১৬ ডিসেম্বর প্রতিবছর ভারত ‘বিজয় দিবস’ হিসাবে পালন করে আসছে। তবে সোশ্যাল মিডিয়ার সুবাদে এবার সে খবর বাংলাদেশের ঘরে ঘরে পৌঁছে গিয়েছে। এছাড়া এ উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদি তার এক্স হ্যান্ডেলে যে বার্তা দিয়েছেন তাতে আমাদের দেশপ্রেমিক নাগরিকেরা ক্ষুব্ধ হয়েছেন। কারণ মোদির বার্তায় ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়কে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের বিজয় বলে উল্লেখ করেছেন। এ বার্তায় বাংলাদেশ ও মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো উল্লেখই নেই।
ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর ইস্টার্ন কমাণ্ড ১৯৭২ সাল থেকেই জাঁকজমকের সঙ্গে বিজয় দিবস (তাদের ভাষায় 'ভিজায় দিওয়াস') উদযাপন করে থাকে। তবে ভারতের এই উদযাপনে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদেরকেও আমন্ত্রণ করার চল ছিল। তাতে বিজয়ের একটা যৌথ মালিকানার আভাস থাকতো। এবার মোদি বাবু বিজয়ের কৃতিত্ব পুরোই আত্মসাতের অপচেষ্টা করলেন। এটা সত্যের অপালাপ এবং ইতিহাসের বিকৃতি।
ভারতীয় বাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ড ও বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী একই দিনে একই নামে দিবস উদযাপন করায় এ দেশে অনেকেই আত্মগ্লানিতে ভুগতে থাকেন। সে কারণে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে আসার পর কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ছাড়াই সশস্ত্র বাহিনীর কুচকাওয়াজ ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস থেকে সরিয়ে ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে আয়োজনের ব্যবস্থা করেন। তিনি ১৬ ডিসেম্বর শিশু-কিশোরদের কুচকাওয়াজের আয়োজন করতেন। সেই থেকে সশস্ত্র বাহিনীর কুচকাওয়াজ বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চে এবং আওয়ামী লীগ বা তাদের অনুগামীরা ক্ষমতায় থাকলে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে হয়ে থাকে। এর জন্য আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা দেওয়া হয় না।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আমাদের মুক্তিযুদ্ধ লড়েছে মুক্তিযোদ্ধারাই। ভারত আশ্রয়, খাদ্য, প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রের যোগান দিতো। যুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা যখন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে তখন পাকিস্তান ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর ভারতের ওপর আক্রমণ চালায়। তাদের এই আক্রমণ অভিযানের নাম ছিল 'অপারেশন চেঙ্গিজ খান।' পূর্ব রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে চরম নাস্তানাবুদ অবস্থায় পাকিস্তানীরা কেন ভারতের ওপর আক্রমণ চালাবার এমন হঠকারি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল? পরবর্তীতে বিভিন্ন রেকর্ড যাচাই করে দেখা যায় পাকিস্তানি সমরনায়কেরা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে শোচনীয় পরাজয়কে বেশি অসম্মানজনক বলে মনে করতো। তাই তারা নিশ্চিত পরাজয়ের মুখে একটি যুদ্ধবিরতির লক্ষ্য নিয়ে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করে ফলে ভারত যুদ্ধে জড়িয়ে যায় এবং একটি দ্বিপক্ষীয় যুদ্ধ পরিণত হয় ত্রিপক্ষীয় যুদ্ধে।
চূড়ান্ত পর্বে ভারত জড়িত না হলেও মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিজয় অবধারিত হয়ে উঠেছিল। সব ধরনের সরবরাহ থেকে বিচ্ছিন্ন এবং ৯০ শতাংশের বেশি স্থানীয় অধিবাসীদের বৈরিতার পরিবেশে পাক হানাদার আর কয়েক মাসের মধ্যেই মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণে বাধ্য হতো। ভারত এ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর মিত্রশক্তি হিসেবে যোগ দেওয়ায় বিজয় ত্বরান্বিত হয়। তবে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় বাহিনীর কাছে যৌথভাবে হতে দেয় নি ভারত। আত্মসমর্পণের দলিলটিতে বিজয়ের অধিনায়ক হিসেবে সই করেন ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সেনাধ্যক্ষ জগজিৎ সিং অরোরা। সারেন্ডার টেবিলে মুক্তিযুদ্ধের কোনো অধিনায়ককে বসার সুযোগও দেওয়া হয়নি।
পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর ভারত সব বন্দিকেই নিয়ে যায় তাদের অস্ত্র, গোলাবারুদ, রসদ ও মালামালসহ। এই সব মালামালের কোনো ভাগ বাংলাদেশ পায়নি। আত্মসমর্পণের দলিলের একটা কপিও বাংলাদেশকে দেওয়া হয় নি। আর এরপর ১৯৭২ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে সিমলা চুক্তি সই করে ভারত আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তানী সৈনিক ও অফিসারদেরকে মুক্তি দেয়। এ চুক্তিতে বাংলাদেশকে অংশীদার করা দূরে থাকুক, মতামত পর্যন্ত নেওয়া হয় নি। এসব ঘটনায় প্রমাণ হয় ভারত সেই গোড়া থেকেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের যুদ্ধ হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করে আসছে। তারা প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে যে, এই বাংলাদেশটা মূলতঃ ভারতের দয়ার দান।
এই কৃপানির্ভর অবস্থান থেকে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সৈনিক-জনতার ঐতিহাসিক বিপ্লব ও সংহতির মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশ সার্বভৌমত্ব অর্জন করে। খুবই বেদনাবহ সত্য হচ্ছে সশস্ত্রবাহিনীর আত্মবিক্রিত নেতৃত্বের হাত ধরেই সেই সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে যায় ২০০৭ সালে। তারপরের অধ্যায় ছিল হাসিনার পুতুল নাচের ইতিকথা। এই সার্বভৌমত্ব ফেরাবার রাজনৈতিক আন্দোলনে দেড় যুগ ধরে এদেশের মাটি রক্তসিক্ত হলেও বিজয় আসেনি। বিজয় এলো 'চব্বিশের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে। সেই অভ্যুত্থানে স্থাপিত অন্তর্বর্তী সরকার এখন বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব পুনরাধিষ্ঠানের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। তবে নাচের পুতুলেরা এখনো ইতিউতি নেচেই চলেছে। এ অবস্থায় অন্তর্বর্তী সরকার পারবে কি? সফল হবে কি তারা? এ প্রশ্নের জবাব নির্ভর করছে দেশের জনতা ও সৈনিকদের সংহতি ও ঐক্যের ওপর।
লেখক: মারুফ কামাল খান
সিনিয়র সাংবাদিক ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সাবেক প্রেস সচিব।