেবে আমাদের উচিত সচেতনভাবে একটি সুন্দর, ইতিবাচক এবং প্রযুক্তি-সন্তুলিত শৈশব নিশ্চিত করা।

একটি সুস্থ এবং প্রাণবন্ত শৈশব গড়ে তুলতে প্রয়োজন পরিবারের সক্রিয় অংশগ্রহণ, ভালোবাসা, এবং সময়ের সঠিক ব্যবহার। একটি সুখী, পরিপূর্ণ এবং সৃজনশীল জীবনের বীজ শিশুর শৈশবেই বপন করতে হবে, যেখানে ভার্চুয়াল স্ক্রিন নয়, বরং বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা, কল্পনা, এবং ভালোবাসার গল্পগুলো প্রধান ভূমিকা পালন করবে। এটাই আমাদের নতুন দিনের প্রত্যাশা।


লেখক: নবজাতক শিশু বিশেষজ্ঞ

habiburrahim2010@gmail.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম