Logo
Logo
×

দৃষ্টিপাত

বরেন্দ্র জনপদে আইন ও নীতিমালা কি পানি বৈষম্য বাড়াচ্ছে?

Icon

মো. শহিদুল ইসলাম

প্রকাশ: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭:২৮ পিএম

বরেন্দ্র জনপদে আইন ও নীতিমালা কি পানি বৈষম্য বাড়াচ্ছে?

বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির সংকট দূরীকরণের দাবিতে মানবন্ধন, পুরনো ছবি। ইনসেটে লেখক

০১. পানি রাজনীতি, কৃষক আদিবাসী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পানির অধিকারহীনতাসহ পানি নিয়ে নয়া বাণিজ্যের নতুন এক ক্ষেত্র হিসেবে বরেন্দ্র অঞ্চল এখন বলা যায় হটস্পট। বরেন্দ্র অঞ্চলের পানি ব্যবস্থাপনাসহ পানি আইন ও নীতিমালাগুলোও বরেন্দ্র জনতার সাথে প্রহসন করছে বলা যায়। আইন নীতিমালা প্রণয়নের সময় যদি জনগণের মতামত এবং তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার দিকগুলো গুরুত্ব দেয়া না হয়, তা কখনোই জনমানুষের জন্য কল্যাণ বয়ে আনতে পারেনা। বিশেষ করে আইন প্রণয়নে নাগরিকের মৌলিক অধিকার যাতে হরণ না হয় সেই দিকগুলো সংবিধানে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। 

পরিবেশ সুরক্ষা, সম্পদের ব্যবহার, অধিকার প্রাপ্যতার দিক থেকে যখন একটি আইন প্রণয়ণ করতে হয় তখন একটি দেশের নানা ভৌগোলিক বৈচিত্র্য এবং আলাদা আলাদা অঞ্চলের সম্পদের বহুমাত্রিকতার দিকগুলোও সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। একদিকে আমাদের মন-মননে উপনিবেশিকতার লোলুপ দৃষ্টিভঙ্গি আবার অন্যদিকে নয়া নয়া সব নীতিমালা, আইন তৈরির মাধ্যমে কোনো একটি সুবিধাভোগী গোষ্ঠীকেই ভোগ করার সকল কৌশল পথ আরো সুপ্রসন্ন করে দেবার বিষয়টিও দেখা যায়। স্থানীয় মানুষের জন্য কোনো আইন নীতিমালা তৈরিতে তাই সব থেকে বিশেষজ্ঞ হবার কথা সেই স্থানীয় মানুষগুলোই। কিন্তু আমরা নীতিমালা আইন তৈরিতে সেই এখনো উপনিবেশবাদের পদ্ধতির মধ্যেই পড়ে আছি। যা সৃষ্টি হয়েছিলো নিম্নগোত্রের মানুষকে শোষণ করার জন্যই। এই ধারা এখনো চলমান থাকলে কতোটা স্বস্তি, শান্তি, সমতার পরিবেশ আশা করি আমরা?

আমরা লক্ষ্য করছি, বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষক, আদিবাসী ও প্রান্তিক মানুষ আইন নীতিমালার ঘোর টোপে এক নয়া উপনিবেশবাদের শিকার হচ্ছে। আমরা যাকে বরেন্দ্র অঞ্চল বলি সেটি বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের সন্নিহিত জনপদগুলোর মধ্যে আলাদা ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ একটি অঞ্চল। দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলের প্রায় ২২টি জেলার সমন্বয়ে একটি বৃহৎ অর্থনৈতিক অঞ্চলটি বরাবরই নানাদিক থেকেই জনবান্ধব নীতিমালা গ্রহণ না করে ইচ্ছামতো উপর থেকে চাপিয়ে দেয়া নীতিমালা তৈরি হয়েছে, যাতে এই জনপদকে অবহেলা করা হয়েছে। 

প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ এবং বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, এই অঞ্চলটি মারাত্মক খরাপ্রবণ। বিশেষ করে রাজশাহী, নওগাঁ, দিনাজপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁ জেলাগুলো মারাত্মক খরার ঝুঁকিতে আছে। বহু সংস্কৃতি ও বৈচিত্র্য বৈভবে ভরপুর বরেন্দ্র অঞ্চলটি। অর্থনৈতিকভাবে গোটা বাংলাদেশের মধ্যে অন্যতম প্রভাব বিস্তারকারী একটি অঞ্চল। আর্থিক বিচারেও যার অবদান অনন্য। সেই অঞ্চলটির জন্য এখনো কোনো সুনিদিষ্ট পরিকল্পনা এবং কোনো নীতিমালা বা আইন তৈরি হলো না। যা হয়েছে তা কখনোই স্থানীয় মানুষগুলোকে সাথে করে এবং তাদের যুক্ত করে করা হয়নি। এই এলাকার উন্নয়নে সেই ঐতিহাসিক পরিক্রমা এবং বৈচিত্র্যের ইতিহাসকে সামনে রেখেই আগামীর উন্নয়ন রচনার উদ্যোগ নিতে হবে। বিশেষ করে পানিকে কেন্দ্র করেই এখানে অনেক ধরনের সম্ভাবনা যেমন আছে তেমনি দিনে দিনে পানিকে কেন্দ্র করেই সংকট এবং সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। একটি সমতা এবং বৈষম্যহীন পানি নীতি আইন ছাড়া এবং তা অবশ্যই কৃষক ও জনবান্ধব না হলে এই সংকট বাড়তেই থাকবে।

পানিকে কেন্দ্র করেই এই জনপদে দিনে দিনে সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২২ সালের রাজশাহীর গোদাগাড়ি উপজেলার নিমঘটু গ্রামের দুই আদিবাসী কৃষক অভিনাথ মার্ডি ও রবি মার্ডি তাদের ধানক্ষেতে পানি না পেয়ে কীটনাশক খেয়ে আতœহত্যা করেন। যা সেই সময় ডিপ অপারেটরের বিরুদ্ধে আত্মহত্যার প্ররোচোনায় মামলাও হয়। জুলাই ২০২৪ এর গণঅভ্যুথানের পরবর্তীতে বরেন্দ্র ডিপগুলোর ব্যবস্থাপনা, ডিপ অপারেটরের দাবিতে আবার দেখা দেয় আরেক সংকট। একটি শ্রেণী ডিপের অপারেটর হতে বরেন্দ্র অফিসগুলোতে প্রভাব বিস্তার শুরু করে। এ সময়ে ডিপ অপারেটরের পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে নানা সহিংসতার দিকগুলো দেখা দেয় বরেন্দ্র অঞ্চলে।  ডিপ অপারেটরের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় কৃষকদের মতামত ও গুরুত্ব না থাকায় এই ধরনের সংকটগুলো তৈরি হয়। কৃষক চায় তাদের ডিপগুলো তাদের কৃষক সমিতির মাধ্যমে পরিচালনা করবেন। তারাই নিজেরা ডিপ অপারেটর ঠিক করবেন। কি ফসল ফলাবেন সেটাও তারা ঠিক করবেন। কিন্তু কিছু নীতিমালা এবং আইনের কারণে সেই সুযোগ স্থানীয় কৃষকরা পায় না। তাই এই সহিংসতার পিছনে পানি কেন্দ্রিক আইন নীতিমালাগুলোও কম দায়ী নয়। 

আইন, নীতিমালাগুলোর ফাঁক-ফোকর দুর্বলতার কারণে এই জনপদের মানুষগুলো পানি অধিকার থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। বরেন্দ্র অঞ্চলকে কেন্দ্র করে, পানি ব্যবস্থাপনা এবং কৃষিকে কেন্দ্র করে আলাদা একটি কর্তৃপক্ষও গঠন হয়েছে। এই কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে নানামুখী উন্নয়ন সাধিত হলেও পানি বৈষম্য বেড়েছে বহুগুণে। যা এই অঞ্চলকে, জনপদকে দিনে দিনে বহুমাত্রিক সংকটের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আর এর পিছনে আইন, নীতিমালাগুলোও অনেকাংশে যেমন দায়ী তেমনি স্থানীয় বৈষম্যমূলক পানি রাজনীতিও দায়ী।  

০২. বাংলাদেশ সরকারের একটি রেজুলেশনের মাধ্যমে ১৯৯২ সালে তৎকালীন রাজশাহী বিভাগের রাজশাহী, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় মূলত কৃষিভিত্তিক উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আইন, ২০১৮ (২০১৮ সালের ৩৬ নং আইন) প্রণীত হয়। এতে বলা হয়, বরেন্দ্র এলাকার সার্বিক উন্নয়ন এবং তদসংশ্লিষ্ট বিষয়াদি সম্পর্কে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নসহ আনুষঙ্গিক অন্যান্য কার্য সম্পন্ন করিবার লক্ষ্যে আইনটি কার্যকর ভূমিকা রাখবে। আইনটি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সম্পূর্ণ আইনজুড়ে শুধু এক শ্রেণির মানুষের সংশ্লিষ্টতা। এখানে যাদের জন্য উন্নয়ন, উন্নয়নে যাদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ সেই মানুষগুলোর অংশগ্রহণ এবং মতামত দেবার আইনি কোনো স্থানই দেয়া হয়নি। কৃষক, আদিবাসী প্রতিনিধিসহ নেই কোনো জনগোষ্ঠীর কার্যকর অংশগ্রহণ। আইনটির সেকশন ৮ (১) এর ধারায় একটি উপদেষ্টো পরিষদের কথা বলা হয়েছে, উপদেষ্টা পরিষদে কোনো কৃষক এবং আদিবাসী প্রতিনিধি নেই। শুধু বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, সচিব, বিভিন্ন দপ্তরের চেয়ারম্যান, পার্লামেন্ট মেম্বার, মহাপরিচাকগণ থাকছেন। সেকশন ১০(১)-এ দেখা যায় একটি পরিচালনা বোর্ড সেখানেও কৃষক আদিবাসী বা এ রকম কোনো স্পষ্ট প্রতিনিধির কথা উল্লেখ নেই। বিশেষ একটি অঞ্চলের জন্য উন্নয়নে, যাদের জন্য উন্নয়ন, সেই অঞ্চলের কৃষক, আদিবাসী প্রতিনিধিগণের অংশগ্রহণের কথা এই আইনে অবশ্যই থাকা দরকবার ছিল। 

এক্ষেত্রে দেখা যায়, আইনটি জনবান্ধব, কৃষকবান্ধব এবং এই এলাকার বৈচিত্র্যময় জাতিগোষ্ঠীকে মূল্যায়ন করা হয়নি। আইনটি সংশোধন করে অবশ্যই আদিবাসী জনগোষ্ঠীর কমপক্ষে একজন প্রতিনিধি এবং একজন করে অভিজ্ঞ কৃষক-কৃষাণীর যুক্ত করতে হবে। একই সাথে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষসহ এই অঞ্চলকে নিয়ে যারা গবেষণা এবং প্রত্যক্ষভাবে কাজ করছেন এমন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকেও যুক্ত করতে হবে। বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আইন ২০১৮ যদি সকল শ্রেণী পেশার মানুষের দিকগুলো উল্লেখ না থাকে তাহলে তাদের উন্নয়নগুলো কিভাবে বাস্তবায়িত হবে? আইনটির শুরুতেই বরেন্দ্র অঞ্চলের সার্বিক উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু সার্বিক (সকল) মানুষের অংশগ্রহণ নেই যা আইনটির মূল কথার সাথে ভিতরে কোনো সাদৃশ্য নেই। এই আইনটির আরো দুর্বলাতা হলো- আইনটিতে কোথাও বরেন্দ্র অঞ্চলের ভৌগোলিক বৈচিত্র্য এবং ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের দিকগুলো সুরক্ষার কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি। 

আইনটির কারণে একপেশে অর্থনৈতিক চিন্তা-ভাবনা থেকে বরেন্দ্র অঞ্চলে পাতাল থেকে অতিরিক্ত পানি উত্তোলন এবং বরেন্দ্র অঞ্চলের বৈচিত্র্য পরিবেশকে গুরুত্ব না দেবার কারণে আগামীতে আরো সংকট বয়ে আনার সম্ভাবনা আছে। তাই আইনটি দ্রুত পরিবর্তন করে তা বরেন্দ্র অঞ্চলের পরিবেশ ও জনবান্ধব করা অতিব জরুরি।  

০৩. পানি নিপীড়নের নয়া কৌশল ও অস্ত্র হলো এখন বরেন্দ্র ডিপগুলো। ডিপগুলোকে কেন্দ্র করেই এখানে পানি রাজনীতির এক নয়া আধিপত্য সৃষ্টি হয়েছে। ‘জোর যার মল্লুক তার’ বিষয়টি এমন হয়েছে। এই ডিপকে কেন্দ্র করেই বরেন্দ্র জনপদে সামাজিক সম্প্রীতি এবং সৌহার্দ্যপূর্ণ পারিবেশ নষ্ট হচ্ছে। হত্যা, মারামারি, ডিপ দখল, পানির অন্যায্যতা, পানি হীনতা এবং প্রান্তিক কৃষকের পানির অধিকার বঞ্চনার শিকার হচ্ছে। এখানেও নীতির নামে আইনের নামে এক শুভংকরের ফাঁকি এবং প্রভাবশালীদের এক নতুন সুযোগ করে দিয়েছে বরেন্দ্র কর্তৃপক্ষ। বিএমডিএ আওতাধীন এলাকায় ভূ-গর্ভস্থ ও ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহার-পূর্বক সেচ কার্যক্রমের লক্ষ্যে নতুন গভীর নলকূপ/শক্তিচালিত পাম্প স্থাপন, পরিচালনা, সেচনালা নির্মাণ, বিদ্যুতায়ন, গভীর নলকূপ ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণ, খাল/পুকুর পুনঃখনন পূর্বক ব্যবহার, সেচের গভীর নলকূপ হতে খাবার পানি সরবরাহ ইত্যাদি কার্যক্রম নিয়ে বিএমডিএ সেচ নীতিমালা-২০০৮ প্রণয়ণ করে। সেখানেও নীতিমালার কারণে কৃষক এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠী তাদের ন্যায্যতা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। 

নীতিমালার মধ্যে অনুচ্ছেদ ১.২ স্কীম প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সুপারিশের শুধু বিএমডিএর একজন কর্মকর্তার কথা বলা হয়েছে, এখানে কৃষক এবং কৃষক সমিতির মতামতগুলো গুরুত্ব দেয়া দরকার। তেমনি আরো কিছু অনুচ্ছেদ যেমন-১.৩ এ উপজেলা সমন্বয় কমিটির কথা বলা হয়েছে, সেখানে আদিবাসী এবং কৃষকদের অংশগ্রহণ নেই।  অনুচ্ছেদ ১.৭ এ কমিশনের কথা বলা থাকলেও তা স্পষ্ট নয়। একই সাথে নীতিমালাটিতে বিভিন্ন অনুচ্ছেদগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়- একটি গভীর নলকূপ নষ্ট হলে তা কৃষকদের কাছ থেকেই নানাভাবে পার্টিসিপেশন ফি এর মাধ্যমে নেয়া হয়। আবার এই পার্টিসিপেশন ফি কৃষকদের নির্ধারণ করার কোনো ক্ষমতা নেই, নির্ধারণ করেন একজন বিএমডি কর্মকর্তা (অনুচ্ছেদ ১.৬, ১.১৯)। 

অনুচ্ছেদ ১.১২ তে বলা হয়েছে- কমপানি লাগে এমন ফসলের চাষ করতে হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, ডিপ অপারেটরদের সহযোগিতার অভাবে তা সম্ভব হয় না। ডিপ অপারেটর নির্বাচনে রয়েছে প্রভাবশালী এবং ক্ষমতাবানদের আধিপত্য। ২.১ অনুচ্ছেদের জুলাই-ডিসেম্বর এই নিয়মে খন্ডকালীন অপারেটর মনোনয়ন এবং নবায়নের কথা থাকলেও একটি ডিপ অপারেটর নিয়োগ যাকে করা হয়, সেই একই ব্যক্তি বছরের পর বছর চালায়, সুবিধা নেয়। আর এই অপারেটর নিয়োগ সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করে প্রভাবশালীরা। বিএমডিএ অফিস থেকে এই অপারেটর নিয়োগ করা হয়ে থাকে। 

২.৪ অনুচ্ছেদের ভোটের মাধ্যমে অপারেটর নিয়োগের কথা থাকলেও তা বাস্তবে দেখা যায়না। ডিপ-ভিত্তিক প্রতিটি এলাকায় একটি করে কৃষক সমিতি থাকবে, তারাই ভোটের ম্যাধমে বা লটারি করে ডিপ অপারেটর নির্বাচন করবেন। সেটা হলে দ্বন্দ্ব এবং সংকট কেটে উঠার সম্ভবানা আছে। বরেন্দ্র কৃষক মনে করেন, ডিপের ব্যবস্থাপনা এবং ডিপ পরিচালনা প্রতি মৌসুম-ভিত্তিক প্রকৃত কৃষককেই দিতে হবে। এটি প্রতি মৌসুমেই পরিবর্তন হবে। যাতে আগ্রহী সকল কৃষক এই পরিচালনার দায়িত্ব পান। এককভাবে একজনকে বছরের পর বছর ডিপ অপারেটর নিয়োগ করলে তার মধ্যে স্বেচ্ছাচারিতা চলে আসে। নীতিমালাটিতে অপারেটর হিসেবে মহিলার কথা বলা থাকলেও তা বাস্তবে চোখে পড়ার মতো নয়। নীতিমালা বা আইনের বেড়াজালে প্রতিবছর বিএমডিএ সেচের যে ভাড়া নির্ধারণ করে সেটি কৃষক সমিতির মধ্যে থেকে হতে হবে।  

কৃষকরা মনে করেন, প্রতিবছর সেচের যে ভাড়া নির্ধারণ করে সেটি কৃষক সমিতি করবেন। এই ক্ষমতাও কৃষকদের মধ্যে থাকা উচিত। সকল আয়-ব্যায়ের হিসাব ডিপ-ভিত্তিক কৃষক সমিতি করবেন। পানি নিপীড়নের শিকার কৃষকরা মনে করেন, ডিপ ভিত্তিক কৃষক সমিতি ডিপ ব্যবস্থাপনার সকল দায়িত্ব পালন করবেন। কিন্তু বিএমডিএ এর নীতিমালা এবং আইনের বেড়াজালে এই সুযোগ কৃষকরা পায় না। নামামাত্র কৃষক সমিতি থাকলেও তাদের তেমন কোন ক্ষমতা থাকেনা।  কৃষকরা সুযোগ পেলে তারা নিজেদের মতো ফসল ফলাতে পারবে। বিএমডিএ সেচ নিতীমাল ২০০৮ তাই পরিবর্তন করে এটি কৃষকবান্ধব করা অতিব জরুরি হয়েছে। গোটা নীতিমালাতে বরেন্দ্র অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য প্রাণ প্রকৃতি সুরক্ষার দিকগুলো কোনোভাবেই উল্লেখ করা হয়নি। তাই এই নীতীমালাটি সংশোধন করে কৃষকবান্ধব এবং নীতিমালার ভালো দিকগুলো বাস্তবায়নের দাবি জানান বরেন্দ্র জনপদের কৃষক। 

০৪. বরেন্দ্র অঞ্চলের ভৈৗগোলিক বৈশিষ্ট্য এবং খরা, পানিহীনতার ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। এখানে প্রাচীনকাল থেকেই পানি ব্যবস্থাপনায় ভূ-উপরোস্থ উৎসগুলোকেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। এখানে বেশিরভাগ গ্রামগুলোই, বিশেষ করে আদিবাসীসহ সকল বর্ণের মানুষগুলোর গ্রাম গড়ে উঠেছে কোনো একটি পুকুড়-দিঘি বা জলাধারকে কেন্দ্র করেই। ঐতিহ্যগতভাবে তাদের গ্রামের ভিতরের পুকুর-দিঘির পানি ব্যবহার করতো। একইসাথে সেই পুকুড়ে মাছ চাষসহ পানি দিয়ে শস্য ফসল উৎপাদনেও ব্যবহার করতো। এরকম বিলের পুকুড়গুলো থেকেও কৃষকরা মৌসুমী চাষাবাদ করতো। খাল খাড়িগুলো, বিলগুলো ছিলো পানির উৎস। পানির সকল চাহিদা তারা এভাবেই মিটাতো। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের পানি নীতি, পানি-কেন্দ্রিক নানা আইনগুলো তৈরিতে বরেন্দ্র অঞ্চলের আলাদা বৈচিত্র্য এবং ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য গুরুত্ব না দিয়ে ঢালাওভাবে আইন তৈরি করে এই জনপদের মানুষের পানির অধিকারের দিকগুলো সংকোচিত করা হয়েছে। বাংলাদেশ পানি বিধিমালা ২০১৮ এর ২(২১) পানি সম্পদের সমন্বিত উন্নয়নে প্রাকৃতিক ভারসাম্যের ক্ষতি না করার কথা বলা আছে। 

এ আইনে সকল নাগরিকের পানির অধিকারের কথা বলা থাকলেও বরেন্দ্র অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী পানি ব্যবস্থাপনা এবং পানি অধিকার দিকগুলো জটিল করে তুলেছে সাংঘর্ষিক কিছু আইন প্রনয়ন করে। তার মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য একটি হলো সরকারি জলমহাল ব্যবস্থাপনা নীতিমালা ২০০৯। বিগত সময়ে সরকারি জলমহাল ব্যবস্থাপনা নীতিমালা ২০০৯ এর কারণে বরেন্দ্র অঞ্চলে গ্রামের কৃষক, আদিবাসী, প্রান্তিক এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠী তাদের জলাধার পুকুর-দিঘিগুলোতে প্রবেশাধিকার হারিয়েছে। গ্রামের ভিতরে এবং বিলের পুকুর-দিঘিগুলো লিজ দেবার কারণে সেগুলো থেকে তারা পানি ব্যবহার করতে পারে না। একইসাথে মৎস আহরণের অধিকার থেকেও বঞ্চিত। বিভিন্ন সময়ে লিজ প্রথার কারণে গ্রামের পুকুরগুলো রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ও ব্যবসায়ী বেশি টাকার বিনিময়ে লিজ নিয়ে রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করে মৎস চাষ করার ফলে পানি ব্যবহার করা যায় না। আবার লিজ নেয়া পুকুরগুলো ব্যবহার করতে দেয়া হয় না গ্রামবাসীকে। সরকারি জলমহাল ব্যবস্থাপনা নীতিমালা ২০০৯-তে ‘জাল যার জলা তার’ এই নীতির ভিত্তিতে জলমহাল তথা সরকারি পুকুড়, দিঘি, খাড়ি, বিল জলাধারগুলো লিজ দিয়ে থাকে সরকার। 

সেখানে বলা হয়েছে, নিবন্ধিত প্রকৃত মৎসজীবী সমবায় সমিতিকে এগুলো লিজ দিবে। আবার বলা হয়েছে, বেকার যুবক, যুব মহিলা, বিধবা ও স্বামী পরিত্যাক্তা, দরিদ্র ও অস্বচ্ছল ব্যক্তিদের বিভিন্ন মেয়াদে লিজ দেয়া যাবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় তার ভিন্ন। আইন বা নীতিমালার কারণে এসব সরকারি জলমহাল নীতিমালার ৫(৪) অনুচ্ছেদ ক্ষমতাবলে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাগণ লিজ দিয়ে থাকেন। উপরোক্ত নিয়ম নীতি আইনের কারণে গ্রামের ভিতরের পুকুড়গুলোর ব্যবহারের অধিকার হারায় গ্রামবাসীরা। গ্রামের ভিতরের পুকুরগুলো লিজ নেয় প্রভাবশালীরা। তাই এই সরকারি জলমহাল ব্যবস্থাপনা নীতিমালা ২০০৯ সংশোধন করে এটি গ্রামের মানুষের উন্নয়নে শর্তহীনভাবে ব্যবহার করতে দিতে হবে। নীতি বা আইনের ফাঁক-ফোকরে গ্রামের বাহিরের মানুষ এই পুকুড়-দিঘিগুলো লিজ নিয়ে থাকে। একই সাথে যারা সত্যিকারে মৎসজীবী নয় তারাও মৎসজীবী সমবায় সমিতি তৈরি করে এসব পুকুর, জলাধার লিজ নিয়ে সুবিধা নিচ্ছে। 

