শিশুদের জীবনের নিরাপত্তা এবং প্রাসঙ্গিক ভাবনা
শিশু দিবস
প্রকাশ: ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৪৫ পিএম
গত এক বছরে গাজায় যত শিশুর প্রাণহানি হয়েছে তা উদ্বেগজনক। ইসরাইল–ফিলিস্তিন সংঘাত মধ্যপ্রাচ্যে একটি পুরানো সমস্যা। হামাসকে নির্মূল করার জন্য ৭অক্টোবর ২০২৩ থেকে নতুন করে সর্বান্তকরণে ফিলিস্তিনের গাজায় হামলা চালাচ্ছে ইসরাইল। নির্বিচারে চলছে হত্যাযজ্ঞ। অনেকেই বলছেন, যে পরিমাণ বোমা হামলা ইসরাইল গাজায় চালিয়েছে ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর তা আর দেখা যায় নি।
এই মুহূর্তে ফিলিস্তিনের গাজাকে সারা বিশ্বে মানবাধিকার বিপর্যয়ের একমাত্র প্রাণকেন্দ্র বললে ভুল হবে না এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী বললে কম হয়ে যায় আগ্রাসী শক্তি ইসরাইলকে। এই পর্যন্ত তারা হত্যা করেছে পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি সামরিক-বেসামরিক জনগণ যার মধ্যে ৭০% নারী ও শিশু। শিশু হাসপাতাল, স্কুল-কলেজ, শরণার্থী ক্যাম্প কোথায় নিরাপদ গাজার শিশুগুলো? সম্ভবত গাজাই একমাত্র জনপদ যেখানে মাতৃগর্ভে লুকিয়ে থাকা শিশুও রেহাই পাচ্ছে না গণহত্যা থেকে। বোমা পড়ছে, মানুষ মরছে নির্বিচারে। মায়ের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে মায়েরই গর্ভে মরছে শিশু। জন্মাবার সুযোগ পেলেও বোমা হামলায় মরছে নিরাপদ আশ্রয়গুলোতে।
ইসরাইলি আগ্রাসনে ফিলিস্তিনি শিশুদের ভাগ্য নির্বিকার হলেও ক্যালন্ডারের হিসাব চলমান। ২০ নভেম্বর চলে গেল সর্বজনীন শিশু দিবস বা বিশ্ব শিশু দিবস। ১৯৮৯ সালের এই দিনে বিশ্বের বহু রাষ্ট্রের প্রচেষ্টায় জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে শিশু অধিকার কনভেনশন ( সিআরসি) গৃহীত হয়; যার উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বজুড়ে সব শিশুর সব রকম অধিকারের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। এই কনভেনশনে আঠারো বছরের নিচের বয়সি যেকোনো মানুষকে শিশু বলে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।
শিশু অধিকারকে সম্মান করে ভিন্ন ভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন তারিখে শিশু দিবস পালিত হলেও ১৯৫৯ সালের ২০ নভেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ কর্তৃক গৃহীত শিশু অধিকার ঘোষণাকে স্মরণীয় করে রাখতেই ২০ নভেম্বর আন্তর্জাতিক শিশু দিবস পালন করা হয়। যে দাবিটি সর্বপ্রথম ১৯২৫ সালে জেনেভাতে শিশু কল্যাণ বিষয়ক কনফারেন্স চলাকালে উত্থাপিত হয়।
২০ নভেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্র আমেরিকা ছাড়া পৃথিবীর ১৯৬ টি রাষ্ট্র এই কনভেনশন র্যাটিফাই করেছে । চুক্তি স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রসমূহ আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে শিশু অধিকার সুরক্ষায় কাজ করে যেতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। চুক্তির কোন রকম বিচ্যুতি আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন বলে পরিগণিত হওয়ার কথা বলা আছে। পরিতাপের বিষয়, এই চুক্তি স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রগুলো শিশুর সব রকম স্বার্থ সুরক্ষায় এক থাকার ঘোষণা দিলেও বাস্তবে বিশ্বজুড়ে বিশেষ করে গাজায় ইসরাইলি বর্বরতা চলাকালে পুরো বিশ্ব সিআরসি সাক্ষর করেও সোচ্চার হতে পারেনি।
কেন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ফিলিস্তিনের শিশুদের জীবনের অধিকার বা বেঁচে থাকার অধিকারের (রাইট টু লাইফ) সুরক্ষা দিতে পারে নি-সেই প্রশ্ন সবার মুখে ঘুরে ফিরে এবং আমাকেও সমভাবে আহত করে।
উল্লেখ্য গাজায় ফেলা বোমাগুলো তৈরিকারী এবং সরবরাহকারী রাষ্ট্র ইসরাইলি মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সি আর সি চুক্তির অংশ না হলেও নির্বিচারে নিরীহ শিশুদের উপর গনহত্যা পরিচালনাকারী ইসরাইল ১৯৯১ সালে সি আর সি র্যাটিফাই করেছে। ২০১০ সালে ইউনিসেফ শিশু অধিকার সুরক্ষায় রাষ্ট্রটিতে কমতি পেয়ে এর সমালোচনা করেছিল। ২০১২ সালে সিআরসি কমিটি ফিলিস্তিনে ইসরাইলি আক্রমণে ইসরাইল কর্তৃক শিশুর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে কঠোর সমালোচনা করেছিল ।
ব্যস, এইটুকুই যথেষ্ট? এই বিশ্বের একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে আমি মর্মাহত আজ। পৃথিবীকে আমরা শিশুর জীবনের জন্য নিরাপদ রাখতে পারিনি। ফিলিস্তিনের গাজায় ৭ অক্টোব্র ২০২৩ থেকে শুরু হওয়া ইসরাইলী হামলায় প্রাণ হারিয়েছে সতের হাজার শিশু । দিনে ৪২ জন শিশু হত্যার শিকার হয়েছে। অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে আজকের দিনে জন্ম নেওয়া শিশুটিও। প্রতি ত্রিশ মিনিটেই মরছে একটি করে শিশু। ইসরাইলি বর্বরতা অবরুদ্ধ গাজাকে পরিণত করেছে একটি কবরস্থানে। যারা এখনও বেঁচে আছে সেসব সন্তানের জন্য কোনো বর্তমান, কোনো ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছেন না অভিভাবকেরা। গাজার প্রতিটি স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে ৬ মাসের বেশি সময় ধরে যেখানে সাড়ে ছয় লাখ শিশু পড়তে যেত। অধিকাংশই এখন মৃত্যু ভয়ে দিন গুনছে, একটা অংশ কবরস্থানে শায়িত।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘন করে ইসরাইল হামলা চালিয়েছে ছোট ছোট শিশুদের স্কুলে। যে বাবা-মা না খেয়ে তাদের শিশুদের বাঁচিয়ে রাখছেন তাদের আশংকা এই ভয়াবহ ট্রমা নিয়ে শিশুগুলো আসলেই কতখানি সারভাইভ করতে পারবে। পড়তে ফিরে যাবার মত কোন স্কুল তাদের অবশিষ্ট নেই। বোমার বজ্রপাত, বুলেটের ঝনঝনানি এখন তাদের নিত্য ঘুমানো এবং জেগে উঠার সুর ।
যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশগুলোতে শিশুরা ভালো নেই । গাজায় কিংবা ইউক্রেনে শিশুরা মৃত্যুর জন্য অপেক্ষামান। কেউ গুলি কিংবা বোমার আঘাতে চিরতরে স্তব্ধ হয়ে গেছে । কেউ কেউ বেঁচে থেকে খাবার , বিশুদ্ধ পানি, চিকিৎসা , থাকার মত নিরাপদ আশ্রয় এসবের অভাবে মৃত্যুর মত দিন যাপন করছে। শিক্ষা তো এই মুহূর্তে ইউটোপিয়া বা অলীক বস্তু।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সি আর সি র মত দলিলের কাছে দায়বদ্ধ থাকলেও গাজা কিংবা ইউক্রেনে নিষ্পাপ শিশুদের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছে । শিশু অধিকার কনভেনশন অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিশ্বের প্রত্যেক শিশুর সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষাগত, রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক অধিকার, এমনকি মানবাধিকার পর্যন্ত সমুন্নত রাখার কথা বলেছে । বলেছে শিশুর মতামত প্রকাশের অধিকারের কথা ।
এই আন্তর্জাতিক শিশু সনদ শিশুদের জন্য খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও বিশুদ্ধ পানির মতো প্রয়োজনীয় জিনিসের নিশ্চয়তা দেবার কথা বলে । এখানে আরো উল্লেখ আছে , যে কোনো ধরনের অত্যাচার, শোষণ কিংবা শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি থেকে সুরক্ষার বিষয়টিও শিশু অধিকারের অন্তর্ভুক্ত। যে কোনো ধরনের বৈষম্য থেকে শিশুরা যাতে সুরক্ষা পায় , শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থকে যাতে অগ্রাধিকার দেওয়া হয় , শিশুদের জীবনমানের উন্নয়নের পাশাপাশি তাদের বিকাশ ও বেঁচে থাকার অধিকার নিশ্চিত করা প্রসঙ্গে জাতিগুলো ঐক্যমত পোষণ করেছে এই শিশু অধিকার সনদে স্বাক্ষরের মাধ্যমে ।
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আমাদের ভাবা উচিত শিশু অধিকার কনভেনশন অনুযায়ী শিশুর অধিকার নিশ্চিত আদৌ হয়েছে কিনা। ১৯২৫ থেকে ২০২৪ এসে আমরা দেখতে পাই , শিশুসুরক্ষার খসড়া নথি লিগ অব নেশনস কর্তৃক গৃহীত হওয়ার ১০০ বছর পর শিশুদের সম্পূর্ণরূপে সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। বিশেষ করে, যুদ্ধের সময় শিশুদের যেভাবে হত্যার শিকার হতে হয় এবং অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়ে যেতে দেখা যায়, তাতে করে শিশুসুরক্ষার বিষয়টি সম্পূর্ণ উপেক্ষিত বললে যথার্থই বলা হয় ।
জাতিসংঘ মহাসচিব এন্টোনিও গুতেরেসের মত আমিও বলতে চাই পৃথিবীতে যদি কোন নরক থাকে তবে তা হল আজ ফিলিস্তিনি শিশুদের জন্য গাজা উপত্যকা। শিশুদের এই নরক থেকে বের করে আনার দায়িত্ব অনেক আগেই নিয়েছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় । এখনই সময় তাদের কথা বলার। অবিলম্বে ফিলিস্তিনে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধবিরতি প্রয়োজন । প্রয়োজন ইসরাইল- ফিলিস্তিন যুদ্ধের বাস্তবসম্মত স্থায়ী সমাধান। নাহলে বারংবার যুদ্ধের পুনরাবৃত্তি ঘটে যাবে এবং ভূলুণ্ঠিত হবে মানুষের অধিকার। নিষ্পাপ শিশুরা শিকার হবে গনহত্যার । পৃথিবীর ইতিহাস থেকে শিশু হত্যার নজির মুছে ফেলার এটাই বোধহয় মোক্ষম সময় । চাই আন্তর্জাতিক আইনে মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত করার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি।
দিবস পালন করে, সভা-সেমিনার করে উদাযাপনের চাইতে আমাদের উচিত কিভাবে শিশুদের জন্য যুদ্ধমুক্ত পৃথিবী গড়ে তোলা যায় সেই পথ খুঁজে বের করার চেষ্টা করা। কারণ যুদ্ধে বেঁচে যাওয়া শিশুগুলো ভয়াবহ স্মৃতি দিয়ে অভিশপ্ত জীবন বয়ে বেড়াবে । আমাদের উচিত তাদের মানসিক সাস্থ্যের কথা চিন্তা করা যাতে এই ট্রমা থেকে তারা কিছুটা হলেও প্রশান্তি লাভ করে । পৃথিবীর প্রয়োজন বিশ্ব মোড়লদের তড়িৎ নিরপেক্ষ অবস্থান যা হয়তবা আসলেই ইউটোপিয়া। কিন্তু নিষ্পাপ শিশুগুলোকে বাঁচাতে এরচেয়ে কঠোর কী পদক্ষেপ জাতিসংঘ নিতে পারে সেটাই দেখার বিষয় ।
লেখক: শিক্ষক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।