আর প্রান্তিক মানুষসহ সকল শ্রেণী পেশার মানুষ তাদের প্রাকৃতিক সম্পদে প্রবেশাধিকার হারাচ্ছে। গ্রামের ভিতরের পুকুরগুলো গ্রামবাসিকে শর্তবিহীন ব্যবহারের সুযোগ দিতে হবে। এর ফলে গ্রামের মানুষের পানি অধিকার সুনিশ্চি হবে এবং একইসাথে সমবায় ভিত্তিক মৎস চাষ করে নিজেদের গ্রামের উন্নয়ন নিজেরাই করতে পারবে। এরকম কিছু দৃষ্টান্তও বরেন্দ্র অঞ্চলে আছে। যেমন- চাঁপাইনবাগঞ্জ জেলার নাচোল উপজেলার নেজামপুর ইউনিয়নে বরেন্দা গ্রামের ভিতরে প্রায় ২২ বিঘার সুতিহার দিঘি অন্যতম একটি দৃষ্টান্ত। দিঘিটিকে ঘিরে হিন্দু, মুসলমান ও আদিবাসী জাতিসত্তার মানুষ মিলে মিশে দিনবদলের চেষ্টা করছে। যে দীঘির কারণেই একটি গ্রামের নানামুখী উন্নয়ন করেছে গ্রামবাসীরা নিজেই। একইসাথে গ্রামবাসীর মাছের চাহিদাও মেটাচ্ছে। এই দিঘি শুধু পানির উৎস নয়, এটি সম্প্রীতির এক নিদর্শন। গ্রামবাসীরা যৌথভাবে সমবায় সমিতির ম্যাধমে মাছ চাষ করে আয় করেন। সেই আয় থেকে গ্রামের উন্নয়ন করেন। মাছ চাষের টাকা দিয়ে গ্রামে বিদ্যালয় নির্মাণ, মসজিদ, মন্দির, ঈদগাহ ও শ্মশানসহ রাস্তাঘাট তৈরি করেন। 

তথ্য সংগ্রহকালে জানা যায়, এখন পর্যন্ত দেড় কোটি টাকার বেশি আয় করা হয়েছে, যা দিয়ে গ্রামটির নানামুখী উন্নয়ন করা হয়েছে। এই দিঘীটিই একটি অন্যতম উদাহরণ ও দৃষ্টান্ত হতে পারে যে, যেখান থেকে সরকার নিজেও রাজস্ব পাচ্ছে আবার দিঘিটি গ্রামের মানুষেরে মধ্যেই লিজ দেবার কারণে গ্রামের উন্নয়ন হচ্ছে। হয়তো সরকারকেই এই উন্নয়ন খরচ করতে হতো। কিন্তু তা করা লাগেনি। করেছে গ্রামবাসীরা নিজেরাই। তাই গ্রামের ভিতরের দিঘি-পুকুর, জলাধারগুলো গ্রামবাসীর উন্নয়নে বিনাশর্তে দিবার জন্য নীতিমালা বা আইনে উল্লেখ থাকতে হবে। চলমান নীতিমালা বা আইনে তা নেই।   

০৫. বরেন্দ্র জনপদের প্রাণ প্রকৃতি এবং জনমানুষের পানির অধিকার নিশ্চিত করতে হলে যেমন আমাদের সামাজিকভাবে ইতিবাচক পরিবর্তনের দিকগুলো গুরুত্ব দিতে হবে। তেমনি আমাদের ঢালাওভাবে তৈরি করা আইন নীতিমালাগুলোও সংশোধন বা পরিবর্তন করতে হবে। আর এই পরিবর্তন করতে হবে এই জনপদের মানুষগুলোকে সাথে নিয়েই। সাবির্কভাবে বরেন্দ্র অঞ্চলের পানি অধিকার নিশ্চিত করতে কিছু পদক্ষেপ নেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে তা হলো- ১. সরকারি জলমহাল ব্যবস্থাপনা নীতিমালা ২০০৯ পরিবর্তন করে কৃষক ও জনবান্ধব করতে হবে। ২. বরেন্দ্র অঞ্চলের গ্রামভিত্তিক সরকারি প্রতিটি পুকুর-দিঘি, জলাধার জলমহালগুলো স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত রাখতে হবে, লিজ দেয়া যাবে না। ৩. বরেন্দ্র অঞ্চলে বরেন্দ্র উন্নয়ন কতৃপক্ষের ডিপ ব্যবস্থাপনায় বিএমডিএ সেচ নীতিমালা ২০০৮ পরিবর্তন করে সেখানে কৃষকবান্ধব করতে হবে, কৃষক সমিতিকে সকল ক্ষমতা দিতে হবে। ৪. বরেন্দ্র অঞ্চলের সকল প্রাকৃতিক জলাধারগুলো সংস্কার করতে হবে। দখলমুক্ত করে সেগুলো কৃষকদের সেচের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। ৫. বরেন্দ্র অঞ্চলের বিশেষ বৈশিষ্ট্য, বৈচিত্র্য ও পরিবেশ রক্ষায় উঁচু-নীচু টিলা বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন ভূমি কর্তন করে সমান করা বন্ধ করতে হবে এবং বন্ধে আইন নীতিমালা তৈরি করতে হবে। ৬. খরা ও দুর্যোগের কারণে শস্য ফসল হানি, পশুপাখির ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। একই সাথে খরাপ্রবণ বরেন্দ্র অঞ্চলের প্রান্তিক কৃষক, শ্রমজীবীসহ আদিবাসীদের জন্য খরা ভাতা চালু করতে হবে। ৭. পুকুর-দিঘি, জলাধারে গ্রামের ভিতরে পুকুর/জলাশয়গুলোতে মানুষ বা পরিবেশের জন্য ক্ষতি করে এমন রাসায়নিক কীটনাশক বা এমন কোনো উপকরণ ব্যবহার করা যাবে না- সে বিষয়ে প্রশাসনের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। ৮. বরেন্দ্র অঞ্চলের নদ-নদীগুলো দখল দূষণ বন্ধ করাসহ, এগুলো খনন করতে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সাথে নিয়ে কমিটি গঠন এবং কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। ৯. কৃষিজমিতে পুকুর খনন বন্ধ করতে হবে। এবং পুকুর খনন বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পুকুর-দিঘি খনন ও ভরাট বন্ধে বিগত সময়ে হাইকোর্টের নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে।

০৬. বরেন্দ্র অঞ্চলের উন্নয়ন নীতিমালা তৈরিতে অবশ্যই এই এলাকার প্রাণবৈচিত্র্য, ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক এবং বৈচিত্র্যময় জাতিসত্তার বৈশিষ্ঠ্যগুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে। এই জনপদের মানুষের কথা শুনতে হবে। সরকারি বেসরকারি প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের আগে অবশ্যই পরিবেশগত প্রভাব নিরূপণ (ইআইএ) করতে হবে। তা না হলে বিশেষায়িত এই অঞ্চলের উন্নয়নে আপাতঃদৃষ্টিতে উন্নয়ন দেখা গেলেও তা ভবিষ্যতের জন্য এক মহাসংকট বয়ে আনতে পারে। যা এই জনপদের মানুষের খাদ্য, পানির অধিকারসহ প্রাণবৈচিত্র্য সংকটের দিকে ঠেলে দিবে।   

লেখক:

পরিবেশ আইন গবেষক

বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইন্ডিজিনাস নলেজ (বারসিক)

ইমেইল- shahidul546mh@gmail.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম